
বেশী দিন আগের কথা না ৯২ সালে গরীবেরা মার খেয়েছিল সেনা বাহিনী ও রাজার সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে। এবার সেনা বাহিনীর হাতে বেদম মার খেয়েছে খুন হয়েছে ৮০ জনের মতো। ইতিহাসে ধনী গরীবের লড়াইয়ের ঘটনা অনেক। দাসেরা ভূমিদাসেরা, দরিদ্র কৃষকেরা মজুরেরা নিজেদের অধিকারের দাবী দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করেছে বার বার। জেতার ঘটনা অনেক কম। তাই বলে গরীবেরা দমে নি কখনও। কী অদম্য সাহসিকতার সাথে এরা ক্ষমতাসীন বড়লোকদের সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিপরীতে খালি হাতে মাঠে নামে! সমগ্র থাইল্যান্ড থেকে গরীবেরা লাল জামা গায়ে জড়ো হয়েছিলো ব্যাংককের ডাউনটাউনে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলদার হলুদ জামাধারী বড়লোকদের উচ্ছেদ করার জন্য ঘেরাও করেছিল সংসদ ভবন। সেনাবাহিনীর এলোপাথারি গুলিতে ১৫টি তাজা প্রাণ ঝড়ে যায়। লাল জামা ধারীরা আস্তানা গাড়ে ডাউনটাউনে। দু'মাস ধরে ইট পাটকেল গুলতি আর কাঁচের বোতলে পেট্রোল ঢুকিয়ে পেট্রোল বোমা নিয়ে তারা লড়াই করেছে আধুনিক অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত সেনাদের সাথে। হলুদ জামা ধারী ক্ষমতাসীনরা তাদের খাদ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে নির্মম সেনা অভিযান চালায়। বেগতিক অবস্থা দেখে নেতৃবৃন্দ আত্মসমর্পন করে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে কিন্তু দমেনি সেনারা। ক্রেকডাউনে অনেক লাশ জখমের পর লাল জামা ধারীরা ডাউনটাউন ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার পথে রাগে ক্ষোভে আগুন লাগিয়ে দেয় বড়লোকদের স্থাপনায়। জ্বলে উঠে স্টক এক্সচেঞ্জ, শপিং মল, ব্যাংক। চোখের জল রোষে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।

শ্যাম দেশ। শ্বেত হস্তীর দেশ।ভ্রমণ বিলাসী মানুষদের তীর্থ। আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে তিন গুণ আর লোক সংখ্যা আমাদের অর্ধেকেরও কম।এখন থেকে দশ হাজার বছর আগে প্রস্তর যুগে এই অঞ্চলে মানুষের বসবাসের নিদর্শন পাওয়া যায়।যখন থেকে ইতিহাস লিখিত হয়ে উঠে তখন থেকে এই অঞ্চল অপরাপর দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মতো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবে ভারতের বলয়াধীন। অধিকাংশ থাই ই বৌদ্ধ কিছু মালয় মুসলমান ও অন্যান্য।তের শতকের শুরুর দিকে সুখোথাই এর বৌদ্ধ রাজাই প্রথম তথাকথিত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে যা টিকে ছিল পনের শতকের গোড়ার দিক অবধি।কিন্তু ১৪ শতকের মাঝামাঝি চাও ফ্রায়া অববাহিকায় আয়ুথ্থায়ার রাজা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে এবং ক্রমেই তারা সুখোথাই রাজ্যকে করায়ত্ত্ব করে।আয়ুথ্থায়ার রাজার সময় থাইল্যান্ডের সাথে বহির্বিশ্বের জমজমাট বাণিজ্য ছিল।এই রাজা ইউরোপিয়দের বাণিজ্যের জন্য আস্তানা গাড়তে দিতেন কিন্তু তা অবশ্যই শহরের বাইরে।আয়ুথ্থায়া শহর এই সময় প্রাচ্যের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র।থাইল্যান্ডই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ যারা কখনও উপনিবেশে পরিণত হয়নি। বর্তমান রাজা ভূমিবলের চাকরি রাজবংশ ১৭৮২ সাল থেকে ক্ষমতাসীন। সারা দুনিয়ায় যখন রাজবংশের প্রভাব কমতে শুরু করে অর্থাৎ সামন্ত যুগের অবসানে ধনতন্ত্রের শুরু তেমনি এক সময় ১৯৩২ সালে রাজপরিবারেরই আশেপাশের পশ্চিম ঘেষা সামরিক ও বেসামরিক আমলারা ক্যু করে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র চালু করে।ভিয়েতনাম যুদ্ধ পর্যন্ত এই রাজা ও আমলারা মিলে দমন পীড়ন চালিয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করে শক্ত হাতে। ঠাণ্ডা যুদ্ধ কালীন সময়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বইতে থাকে কমিনিউজমের জোয়ার। উত্তর ভিয়েতনামের সাথে লড়ার জন্য ১৯৬১ সালে ইউ এস এ সামরিক ঘাঁটি গড়ে থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্ররা ষাটের দশকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে। সে সময়ই প্রথমবারের মতো শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত যারা রাজা ও সামরিক শাষকদের সমর্থক তাদের সাথে গ্রামের গরীব মানুষের সংগ্রাম প্রকাশিত হয়।আন্দোলনের মুখে ১৯৭৩ সালে অল্প কিছুদিনের জন্য সিভিল সরকার ক্ষমতাসীন হয় এবং আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৬ সালে গণ নির্যাতন ও ক্যূ
করে পুনরায় ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তারা।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষে এই বিশাল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাজার ধরার জন্য পশ্চিমা পুঁজিপতিরা বিনিয়োগ নিয়ে আসে থাইল্যান্ডে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে অবকাঠামোগত 'উন্নয়ন' সহ ১০ শতাংশ শহুরে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য দেখা দেয় আর ৯০% পরাজিত দরিদ্র মানুষ বাস করতে থাকে গ্রামে অথবা বস্তিতে। ১৯৯২ সালে ঠিক এই মে মাসেই এই গরীব মানুষেরা জড়ো হয়েছিল ব্যাংককে তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে এবং একই ভাবে সামরিক অভিযান চালিয়ে ৫৪ জনকে খুন করে তছনছ করে দে'য়া হয় তাদের আন্দোলন। এই গণ অভ্যূত্থানের বদৌলতে ১৯৯৭ সালে নতুন করে সংবিধান রচিত হয় যার হাত ধরে ২০০১ এ ক্ষমতায় আসেন থাকসিন সিনাওত্রা।
উচ্চাভিলাষী ব্যবসায়ী এই নেতা দেশে পুলিশে চাকরী করতেন এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রিমিনাল এন্ড জাস্টিসে পি এইচ ডি করেন। পুলিশে চাকরী করা কালীন অনেক ব্যবসা করার চেষ্টা করেন এবং লোকসান করেন সবগুলোতে। শেষে ভাগ্য খুলে অত্যাধুনিক টেলিকনিউনিকেশনে। বিলিয়ন ডলারের মালিক হন। ১৯৯৪ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন ১৯৯৮ সালে থাই রাক থাই দল গঠন করেন।২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন প্রধানমণ্ত্রী। বিদেশী বিনিয়োগ, সেক্স টূরিজম, বেসরকারী করণ কিছুই বন্ধ করেননি। কিন্তু দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার নেতা হওয়ার লক্ষে নিজের সমর্থক গরীব মানুষের জন্য কিছু কর্মসূচী দেন যা থাকসিনমিক্স নামে পরিচিত।
অর্থনীতিতে চাহিদা-যোগানের ভিত্তিতে ক্লাসিকাল তত্ত্ব যখন অতি উৎপাদনের ফেরে মার খাচ্ছিল তখন ত্রাতা হিসেবে আসে কেইন্সের তত্ত্ব। সামষ্টিক অর্থনীতি যদি বিপদে পরে মুক্ত বাজারের কারণে তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার মাধ্যমে তা থেকে উত্তরণের ব্যবস্থাই হলো কেইন্সিয়ানিজমের মোদ্দা কথা। তিরিশের মহামন্দা এবং বর্তমান মন্দায় এই তত্ত্ব আলোচিত হয় ব্যাপক। থাকসিনমিক্সের মূল এই কেইন্সিয়ানিজমেই। ১৯৯৭ সালের অর্থনৈতিক সংকটের ধারা বাহিকতায় ২০০১ এ ক্ষমতা্য় এসে থাকসিন রাষ্ট্রকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কিছু কৌশল গ্রহন করেন।এর মধ্যে চাল রপ্তানিকারক থাইল্যান্ডের কৃষিকে গতিশীল করার জন্য স্বল্প সুদে চার বছর রেয়াদি কৃষি ঋণ প্রদান, পরিবহন খাতে ভর্তুকি,সার্বজনীন চিকিৎসা, জাপানের অনুকরণে 'একটি ট্যামবুন (সাব ডিসট্রিক্ট) একটি পণ্য' এই নীতিতে সহজ শর্তে এস এম ই ঋণ ও ৫০ বিলিয়ন ডলারের গণ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ।এছাড়া রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে সংস্কার করেন যা ছিল জন নন্দিত ও সফল।তার গৃহিত কর্মসূচীর ফলে থাই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায় এবং দারিদ্রের হার নেমে আসে অর্ধেক।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগকারী দশ শতাংশ মানুষ যারা এখন হলুদ জামাধারী নামে পরিচিত তারা সম্পদের এই সার্বজনীন ব্যবহারকে ভাল চোখে দেখেনি। সুবিধাভোগী 'শিক্ষিত' শহুরে এই জনগোষ্ঠী থাকসিনকে ক্ষমতাচূত করার নানা ফন্দি আঁটতে থাকে। অবশেষে ২০০৬ সালে ক্যূ এর মাধ্যমে ক্ষমতাচূত কার হয় থাকসিনকে। তার দল বিলুপ্ত করা হয় পাঠনো হয় নির্বাসনে। ২০০৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে থাকসিন সমর্থিত পিপলস পাওয়ার পার্টি জয়লাভ করে কিন্তু ২০০৮ সাল নাগাদ কোর্টে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষমতা থেকে সরি্যে দেয় সেনা ও রাজার লোকেরা। এখন দেশটির প্রধানমণ্ত্রী ২০০৭ এর নির্বাচনের হলুদ সমর্থক বিরোধীদলীয় নেতা অভিজিৎ ভেজ্জাজিভ। সাধারণ গরীব মানুষেরা ক্ষেপে গি্যে লাল জামা পড়ে ২০০৯ এর এপ্রিলে দক্ষিণ এশীয় সন্মেলন কেন্দ্র ঘেরাও করে। সেনা অভিযান ও জরুরী অবস্থা জারী করে কোন রকমে সামাল দে'য়া হয় সে আন্দোলন। হলুদ রা নির্বাচনে যেতে নারাজ তারা বলে অশিক্ষিত এই দেশে জনপ্রতি এক ভোট এই গণতন্ত্র চলবেনা। লালরা সাধারণ নির্বাচন ও অবৈধ দখলদারকে হটানোর জন্য এপ্রিলে ব্যাংককে জড়ো হয়েছিল।বুলেটের দাগ নিয়ে ফিরে গেছে। কোন কিছুই সমাধান হয়নি। সবাই তাকিয়ে আছে কী করে আমদের এই শ্যাম বন্ধুরা?
১. ২৪ শে মে, ২০১০ দুপুর ১২:১৫ ০