অনেক ডাকাডাকির পরেও কারও খোমা দেখতে না পেয়ে স্যারেরা যখন বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, তখনই খুব অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে ক্লাসের সবগুলো চোখ একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
মধ্য জুন, ২০০৬। টানা ২দিন ধরে গ্র্যাজুয়েশন ফাইনাল থিসিস পেপার সাবমিশন + প্রেজেন্টেশন চলছে তখন। মোটামুটি সবারই নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার মত অবস্থা, যতটা না থিসিসের চিন্তায় তার চেয়েও বেশি কোনও কারণ ছাড়াই স্যারদের বাক্যবাণে অপদস্থ হওয়ার ভয়ে। চোখের সামনে কাছের দোস্তদের বিনা অপরাধে অপমানিত হতে দেখতে কার ভালো লাগে? (আমার ২জন বন্ধু প্রেজেন্টেশনের সময় অপদস্থ হয়েছিলো তাদের মধ্যে লাভ অ্যাফেয়ার ছিলো বলে!) এমন নয় যে কোনও টেকনিক্যাল ভুলের কারণে তাঁরা ছাত্রদের অপমান করেন, অপমান করার ইচ্ছে বা খায়েশটাকে আসলে অনেকটা ‘হবি’ বলা যায়। বিভিন্ন কারণে তাঁরা এমনটি করে থাকেন, সেইসব বিভিন্ন কারণগুলোর মধ্যে একটা হলো শিক্ষকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং পলিটিক্স। পলিটিক্স বলতে ঠিক আ.লীগ/বিএনপি পলিটিক্স নয়, ব্যক্তিগত রেষারেষিই মূল, আর আমি (প্লাস আমার গ্রুপে অন্য যে কয়েকজন ছিলো তারা সবাই) ছিলাম এই বিষয়টিরই শিকার।
এখানে একটু বলা প্রয়োজন--- সকলেই জানেন, যে কোনও মাদার সাবজেক্টেরই কতকগুলো বাইপ্রোডাক্ট সাবজেক্ট থাকে এবং কোন শিক্ষক কোনটা পড়াবেন বা সুপারভাইজ করবেন সেটাও তাঁদের নিজস্ব স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ঠিক করা থাকে। যেহেতু আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টেমেন্টের ছাত্রী, কাজেই আমার সাবজেক্টের বাইপ্রোডাক্ট গুলো হচ্ছে স্ট্রাকচারাল, এনভায়রনমেন্টাল, ট্রান্সপোর্টেশন, জিওটেকনিক্যাল এবং ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং আমার থিসিসের বিষয়বস্তু ছিলো ঐ শেষেরটা সম্পর্কিত (টপিকের নামটা একটু বলি, তা হলো 'A thesis on Ground Water Discharge in 5 thanas of Barind Area of Bangladesh' অর্থাৎ বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের ৫টি থানার ওপর মাটির নিচের পানির স্তরের ওঠানামার একটা হিসাব কিতাব আর কি)। যে স্যারের আন্ডারে আমি কাজ করেছিলাম তিনি মোটামুটি কুখ্যাত শিক্ষকদের একজন। কুখ্যাত এই হিসেবে যে, চিরবৃদ্ধ একজন ব্যক্তি (অবশ্যই মানসিক ভাবে, এমনিতে ওনার বয়স এমন আহামরি কিছু নয়) যিনি ঘুরেফিরে একই বিষয়ের উপর (এক বছর পরপর, বাই রোটেশন) থিসিস করিয়ে অভ্যস্ত এবং কোনওরকম সাহায্য সহযোগিতা করতে আগ্রহী নন, ভাবখানা এমন যে “তোমার থিসিস তুমি করোগে, আমার কি! মরলে তো মরবা তুমি!” কোনওরকরমের বিদ্যার আদানপ্রদান করতে চান না, এ নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথাও নেই, এবং বিনাবাক্যব্যয়ে যে কাউকে থিসিসে ফেল করিয়ে দিয়ে মজা লুটতে তেনার এতটুকুও বাধে না!
এই বিশেষ ব্যক্তিটির সঙ্গে যথারীতি ডিপার্টমেন্টের আরেকজনের বেশ ক্যাঁচাল ছিলো এবং মজার ব্যাপার হলো সেই ব্যক্তিটিও ঐ একই সাব ডিপার্টমেন্টের টিচার ছিলেন (ওয়াটার রিসোর্স)। তেনারা সাকুল্যে ঐ দু’জনেই ছিলেন পিঠাপিঠি (!) এবং পরস্পরের পিঠে বাঁশ দিতে পারলে তাদের আর কিছু লাগতো না। (আচ্ছা একটা করে নাম দিয়ে দেয়াটা খুবই জরুরি, ধরি আমার থিসিস সুপারভাইজারের নাম আলু স্যার আর ঐ আরেকজন ক্যাঁচাল স্যারের নাম হচ্ছে পটল স্যার।)
তো যখন দেখলাম যে ক্লাসের সবাই একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তখন বাধ্য হয়েই বুঝে গেলাম যে এবার আমার পালা।
আমরা যে ৫জন একসঙ্গে একগ্রুপে থিসিস করেছিলাম তাদের প্রত্যেকের টপিক ছিলো ঐ একই শুধু থানাগুলো ছিলো আলাদা (বরেন্দ্র অঞ্চলে মোট ২৫টা থানা আছে, সমানভাবে সেগুলো ৫জনকে ভাগ করে দেয়া হয়েছিলো)। প্রত্যেকেই পেয়েছিলো মোটামুটি কাছাকাছি এলাকার থানাগুলো, শুধু আমিই পেয়েছিলাম একেবারে বেড়াছেড়া অবস্থায়, ৩টা সর্বদক্ষিণের আর ২টা সর্বউত্তরের থানা, যার কারণে আমার পাওয়া রেজাল্টগুলোর মধ্যেও বেশ বড় ধরণের বৈচিত্র্য ছিলো।
প্রজেক্টরের সামনে গিয়ে যখন মুখ খুললাম তখন চট করে বুঝতেও পারিনি যে ঘটনা এতদূর গড়াবে।
যেমনটি বললাম, আমাদের গ্রুপে আমরা ৫জন ছিলাম, আর আমাদের সবারই একটা সমস্যা হয়েছিলো সেটা হলো, আমাদের টপিক ছিলো একই এবং পুরো থিসিস পেপারে যত ভাষা মানে থিওরি টাইপ ল্যাংগুয়েজ দেয়া ছিলো সবই এক (মানে পুরাই কপি পেস্ট আর কি) খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্যারেরা বিরক্ত হচ্ছিলেন আর আমাদের সুপারভাইজার আলু স্যারের দিকে বাঁকা নজরে তাকাচ্ছিলেন। আমি যখন প্রেজেন্টেশন দিতে গেছি তখন বেচারা আলু স্যারের নিজেরই প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আর ওদিকে আমাকে দেখে পটল স্যারের চোখ তো একেবারে চকচক করে উঠলো, ভাবখানা এমন, 'এই তো পাওয়া গেছে আলু’র আরেক ছাত্রীকে, একে যদি ধুমাইয়া বাঁশ দেয়া যায় তাহলেই তো আলুকে অপমানের ষোলকলা পূর্ণ হয়!' (আলু তো আর মুখফুটে কিছু বলতে পারে না, সে বেচারা অ্যাকাডেমিক্যালি পটলের ৪ বছরের জুনিয়র!)
যথারীতি প্রথমেই তিনি ঘ্যানঘ্যান শুরু করলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের মানচিত্র নিয়ে, আমরা যে মানচিত্রটা দেখাচ্ছি সেটা নাকি বৃটিশ আমলের, রিসেন্ট মানচিত্র দেখাতে হবে! বহু কষ্টে সেই ঘ্যানঘ্যানানি থামিয়ে আবার যেই পরবর্তী স্লাইডগুলো দেখানো শুরু করেছি, হঠাৎ এক পর্যায়ে তিনি বলে বসলেন, “আচ্ছা, এই যে থিসিস পেপারের শেষে তোমরা যে বুক রেফারেন্স এর একটা তালিকা দিয়েছো, এটা কোত্থেকে পাওয়া?”
এটা তো জানা কথাই যে থিসিসের ম্যাথমেটিক্যাল ডিডাকশন আর ডাটা অংশটুকু বাদ দিলে বাকি পুরোটাই কপি পেস্ট, সিনিয়র এক ভাইয়ের থিসিস থেকে চোথা মারা। আমাদের গ্রুপে নীরব নামে একটা ছেলে ছিলো, পুরো থিসিসের জন্য আমরা ওর ওপরে অনেক নির্ভরশীল ছিলাম। বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার কৃষি অফিসে ঘুরে ঘুরে অনেক কষ্ট করে আমরা ডাটাগুলো জোগাড় করেছিলাম, সকল প্রকার গাণিতিক হিসাব কিতাব যেমন টোটাল ডিসচার্জ এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্যারামিটারের ভ্যালু বার করা, হাজার হাজার ডাটা থেকে গ্রাফ তৈরি করা, বিভিন্ন থানার প্রাপ্ত রেজাল্টগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বিচার দাঁড় করানো, এগুলো সব আমরা নিজেরা যে যে যার যারটা করেছি কিন্তু মূল কনসেপ্টটা দিয়েছে নীরব, এবং এর জন্য প্রচুর খাটনি করতে হয়েছে তাকে। ঐ রেফারেন্সের লিস্টিটাও সে-ই জোগাড় করেছে, সিনিয়র সেই ভাইয়ের থিসিস পেপার থেকে। এখন স্যার যে প্রশ্নটা করেছেন, সেটার সঠিক উত্তরটা যদি দিতে হয়, কি বলবো তাহলে? কি বললে তেনাকে নিরস্ত করা যাবে? কি বললে তিনি আমাকে অপদস্থ করা থেকে ক্ষান্ত দেবেন?
কেমন যেন একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলাম, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছিলো হয়ত... শুনতে পেলাম স্যার চিৎকার করে বলছেন “বলো, এক্ষুণি বলো এটা কার কাছ থেকে পেয়েছো, বলতে তোমাকে হবেই... না বললে এক্ষুণি এই থিসিস পেপার ছিঁড়ে ফেলে তোমাকে ফেল করিয়ে দেবো... কি হলো, চুপ করে আছো কেন? বলো!!!”
আমি নিজেও টের পেলাম না কখন আমার মুখ দিয়ে নীরবের নাম বেরিয়ে গেলো।
আর যায় কোথায়, সঙ্গে সঙ্গে স্যার ওখানেই নীরবকে ডেকে এনে শুরু করলেন তুমুল ঝাড়ি! নীরব অবস্থাটা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলো (স্যারদের স্বভাব তো আর তার অজানা নয়), সে কিছুক্ষণ স্যারের মধুর বাণী (!) হজম করে চুপচাপ নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে রইলো। ক্লাসের প্রতিটি মানুষ তখন স্তব্ধ। ২দিন ধরে কত ঘটনাই তো ঘটছে, কিন্তু তাই বলে এতবড় একটা ব্যাপার হয়ে যাবে এটা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।
আমার চোখের সামনে সবকিছু দুলতে শুরু করেছে তখন। খালি একটা কথাই মনে হচ্ছিলো, এটা আমি কি করলাম? যে নীরব আমাদের সবাইকে থিসিসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এত হেল্প করেছে, এত সাপোর্ট দিয়েছে, আমি তাকে এভাবে অপমানিত করলাম? সে বাদ দিয়ে আমাদের বাকি ৪জনের জন্যই থিসিস ছিলো বিভীষিকার মত, নীরব একাই টেনে নিয়ে গেছে আমাদেরকে, ওর সহযোগিতা না থাকলে এতদূর আসাই হতো না, আমি সেই নীরবকে এভাবে... How could I be so cruel? How? How?? How???
আমার শরীরে আর শক্তি ছিলো না দাঁড়িয়ে থেকে বাকি প্রেজেন্টেশনটুকু শেষ করার কিংবা স্যারদের প্রশ্নের উত্তর দেবার। স্যারদেরও আর ইচ্ছা ছিলো না অন্যকিছু বলার। স্লাইডগুলোর শেষের অংশটুকু আমি খুব খাটনি করে দাঁড় করিয়েছিলাম, ওটুকু অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিলো। একবার তাঁদেরকে অনুরোধ করলাম যেন আমাকে অন্ততঃ ঐ অংশটুকু একবার দেখানোর সুযোগ দেয়া হয়, সেটাও তাঁরা দিতে কোনওভাবেই রাজি হলেন না। একবার কেবল একজন স্যার জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা বলো তো দেখি, টিউবওয়েল দিয়ে খানিকটা পানি তুলে আমি যদি পুকুরে দিয়ে দিই, তাহলে সেটা কি হবে, গ্রাউন্ড ওয়াটার না সারফেস ওয়াটার?"
এখন ভাবলে খুব অবাক লাগে, আমার বোধহয় মাথার ঠিক ছিলো না, আমি চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, "অবশ্যই গ্রাউন্ড ওয়াটার!"
স্যারও দেখলাম আর উচ্চবাচ্য করলেন না, সেটা আমি ঠিক উত্তরটা দিয়েছিলাম বলে, নাকি আমার মানসিক অবস্থাটা ধরতে পেরেছিলেন বলে, কে জানে?
প্রেজেন্টেশন শেষ হলে পরে যে দৃশ্যটা দেখা গেলো সেটা অনেকটা এরকম, আমি নীরবের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছি আর বলছি "নীরব আই অ্যাম সরি... আই অ্যাম রিয়ালি সরি নীরব... আই অ্যাম..."... নীরবও বারবার বলছে "না না, আমি কিছু মনে করিনি... তুমি এত আপসেট হচ্ছো কেন?... ইটস অলরাইট!"...
পাশ করার পরেও দীর্ঘদিন আমি আটকে ছিলাম কেবল ঐ থিসিসের কারণে। ঠিক পটল স্যারের দোষে নয়, আমার সুপারভাইজার ঐ আলু স্যারের দোষেই। আমার অন্য সব বন্ধুরা পাশ করে বেরিয়ে গেলো, কেউ কেউ চাকরিও পেয়ে গেলো আর কেবল আমিই নিত্যদিন স্যারের দুয়ারে ধর্ণা দিতে থাকলাম। ঘন্টার পর ঘন্টা স্যারের অপেক্ষায় সিভিল বিল্ডিং এর সামনে আম গাছের গোল চত্ত্বরটায় বসে থাকতাম, স্যার ফিরেও তাকাতেন না, আর জুনিওর ছেলেমেয়েরা দেখে বলতো, "আরে আপা, আপনি এতদিন পরও এখানে?... কি করেন? কি কাজ এখন?..."
কি উত্তর দেবো? কি উত্তর হয় এই কথার?
*******************************************
পাশ করার অনেকদিন পরে একবার একটা কাজে আমার বাবা গিয়েছিলেন সেই আলু স্যারের কাছে। আমার বাবাও একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন (ইলেক্ট্রিক্যাল) এবং যথারীতি তিনি আলু স্যারের অনেক সিনিয়র। বাবা এসব ব্যাপার কিছুই জানতেন না, এমনিই কথায় কথায় একবার তুলেছিলেন আমার কথা। শুনে আলু স্যার নাকি বলেছিলেন, "হায় হায়, ও আপনার মেয়ে, আগে বলবেন না? আগে জানলে একটু ‘কনসিডার’ করতাম!"
যে পোস্টটি দেখে এই দুঃস্মৃতিকথাটি লেখা
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:৫১