বড়বোনের বিয়ে এ সপ্তাহে। বাসার সবাই অতি উৎসাহী ভঙ্গিতে ইয়া বড় একটা লিস্ট নিয়ে বাজারে বেরিয়েছে। সব বিষয়ে বরাবরই নিরুত্তাপ থাকা আমি বাসায় একা রয়ে গেলাম। অবশ্য একা শব্দটা পুরোপুরি প্রযোজ্য না। অনেক বছর ধরে আমাদের বাসার বিভিন্ন ফুটফরমাশ খেটে আসা ফজলু চাচাও আছেন বাসায়। এই মুহূর্তে আমি পায়চারী করছি এক রুম থেকে আরেক রুমে। মূলত পায়চারীর নামে অপেক্ষা করছি কলিং বেলের শব্দের৷ ছোট চাচা রওয়ানা দিয়েছেন, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে এসেও পৌঁছাবেন। আমার পরিচিত যতজন গুরুগম্ভীর মানুষ আছে তার মধ্যে ছোট চাচার স্থান সবার উপরে। যথেষ্ট গম্ভীর হলেও কেন যেন তাকে আমার খুব ভালো লাগে।
কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দ্রুতপায়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ছোটচাচাকে আজ কেন যেন অন্যরকম লাগছে৷ আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল দাদার মৃত্যুতে। বছর দেড়েক হয়ে গেছে। ছোটচাচা তার চশমা পাল্টেছেন। আগের চারকোণার থেকে এই গোলাকার মতন চশমায় তাকে বেশ ভালো মানিয়েছে।
আমার চিরাচরিত গুরুগম্ভীর ছোটচাচাকে আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজের মনে হলো। বিষয়টা নিশ্চিত হলাম যখন তিনি ফ্রেশ হয়েই আমার রুমে চলে এলেন গল্প করার জন্য।
'কি খবর তোর? পড়াশোনার কি অবস্থা?'
'এইতো চলছে।'
' টেবিলে তো একাডেমিক বইয়ের থেকে গল্পের বইয়ের সংখ্যাই বেশি! মিসির আলী সমগ্র, তারানাথ তান্ত্রিক সমগ্র,............'
কথা আগাতে থাকে। এক ফাঁকে চাচাকে জিজ্ঞেস করি, 'তুমি কি অলৌকিক কোনো কিছুতে বিশ্বাস করো চাচা?'
কয়েকদিন ধরে হরর বই বেশি পড়া হচ্ছে। তাই হয়ত কারও সাথে কয়েক মিনিট কথা বললেই ঘুরেফিরে আড্ডার টপিককে আমি ভূতপ্রেতের দিকে নিয়ে যাই৷
'আসলে আমার মনে হয় সব ঘটনাকেই লজিকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়'
'বাবার মুখে শুনেছি তোমাকে নিয়েও নাকি অনেক অদ্ভুদ গল্প আছে'
'যেমন?'
'তোমার বয়স যখন অনেক ছোট তখন একদিন তোমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না, পরে সন্ধ্যাবেলা তেঁতুল গাছের ডালে পাওয়া যায়। একবার এক সাধু বাবা তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে তুমি খারাপ ছাত্র থেকে রাতারাতি ভালো ছাত্র হয়ে যাও।
'আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার! তুই কি প্লাসিবো ইফেক্টের নাম শুনেছিস? এটা রোগীর এমন এক মানসিক অবস্থা সৃষ্টি করে যাতে রোগীর মনে হয় যে তার রোগ সেরে যাচ্ছে। যদিও এর পিছনে কোনো ঔষধ দায়ী না, রোগী সুস্থ হয় শুধুই তার মানসিক জোরে৷ আরেকটু পরিষ্কার করে দিচ্ছি। ধর ডাক্তার রোগীকে ঔষধ দিলো কিন্তু রোগ ভালো হলো না। এরপর রোগী ডাক্তারের কাছে আবার গেলো। ডাক্তার তখন মাথা খাঁটিয়ে জানালো রোগীকে উচ্চমানের বিদেশী ঔষধ দিতে হবে। কিন্তু তিনি তখন বিদেশী ঔষধ না দিয়ে আগের ঔষধের সমমানেরই কিছু একটা দিলেন। কিন্তু দেখা গেলো রোগী তাতে দিব্যি সুস্থ হয়ে গেছে। কারন রোগী ভেবে নিয়েছিলো এটা উচ্চমানের ঔষধ, এটা একপ্রকার অব্যর্থ, এতে রোগ সারবেই। সাধুর আশীর্বাদের বিষয়টাও হয়তো তেমন। তিনিই আমার মনে প্রথম ধারণা জন্মে দিয়েছিলেন যে আমার পক্ষেও ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। আমি ভেবে নিয়েছিলাম যেহেতু তিনি আশীর্বাদ করেছেন সেহেতু যেকোনো মূল্যে আমার রেজাল্ট ভালো হবেই। আর ছোটবেলায় খেলতে খেলতে তেঁতুল গাছে উঠে গিয়েছিলাম, পরে আর নামতে পারি নি। এর পিছনে মোটেও অলৌকিক কোনো কিছুকে দায়ী করা যায় না।'
'তাহলে কি অলৌকিকতার পুরো কন্সেপটাই ফিকশন? বাস্তবে আদৌ এরকম ঘটে না?'
'আমার তো মনে হয় না। আসলে মানুষই নিজেদের প্রয়োজনে এরকম গল্প ফাঁদে।'
'আমার এক বন্ধুর কাছে তার এলাকার একটা গল্প শুনেছিলাম। যশোর অঞ্চলের মানুষের কাছে পীর বলু দেওয়ান মোটামুটি পরিচিত এক নাম। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন বেশ রহস্যময় লোক। মৃত্যুর পরও সেই রেশ কাটে নি। স্বাভাবিকভাবে পীর আউলিয়াদের মাজার হয় একটা, কিন্তু তার দুইটা। একটা চৌগাছার হাজরাখানা গ্রামে, আরেকটা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ধোপাদি গ্রামে৷ কিংবদন্তী আছে তিনি মারা যান তার মাতুলালয় হাজরাখানা গ্রামে। সেখানে তাকে সমাহিত করা হয়। হাজরাখানার মাজার সগৌরবে জানান দিচ্ছে সেই ঘটনা। আবার একই দিন যাত্রাপুর গ্রামের লোক দেখতে পান বলু দেওয়ান মারা গেছেন যাত্রাপুরে বসে। পরে তাকে সমাহিত করা হয় যাত্রাপুরের পাশে ধোপাদি গ্রামে৷ এই ঘটনাকে তুমি কিভাবে দেখবে?'
'কিভাবে দেখবো আবার! আমার কাছে বানোয়াট লাগছে সবকিছু৷ একজন মানুষ দুইবার মারা যায় কিভাবে?’
'একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছো কেন? এমন কি হতে পারে না যে উনি মারা গেছেন এরপর কোনো অশরীরী কেউ তার রূপ ধরে অন্য গ্রামে চলে গেলো! আমি তো অনেক শুনেছি জ্বীন,ভূত মানুষের আকার ধারণ করতে পারে নিমেষেই।'
'ভূতের গল্প পড়তে পড়তে তোর মাথাটা পুরোপুরিই গেছে৷ বাস্তবে আদৌ ভূতপ্রেত বলতে কিছুই নেই৷ ধর যদি বাস্তবে ভূতপ্রেত থাকতো তাহলে আমি বা তুই নিশ্চয়ই কখনো না কখনো দেখতামই। দেখেনি তো? কিংবা ধর ......... '
আমি প্রায় সবটুকু মনোযোগ দিয়ে শুনছি ছোটচাচার কথা ঠিক তখন বেজে ওঠে আমার ফোনের রিংটোন। পাশের রুমে চার্জে বসিয়ে এসেছিলাম। আমার ফোনে সচরাচর কেউ কল দেয় না৷ তাই উঠে গিয়ে রিসিভ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম না। তবে দ্বিতীয়বার যখন আবার বেজে উঠল তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে গেলাম। ভাবলাম কোনো জরুরী কল হবে হয়তো। ফোন হাতে নিতে দেখি মায়ের নাম্বার৷ রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মা তার চিরাচরিত কন্ঠ বাদ দিয়ে অনেকটা কান্না ভেজা গলায় 'হ্যালো' বললো। মায়ের এরকম গলা নতুন কিছু না। একটা ১০০ টাকার নোট হারিয়ে গেলে কিংবা রাস্তায় হাঁটার সময় নতুন শাড়িতে সামান্য কাদা ছিটকে উঠলেও তিনি এরকম করে থাকেন। কিন্তু এরপর মা আমাকে যারপরনাই হতবাক করে দিয়ে যা বললেন তা হলো, 'তোর ছোটচাচা ঢাকা আসার পথে গুরুতর এক্সিডেন্ট করেছে৷ এখন হাসপাতালে আছে।অবস্থা খুবই মারাত্মক। দ্রুত রক্ত ম্যানেজ করতে হবে । তুই দেরি করিস না, শিগগিরই চলে আয় বাবা'
আমি যেন মুহুর্তেই সবটুকু হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেলো মেঝেতে৷ ঠিক তখনই ওপাশের রুম থেকে কে যেন বলে উঠল, 'কিসের শব্দ হলো?'
আতংক কিংবা বিষণ্ণতায় মুষড়ে পড়া আমি আন্দাজ করতে পারলাম না এটা কার গলার স্বর। আমাদের ফুটফরমাশ খাটা ফজলু চাচার নাকি এতক্ষণ ধরে আমার পাশে বসে গল্প করে আসা ছোট চাচার!