ছবিঃ dw.com, Harun-Ur-Rashid Swapan
বহুদিন পর স্ত্রীকে নিয়ে আজ ঘুরতে বের হবে আলম। অফিসের কাজের চাপে স্ত্রীকে সময় দেয়া হয়ে ওঠেনি তার। প্রায় সময়েই ভাবে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। কিন্তু তা আর পেরে ওঠে নি। সকালে উঠে বাসা থেকে অফিস। অফিস ছুটির পর জ্যামে বসে রাস্তায় কাটানো কিছু সময়। এরপর ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরে খেয়ে ঘুম। এই ছিলো তার নিত্যদিনের রুটিন। এই একঘেয়ে জীবন থেকে বের হবার জন্য সে চেষ্টা করেছে অনেক। কিন্তু পারে নি। বহুদিন প্রতীক্ষা করেছে একটু ছুটি পাওয়ার আশায়। এবার তার বহুদিনের প্রতীক্ষার ফল সে পেয়েছে। তিনদিনের ছুটি পেয়েছে আলম। আজ সারাদিন সে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরবে।
সকাল বেলা বাড়ি থেকে বের হলো আলম দম্পতি। তারা একটা রিকশা নিলো। রিকশাওয়ালা গন্তব্য জানতে চায়। আলম বললো " তোমার যেদিকে ইচ্ছা যাও। " নির্দেশমতো রিকশাওয়ালা চালাতে শুরু করে। কিছুক্ষণ রিকশায় ঘোরার পরই রাগে ফেঁটে পড়ে আলম। রিকশাওয়ালা আলমকে তার অফিসের সামনে নিয়ে এসেছে। "মাথা গেছে নাকি? অফিসে নিয়ে এসেছ কেন? " রিকশাওয়ালাকে প্রশ্ন করে আলম। "আপনের এইডা ছাড়া আর যাওয়ার জায়গা আছে নি?" বলে দাঁত বের করে হাসতে থাকে। মেজাজ খিচড়ে যায় আলমের। কিন্তু সাথে বউ থাকায় নিজের ক্রোধ সংবরণ করে নেয় সে। " আর যাওয়া লাগবে না তোমার। এখানেই থামাও। " বলে রিকশা থেকে নেমে যায় আলম।
রিকশা থেকে নেমে স্ত্রীকে পাশে নিয়ে হাটতে থাকে আলম। এই রাস্তা ধরে একটু সামনে এগোলেই একটা বিশাল পার্ক আছে। আলম ঠিক করলো স্ত্রীর সাথে পার্কে কিছুক্ষণ সময় কাটাবে। পার্কের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই হতভম্ব হয়ে গেল আলম। পার্ক কোথায়? এ তো তার অফিস। সে তো পার্কে ঢুকলো, অফিসের সামনে এসে পড়লো কিভাবে? মাথা চুলকাতে চুলকাতে বউয়ের দিকে তাকালো আলম। বউয়ের চেহারায় অভিমানের ছাপ স্পষ্ট। " পার্কের কথা বলে অফিসে আনলে কী জন্য?" বউয়ের কথা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু বউয়ের কথা মিথ্যে নয়। সে নিজেও দেখছে সে অফিসে পৌছে গেছে।
এই অবিশ্বাস্য ঘটনার পর এবার আলম সিদ্ধান্ত নিলো সে সিনেমা দেখতে যাবে বউকে নিয়ে। বউকে দুই-দুইবার অফিসে নিয়ে এসেছে সকাল থেকে। বউ রেগে আছে। একটা রিকশা নিয়ে তারা চলে গেলো শহরের বিখ্যাত সিনেমা হলে। সিনেমার দুটো টিকিট কিনে ভেতরে ঢুকতেই প্রবল অবিশ্বাসে নিজের শরীরে চিমটি কাটলো আলম। সে কী জীবিত? এ কী করে সম্ভব!! সে তার স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমাহলে ঢুকেছে। সে নিশ্চিতভাবেই ঢুকেছে। এবার ভুল হতেই পারে না। কিন্তু সেখানে সিনেমাহল নেই। সেখানে চোখের সামনে আলো ঝলমলে দামি চেয়ার ও একটা বিশাল টেবিল সম্বলিত আলমের অফিসের সম্মেলন কক্ষটা দেখা যাচ্ছে। আবারো অফিসে কিভাবে এলো সে? বউয়ের দিকে তাকাতে সাহস হলো না তার। তবে বুঝতে পারছে তার বউ কাঁদছে। বহুদিন পর স্বামীর সাথে ঘুরতে বের হয়েছে সে। কিন্তু তার কাজপাগল, অফিসের 'এমপ্লয়ি অফ দ্যা ইয়ার' স্বামী তাকে বারবার তার অফিসেই নিয়ে যাচ্ছে। দুজনে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে কেউ কোনো কথা বললো না। নিঃশব্দে পাশাপাশি হাটতে থাকে। আলমের মতে হতে থাকে সে একটা ঘূর্ণাবর্তে আটকে গেছে। শহরে নিশ্চয়ই কোনো বড়ো সমস্যা হয়েছে। সব পথ তার অফিসে গিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই তার অফিস। নাকি তার মাথা ঠিক নেই? নিজের অজান্তেই অফিসে চলে যাচ্ছে হয়তো। বউকে নিয়ে বের হয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছে সে। অফিসের দিকে সে যাচ্ছে না। তারপরও সবকিছুই অফিস হয়ে যাচ্ছে। তার বঊ ক্ষেপে আছে। কষ্ট পেয়েছে অনেক। কিন্তু নিজের অপারগতা কিভাবে বোঝাবে বউকে? বউ কী তার এসব আজব কথা বিশ্বাস করবে? সে তার ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা বাদ দেয়। এবার সে তার বউকে অনুরোধ করে তার সাথে রেস্টুরেন্টে যেতে। খেয়েই বাসায় চলে যাবে। বউ রাজি হয় না। "সেই অফিসেই তো নেবে। যাবো না আমি। বাসায় চলো।" বলে বাসায় যেতে চায় আলমের স্ত্রী। কিন্তু আলম চায় তার বউকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে। অনেক অনুনয়ের পর বউ রাজি হয়।
তারা একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের দোতলায় যায়। দারোয়ান দরজা খোলার পরই প্রথমে ভেতরে উঁকি দেয় আলম। এ কী!!! এ তো তার অফিসের ক্যান্টিন!! নিজেও ভেতরে ঢোকে না আর বউকেও ঢুকতে দেয় না। তাড়াতাড়ি বউয়ের হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নেমে যায় সে। বউ ভেতরে না ঢুকে নিচে নামার কারণ জিজ্ঞাসা করলে আলম বলে, "অনেক ভীর। জায়গা নেই ভেতরে।" বলে অন্য রেস্টুরেন্টে যেতে উদ্যত হয় আলম। এবার ভেবেচিন্তে একটা বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে আসে আলম। এই রেস্টুরেন্টও দোতলা। দোতলায় এসে ভেতরে ঢুকেই দেখে সে তার অফিসের ক্যান্টিনে চলে এসেছে আবার। একটু দূরেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার কলিগ রফিক সিগারেট টানছে। আলমকে দেখেই বলে উঠলো, "আপনি না ছুটিতে গেলেন!! অফিসে আসলেন কখন? ” নিজের চোখ-কান কোনোটাকেই বিশ্বাস করতে পারে না আলম। রফিকের কথা শুনেই তার বউ সেখান থেকে উঠে চলে যায়। হতবিহ্বল আলমের তাকে থামানোর কথা মনে থাকে না। সে রেস্টুরেন্টের দোতলায় ঢুকলো। তার অফিসের ক্যান্টিন সাত তলায়। দোতলা থেকে সাত তলায় পৌছে গেল কী করে? ভাবতে ভাবতে সে ক্যান্টিনের জানালার কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকায়। সত্যি সত্যিই সে সাত তলায় পৌছে গেছে। আলম বুঝতে পারে সে একটা গোলক ধাঁধায় আটকে গেছে। তাকে এর থেকে বের হতেই হবে। সে ভাবতে থাকে,হয়তো বাসায় গিয়েও দেখবে অফিসে চলে এসেছে। এর কোনো সমাধান আসে না তার মাথায়। প্রবল অস্থিরতায় সে উঠে যায় অফিসের ছাদে। সেখান থেকে লাফ দেয় মুক্তির আশায়। লাফ দিয়েই সে বন্ধ করে ফেলে তার দুচোখ। হাওয়ায় ভাসছে সে। একটু পরেই সে মরে যাবে। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে যাবার পরও সে মাটিতে আছড়ে পড়ছে না। হাওয়ায় ভাসার অনুভূতিও আর হচ্ছে না। ব্যাপার কী? হঠাৎ চোখ খোলে আলম। আবারও সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ড। এবার সে বসে আছে তার অফিসে।তার নিজের ডেস্কে। প্রবল অসহায়ত্বে চিৎকার করে উঠতে চায় সে। চিৎকার করতে যাবে, এমন সময় তার এলার্ম বেজে উঠলো।
ঘুম ভেঙে গেছে আলমের। এতক্ষণ যাকিছু ঘটেছ সব তার স্বপ্ন ছিলো। বিশেষজ্ঞেরা বলেন, স্বপ্ন নাকি অবচেতনের কল্পনা। আলমের মনে হয়, অফিস তার অবচেতনকে দখল করেছে বলে অফিস ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না আলম। এতদিন ধরে চাকরি করছে, মায়ায় পড়াটাই স্বাভাবিক। ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে নেয় সে। আজ সত্যিই তার ছুটির দিন। তিনদিন ছুটি পেয়েছে সে। বউকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে সে। স্বপ্নের মতো বাস্তবে সব পথ অফিসে যায় না। স্বপ্নের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে। সকালের নাস্তা শেষে বাইরে বের হবার জন্য প্রস্তুত হয় আলম দম্পতি।
ল্ললঠিক সে-সময় আলমের ফোনে কল আসে। আলমের বসের কল। কল রিসিভ করে "হ্যালো" বলার সাথে সাথেই বস বলে ওঠেন, "এক্ষুণি অফিসে চলে এসো আলম। জরুরি মিটিং আছে। " "কিন্তু আমি তো…." কথা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে কল কেটে দিলেন বস।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:৩৫