আগের পর্বগুলো পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করার অনুরোধ রইলো।ধন্যবাদ।
নভোনীল (১-১৪ পর্ব)
পর্বগুলো লিখেছেন যথাক্রমে শ্রদ্ধেয় ব্লগার রিম সাবরিনা জাহান সরকার,পদ্মপুকুর,মেঘশুভ্রনীল,খায়রুল আহসান,আখেনাটেন,পুলক ঢালী,নিয়াজ সুমন, কবিতা পড়ার প্রহর, মনিরা সুলতানা ,বিলুনী, ঢুকিচেপা, মোঃ মাইদুল সরকার, কল্পদ্রুম ও ফয়সাল রকি প্রমুখ।
আগের পর্বের শেষ লাইনঃ মৃনকে ফোন করবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না নভো।
দ্বিধা,শংকা,আকুলতা,হতাশা যুগপৎ গ্রাস করেছে তাকে। ভেবেছে অপরাধীকে খুঁজে বের করে তারপর যোগাযোগ করবে মৃণের সাথে।কিন্তু মৃণের কাছ থেকেও দূরে থাকতে পারছে না সে। মৃণ গতকাল এসেছিলো। সেও অধীর হয়ে অপেক্ষা করে আছে। অবশেষে সে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।
পানসে চা পান করতে ভালো লাগছিলো না মৃণের। অলিন্দে পাতা চেয়ারে হেলান দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। হঠাৎই তার মোবাইলে রিং হয়। অপরিচিত নম্বর। কল রিসিভ করেই হ্যালো বলে সে। ওপাশ থেকে কোনো কথা শোনা যায় না। শুধু জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই নিঃশ্বাস মৃণের পরিচিত। চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে মৃণের। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না।এরপরই কলটি কেটে দেয় নভো।
মৃণের কণ্ঠে হ্যালো শোনার পর এক অদ্ভূত বিহ্বলতা গ্রাস করে নভোকে।তার অনেক কিছুই বলার ছিলো।কিন্তু কিছুই বলতে পারে নি। কিছুক্ষণ ফোন হাতে বসে থাকে সে।একবার ভাবে মৃণকে আবার কল করবে।কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়, “নাহ! এখনো অনেক কাজ বাকি।“ ফোনটা বন্ধ করে রাখে সে।তার ধারণা মৃণ আবার কল করবে তাকে। এখন সে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
পার্থদার কাছ থেকে খবরটা শুনে চরম মাত্রায় মন খারাপ হয় নভোর। কোনো না কোনো ক্লু তো পাওয়া যাবেই। সেই মোটর সাইকেল আরোহীর কথা মনে হয় তার।সে তার নাম জানলো কী করে? তাছাড়া শারীরিক গড়ণটাও তার পরিচিত মনে হয়।কোথায় যেন দেখেছিলো তাকে এমনটা মনে হতে থাকে নভোর।কোথায় দেখেছে? ক্যাম্পাসে? নাকি অন্য কোথাও? মনে করতে পারে না সে। মোটর সাইকেলটি চলে যাবার আগে তার নম্বর প্লেটটি দেখতে পেয়েছিলো সে।যদিও সবটা নয়।কিন্তু আবার দেখলে চিনতে পারবে।লাল রঙের মোটর সাইকেল।নম্বর প্লেটে লেখা ঢাকা মেট্রো ল ২৪-৩৫……. ।৩৫ এর পর সে আর কিছু দেখতে পায় নি। এতসব কিছু চিন্তা করতে করতেই সে ছবিগুলো নিয়ে বসলো। মোট চারটি ছবি। একটাকে আরেকটার ওপর-নিচে রাখলে তা একটি এ-৪ সাইজের কাগজে রূপ নেয়।হয়তো একটা কাগজে দুটো ছবি প্রিন্ট করে তা মাঝখান দিয়ে কাটা হয়েছে। ইপসনের ফটো পেপার। এসব কাগজে সিরিয়াল নম্বর দেয়া থাকে আবছা জলছাপের মাধ্যমে। একটা কাগজ আলোর কাছে ধরতেই নভো দেখতে পেল আবছাভাবে লেখা S041667 । যাক একটা ক্লু অবশেষে পাওয়া গেল। সে ফোনটা আবার চালু করেই জাকারিয়া ভাইয়ের কাছে ফোন করে। তাকে অনুরোধ করে খুঁজে দেখতে নীলক্ষেতের কোথাও এই সিরিয়াল নম্বরের ফটো পেপার বিক্রি করা হয়েছে কি না গত কয়েক দিনে ।
তারপর সে অনেকক্ষণ ভালো করে আবার দেখে ছবিগুলো।জাকারিয়া ভাই বলেছিলো আনকমন ফেস। ডাউনলোড করা ছবি হতে পারে এটা। তাই নভো একবার মেসের এক রুমমেটের কম্পিউটারের সাহায্যে গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ দিয়ে দেখে। ফলাফল দেখে সে আশাহত হয়। নাহ! এরকম কোনো ছবি গুগলে নেই। তাহলে হয়তো অপরাধী অথবা অপরাধীর একান্ত পরিচিত কারো ব্যক্তিগত ছবি এটা। ক্লু পাওয়া গেল না কোনো। আয়নার সামনে ফোন রেখে আয়নার প্রতিবিম্বের ছবি তোলা হয়েছে। সে হঠাৎ খেয়াল করলো আয়নার ওপরের বাম দিকের কোনায় একটা লেখার উলটো প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। একটা সাইনবোর্ডের ছবি সেটা। লাল রঙের। উলটো করে লেখা শব্দটা পড়তে চেষ্টা করলো নভো। ‘কলিকাতা’ । বাকিটুকু ছবিতে নেই। কিন্তু নিচের অংশ পড়তে গিয়ে দেখতে পেল সেখানে ঠিকানা লেখা। ‘শনির আখড়া’ । মনে মনে হাসে নভো। “শনির আখড়াই বটে।ওখান থেকে শনি চালান করে দিয়েছে আমার আর মৃণের জীবনে।“ স্বগতোক্তি শোনা যায় নভোর কন্ঠ থেকে। একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লু পাওয়া গেছে। এর মধ্যে জাকারিয়া ভাইয়ের ফোন এলো আবার। এত তাড়াতাড়ি ফোন পেয়ে বিস্মিত হয় নভো। জাকারিয়া ভাই খোঁজ পেয়ে গেছেন। বেশি খুঁজতে হয় নি বলে সময় কম লেগেছে। দোকানদার বললো এক মোটর সাইকেল আরোহী তার কাছ থেকে কাগজ কিনে নিয়ে গেছে। দোকানে সিসি ক্যামেরা আছে। চাইলে দেখাতে পারে।কিন্তু দোকানদার গরিমসি করছে। জাকারিয়া ভাইয়ের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। তখনই বাসে করে নীলক্ষেত চলে আসে নভো।জাকারিয়া ভাই দোকানেই ছিলেন। দোকানদারকে কিছু ঘুষ দিতেই দোকানদার সিসিটিভি ফুটেজ দেখায়।সেখানে নভো দেখতে পায় হেলমেট পরিহিত এক লোক এসে কাগজ কিনছে,ঠিক সেই মোটর-সাইকেল আরোহীর মতো গড়ণ তার। কাগজ কিনেই সে রাস্তায় পার্ক করা তার মোটর সাইকেল স্টারর্ট দিয়ে চলে যায়।সেই লাল মোটর-সাইকেল। নভোর আর বুঝতে বাকি থাকে না। মোটর-সাইকেল আরোহীকে খুঁজে পেলেই সব জট খুলে যাবে। তার আগে একবার ছবির ঠিকানায় যেতে হবে।
জাকারিয়াকে সাথে নিয়ে শনির-আখড়ায় যায় নভো। রাস্তার পাশেই একটি ভবনের দোতলায় সেই লাল রঙের সাইনবোর্ডটি দেখতে পায় সে। রাস্তার ওপারেই পাশাপাশি দুটো ভবন। ছবিতে আয়নার বামে সাইনবোর্ড। তাই ডানদিকের ভবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। সেখানকার দোতলার কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দেয় এক লোক।তার চেহারা দেখে আশান্বিত হয় নভো। ছবির সেই লোকটি দরজা খুলে দিয়েছে। তাকে ছবিটি দেখায় নভো। ছবি দেখে লোকটি আকাশ থেকে পড়ে। সে এই কাজ করে নি। তবে ছবিটি সে চিনতে পারে। এটা তার প্রাক্তনের সাথে তোলা । এটা সে তার এক বন্ধুকে শেয়ার করেছিলো মেসেঞ্জারে ।সেই প্রাক্তনের মাথার জায়গায় মৃণের মাথা জুড়ে দেয়া হয়েছে। সে দুঃখ প্রকাশ করে। তার বন্ধুর ঠিকানাও সে দিয়ে দেয়।পুরান ঢাকার সূত্রাপুর। এক মুহূর্ত দেরি করে না নভো।জাকারিয়া কে নিয়ে চলে যায় সূত্রাপুর। ঠিকানা অনুসারে এক বাড়িতে ঢোকে তারা। ঢুকতে গিয়েই গ্যারেজে সেই পরিচিত মোটর সাইকেল দেখতে পায় তারা।অর্থাৎ সেই আরোহীকে হয়তো এখন বাড়িতেই পাওয়া যাবে। সেই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটের কলিং বেল টেপা মাত্রই দরজা খুলে গেল। দরজা খোলার পরই তার পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে বাকরূদ্ধ হয়ে যায় নভো।যেন ভূত দেখেছে। একটু পরেই ধাতস্থ হয়ে নভো দরজার সেই লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “বাশার তুই!!”
বাশার নভোর পরিচিত। মাধবীর চাচাতো ভাই। রাজশাহী থাকাকালে দেখা হতো। কথা হতো।বাশার এই কাজ করেছে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় নভোর। বাশারও অস্বীকার করে সবকিছু। তখন নভো তাকে পুলিশের ভয় দেখায়। এরপরই তার মুখ খুলে যায়। সবকিছুর পেছনে আছে মাধবী। মাধবীর কথাতেই সে এসব কাজ করেছে। কথাটি বিশ্বাস করতে পারে না নভো। সে কতদিন ধরে ভালোবাসে মাধবীকে।মাধবীও সেটা জানে।তাহলে তার সাথে এমনটা কেন করলো মাধবী? মাধবী কি তাকে ভালোবাসে? যদি বেসেই থাকে তাহলে সরাসরি বললেই হতো।এভাবে অন্যের জীবন নষ্ট করে কেন? সেদিন দুপুরের পরই মাধবীর সাথে যোগাযোগ করে তাকে ডেকে তার সাথে কথা বলে নভো। মাধবীও সবকিছু অস্বীকার করে শুরুতে। কিন্তু যখনই নভো বাশারের প্রসঙ্গ তোলে,তখন মাধবী কান্নায় ভেঙে পড়ে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক রাকিবের সাথে প্রেম করতে আগ্রহী ছিলো সে। কিন্তু রাকিব তার প্রেমে সাড়া দেয় নি। একদিন মৃণ্ময়ীর সাথে স্যারকে কথা বলতে দেখে মাধবী।চরম মাত্রায় ঈর্ষান্বিত হয় সে। তার এই ঈর্ষা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে যখন সে মৃণ্ময়ীকে নভোর সাথে দেখে। মাধবীর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় নভো। মাধবীকে ভালোবাসতো সে। তার এই কাজের ফলে তার মনে মাধবীর জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।সেখানে জন্ম নেয় তীব্র ঘৃণা। মাধবীকে কিছু না বলেই চলে আসে সে।
মাধবীর সাথে কথা শেষ হবার পরই নভো আকুল হয়ে যায় মৃণের সাথে বলার জন্য।একবার ভাবে তাকে ফোন করবে।পরক্ষনেই আবার ভাবে নাহ! ফোন করবে না তাকে। সরাসরিই দেখা করবে।“ বহু যুগ পার হয়ে গেছে তাদের মধ্যে দেখা হয় না।
সকাল বেলা নভোর ফোন পাওয়ার পর থেকেই আনমোনা হয়ে আছে মৃণ। সারাদিন সে অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়েছে।ভেবেছে নভো তাকে আবার ফোন করবে। সে সারদিন একটি বারের জন্যেও তার ফোনকে হাতছাড়া করে নি।কিন্তু অপেক্ষা শুধুই বেড়েছে। সে নিজেও ফোন করেছে সেই নম্বরে।বন্ধ পেয়েছে প্রতিবার।বিকেল বেলা তার অলিন্দে সে বসেছিলো। উদাস দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে ছিলো রাস্তার দিকে। দিনের আলো তখনো ফুরিয়ে যায় নি। নরম-কোমল রোদে ছেয়ে আছে আকাশ। হঠাৎ দূরে দেখতে পায় সকালের ছেলেটার মতো একটি ছেলে এগিয়ে আসছে তার বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে। ঠিক নভোর মতো দেখতে। সকালের ছেলেটা নভো ছিলো না।এও হয়তো নভো না।মনে হতে থাকে মৃণ্ময়ীর।কিন্তু ছেলেটা তার বাড়ির সামনে এসেই থেমে গেল।মৃণ্ময়ী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে। দেখতে পায় ,সেই নীল জিন্স আর সাদা টি-শার্ট পরে নিচে দাঁড়িয়ে আছে নভো। মুখভর্তি হাসি নিয়ে হাতের ইশারায় মৃণ্ময়ীকে নিচে ডাকছে সে।
(চলবে)
বিঃদ্রঃ ১৪ তম পর্বে লেখাটি একটি রহস্যের দিকে চলে যায়।তাই রহস্য উন্মোচনের দিকে বেশি দৃষ্টি দেয়ায় হয়তো প্রেমের গভীরতা বা মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন গল্পে বেশি আসে নি। শ্রদ্ধেয় ব্লগার জনাব মাইদুল সরকার এর অনুরোধে গল্পটি লিখেছি।আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো। আমি কখনো প্রেমের গল্প কিংবা রহস্য গল্প লিখিনি। গল্পে তা-ই লিখেছি যা আমার সাথে ঘটলে আমি করতাম। যদিও আমি প্রথমেই পুলিশের কাছে যেতাম। যেহেতু নভোই রহস্য উন্মোচনে ব্রতী হয়েছে,তাই একজন ছাত্রের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ততটুকুই রেখেছি গল্পে।আরো জটিল হলে এমন কিছু করতে হতো নভোকে যেখানে পুলিশের প্রবেশাধিকার আছে, তার প্রবেশাধিকার নেই। এই গল্পে রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে একটা ভজঘট হয়েছে। না এটা গল্প হয়েছে,না প্রতিবেদন ! যতটুকু আবেগ মিশ্রিত লেখা বা কাব্যিকতা দরকার ছিলো তা আমার শব্দগত সীমাবদ্ধতার জন্য আনতে পারিনি। তাছাড়া বিস্তারিত বর্ণনার জন্য গল্পও বড়ো হয়ে গেছে।এজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এরকম গল্প এটাই প্রথম আমার দ্বারা। তাই ভুলত্রুটি থাকা অসম্ভব কিছু নয়।থাকলে ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ রইলো।ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৫৩