
সবুজ গালিচার মতো ঘাস। থেকে থেকে হালকা হাওয়ার দোলা। কী জানি কিসের এক আবেদন? সর্বভেদী বাতাস ঘাসের শরীর ভেদ করতে চায়।শো শো বাতাসের শব্দ কান পেতে শোনার জন্য মাথা উঁচু করে ঘাস।জাপটে ধরে বাতাস।দুমড়ে মুচড়ে খুজতে থাকে নিজের জায়গা।ফুলে ফেপে উঠে ঘাসের সারা দেহ।স্বর্গীয় এক সুখানুভূতিতে টান টান হয়ে উঠে শরীর, তাল-মাতাল সখীর কাছে ছুটে আসে অন্য সখীরা।যুথবদ্ধ সখীরা এবার দিগন্তে মেলে ধরে নিজেদের। মরুৎ দেব উথাল-পাথাল করে দিয়ে যায়। পরক্ষণেই এলোকেশী বাঁশঝোপ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দিবানিশি এই বায়ুকেলির সুখ সুর গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তে আনাচে কানাচে।
গ্রামের ছেলেরা বায়ুকেলির শানেনুজুলে বাঁশের হিয়ার আনন্দ স্বরের লাই বাঁশ কেটে লয় হাতে। মরুতের দেখাদেখি তারাও বায়বীয় এই সুখের আকুল। সংস্কৃত আকুল কারো কারো মতে বাতুল শব্দেরই নাকি বাংলা রূপ বা্উল।গাঁও গেরামের কালো কালো এই বাউধিয়ারা দু'হাতে বাঁশকে জড়িয়ে ধরে নরম ঠোটের উষ্ণ আলতো ছোঁয়ায় মত্ত হয় বায়ুকেলিতে।বাঁশের বাশুড়ী বেজে উঠে। বাংলার মানসপটে এই দামাল ছেলেদের রাজা হলো কৃষ্ণ।কানু ছাড়া গীত নাই। আর বাঁশ বা বাঁশী সেতো কানুর হাতে।
কদম আর তমাল তরু তলে এই রাখাল কৃষ্ণরা বাজাইত বাঁশী।রাঁধা রাই আর গোপীনিদের হৃদয় ছিড়িয়া যাইত।সাপুড়েরা বাঁশী ছাড়া তো মনে হয় বাগেই আনতে পারিতো না সাপকে।বাঁশীর গুণকীর্তন করিতে গিয়া নিজের অক্ষমতার পরিচয় না দিয়া ক্ষেমা দেই। আসলে বাঁশ এক প্রকার ঘাস এ কথা শুনিয়া এতই অবাক হইয়াছিলাম যে হুদাই এত কথা পাড়িলাম।তার চাইতে আমরা বরঞ্চ শচীন কর্তার কথায় কান দেই ''বাঁশী শুনে আর কাজ নেই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশী"।
গৃহস্থালির হেন কোন কাজ খুজে পাওয়া দায় যেখানে বাঁশের ব্যবহার নাই। খেতে বসে তরকারি, কাটা ছেড়ায় ওষুধ এমনকি শিশুর নাড়ি কাটতে।ঘর বাড়ী তৈরী, আসবাব পত্র, বাড়ীর চেকর অর্থাৎ নিরাপত্তা বেষ্টনী, তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠা বানরের অংক কষতে বলতে গেলে ছাই ফেলার ভাঙ্গা কুলা থেকে পারাপারের বাঁশের সাঁকো পর্যন্ত। তিতুমিরের বাঁশের কেল্লার কথা স্মরণ না করলে তো রীতিমত অন্যায়। বাংলার সাথে কী এক নিবিড় সম্পর্ক।খাইতে বসতে ঘুমাতে চিকিৎসায় বিদ্রোহ বিপ্লবে বাঁশ। বঙ্কিম বহু ক্ষেদ প্রকাশ করেছেন বাংগালী বাঁশের লাঠির ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে বলে। দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে বিশাল এক প্যারা বরাদ্দ এই লাঠির শোকে।বাঙগালির আজকার এই দুর্গতির প্রধান কারণই নাকি লাঠিকে ছেড়ে দে'য়া।
আশেপাশের সব রস চুষে খাওয়ার পরও বাড়ীর সামনে পিছনে গরীবের লাগায় বাঁশ। এ যে তাদের অন্ধের যষ্ঠি। মঙ্গার দিনে যখন আর কিছুই নাই তখন এই তো সম্বল।বাড়ী ছেয়ে থাকে বাঁশঝাড়ে। তাইতো মায়েরা শিশুদেরকে চাঁদ দেখায় বাঁশ বাগানের উপর দিয়ে।'বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ'। ভূত প্রেতের কী এক অভয়ারণ্য অন্ধকারাচ্ছন্ন এই বাঁশঝাড়।
বাঁশের যত্ন আত্তি খানিকটা ভিন্ন ঢং এর। ফাল্গুন মাসে ঝরা পাতা সব জড়ো করে আগুন লাগিয়ে দে'য়া। সিরুয়া বৈশ্বার দিন (১ বৈশাখ) উৎসব করে গোড়ায় নতুন মাটি দে'য়া।আর মোগো লক্ষী বিজ্ঞানী খনা বলেছেন ধানের চিটা বাঁশথোপে দে'য়ার কথা। অন্য কোথাও দিলে ইঁদুর লাভের চেয়ে লোকসান করে বেশী।শিকড়ের অত্যাচারে ইঁদুরও দাঁত বসাতে পারে না। যে ইঁদুরের ধারালো দাঁতের আশায় শিশুরা প্রথম দাঁত পড়ার পরে দাঁত বদল করার জন্য খুজে বেড়ায় ইঁদুরের গর্ত সেও থমকে দাঁড়ায়।
ইঁদুরের কথা যখন আসল তখন কিছুক্ষণ ইঁদুরের বন্যা নিয়ে প্যাঁচাল পাড়া যাক। ছোটবেলায় শুনেছিলাম বাঁশের ফুল ধরলে অমঙ্গল হয়। ইতোমধ্যে দু'চার দিন স্কুল কলেজে ঘুড়ে অল্প বিদ্যার অহমিকায় এই সব গাঁ গেরামের লোকায়ত জ্ঞানকে উড়িয়ে দিতাম এক তুড়িতে। ছি কী সব কথা কত কুসংস্কার!! উপনিবেশের জোয়াল কাধ থেকে ফেলে দেওয়ার স্লোগানে কেমন হকচকিয়ে উঠলাম।কবি গুরুর কথার ভিন্ন মানে টের পেলাম 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে দু পা ফেলিয়া'। ইঁদুরের বন্যার ঘটনা এর একটা ভাল নজির।বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকা সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের হিলি সাত কন্যার জুম চাষীরা এর দ্বারা কবলিত। প্রতি ১০-১২ বছর অন্তর অন্তর বাঁশের ফুল ধরে। এর ফলে ইঁদুরের খাবারের প্রাচুর্যতা দেখা দেয়। এমনিতেই ইঁদুরে যে পরিমাণ বাচ্চা উৎপাদন করে অতিরিক্ত খাদ্য পেয়ে সে মাত্রা বেড়ে যায় বহু গুণ। বাঁশের ফুল ধরার এই ঘটনাটি ঘটে জুম চাষের কিছু আগে। ধান পাকার সময় সাধারণত যে পরিমাণ ইঁদুর থাকার কথা তারচে' বহু বেশী ইঁদুর আক্রমন করে পাকা ধানে। উল্লেখিত পুরো অঞ্চলে দেখা দেয় খাদ্যভাব। আর অন্য দু'একটা অর্থনৈতিক মন্দাভাব যোগ হলেই দুর্ভিক্ষ। এটিই ইঁদুর বন্যা নামে খ্যাত। বাঁশের ফুল নিয়ে আসে অশনি সংকেত।
ইঁদুর বাঁশের ফল খেলেও পাণ্ডা কিন্তু খায় পুরো বাঁশ।শিশুর কোলের এই বাহারী পাণ্ডারা চীনেদেশে ঝমঝম বৃষ্টিতে মচমচ করে কামড়ে খায় বাঁশ।মানুষও বাঁশ খায় তবে বাঁশের তরকারি খেয়েছি না বলে 'বাঁশ খাইছি' বললে কিন্তু ভিন্ন মানে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে পাণ্ডার পৌষ মাস আর মানুষের সর্বনাশ!!

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৩