প্রথম তাকে দেখি 'শিন্ডলার্স লিস্ট' মুভিতে। এক মুভিতেই কাত! মুভিটির নাম আমার আগে জানা ছিলো না। আমার এর আগের একটি পোস্টে কয়েকজন ব্লগার আমাকে এই মুভিটি দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন (অনেক ধন্যবাদ তাঁদেরকে)। প্রথমবার মুভিটি দেখার আগে আমার ধারণাও ছিলো না যে এমন একজন স্বল্পবিখ্যাত অভিনেতার জন্য আমি এত পাগল হবো।
এটা কে না জানে যে শিন্ডলার্স লিস্ট মুভিটি স্টিভেন স্পিলবার্গের জীবনে যেমন মাইলফলক, তেমনি লিয়াম নিসন কেও মানুষ সত্যিকার ভাবে চেনে ঐ একটি মুভির জন্যই। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর 'টেকেন' ছবিটিও বেশ সাড়া ফেলেছে, সুনাম কুড়িয়েছে, কিন্তু সেই সুনাম আর এই সুনামের মধ্যে অনেক ব্যবধান রয়েছে বলেই আমার মনে হয়। এতবার দেখেছি এই ছবিটা, তাও দেখা শেষ হয় না। কি অসাধারণ স্টাইলিশ একজন অভিনেতা এই লিয়াম নিসন। অভিনেতা /অভিনেত্রী হলেই স্টাইলিশ হতে হবে এমন চিন্তা কখনোই করিনি, কিন্তু এই একটা জায়গায় এসে মনে হলো, চরিত্রের সাথে একেবারে মানানসই ভাবে খাপ খেয়ে যায়, এমন কিছু স্টাইল না থাকলে সে আবার কেমন অভিনেতা ! ফলে লাভের লাভ হলো এই যে, একেবারে হাত-পা ভেঙ্গে আমি এই লোকের প্রেমে পড়ে গেলাম।
ওঠা, বসা, খাওয়া, মুচকি হাসা, ছোটখাট ভাষণ দেয়া, যাবতীয় লুলামি করা , কান্নায় ভেঙ্গে পড়া, এমনকি স্মোক করার দৃশ্যেও (বিড়ি খাওয়া জিনিসটা আমার অসম্ভব খারাপ লাগে) মানুষকে এত এ্যাট্রাক্টিভ লাগতে পারে, আমার ধারণাই ছিলো না। আহা... সে কি রূপ ! কি অদ্ভুত গভীর অথচ মিষ্টি একটা কন্ঠস্বর, আর কি চমৎকার ডায়ালগ থ্রোয়িং। সেই যে দৃশ্যটা যেখানে সে আমন গথ (র্যালফ ফিয়েনেস) কে বলে তার সাথে একদান পোকার খেলতে, যে জিতবে সে হেলেন হির্শ কে নিয়ে যাবে, কেমন চালবাজ মার্কা একটা হাসি দেয়!! কিংবা সেই দৃশ্যটা যেখানে তার পালিত ইহুদিদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে সে নিজে তো কাঁদেই, আমাদেরকেও কাঁদিয়ে ছাড়ে... আসলে অভিনয় ভালো বলেই এসব আরও বেশি দৃষ্টি কাড়ে, সমস্যা হলো এই লোকের ক্ষেত্রে এসে সব ভালোলাগা এক জায়গায় এসে মিশে গেছে। তার চেয়েও আরও অনেক ভালো ভালো অভিনেতা আছে নিশ্চয়ই হলিউডে, কিন্তু কি করবো, যার যেথা মজে মন, কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম!
শেষ পর্যন্ত পাগলামি এত বাড়লো যে দেখলাম তার অন্য মুভি না দেখলে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না। উইকিপিডিয়া, রটেন টোম্যাটো, আইএমডিবি, ইয়াহু মুভিজ ঘেঁটে তার সব ছবির নাম বার করলাম। ডাউনলোড করে দেখা শিখতে পারিনি, বাধ্য হয়ে মুভি কিনে দেখতে হয়। কিনতে গিয়ে দেখি তার মুভি বাজারে খুবই দুর্লভ। কি পরিমাণ অসাধ্য সাধন করে যে তার ছবিগুলো জোগাড় করতে হয়েছে তা এক আল্লাহ মা’বুদ জানে। তবে শেষ পর্যন্ত যা সংগ্রহ করতে পেরেছি তাও নেহাত কম নয়। মজার ব্যাপার হলো, তার এত মুভি দেখলাম, এখনও শিন্ডলার্স লিস্টের প্রতি আমার আগ্রহ বিন্দুমাত্রও কমলো না। আমি অসংখ্যবার ভেবেছি ছবিটা পুরোটা দেখবো না, আমার তো শুধু লিয়াম নিসনকে দেখার সাধ, যেসব দৃশ্যে সে আছে শুধু সেগুলো দেখলেই তো হয়... কিন্তু পারি না। একটা ২য় বিশ্বযুদ্ধ তথা হলোকাস্টের উপর নির্মিত ছবি বারবার দেখতে কষ্ট হওয়ারই কথা, কিন্তু কেবল লিয়াম নয়, প্রতিটি অভিনেতা অভিনেত্রীর অভিনয় সেখানে এত চমৎকার এবং স্টিভেন স্পিলবার্গের নির্দেশনা এত অসাধারণ যে পুরো মুভিটা না দেখে ওঠা হয় না। যারা মুভিটি দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন, আর যারা এখনও দেখেননি তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো মুভিটি দেখার আগে/পরে অবশ্যই এ সম্পর্কিত উইকিপিডিয়াটি একবার পড়ে নেয়ার, তাহলেই মুভিটি দেখার আনন্দ পরিপূর্ণ রূপ লাভ করবে।
Rob Roy
এখানে তার চরিত্রটি একজন দরিদ্র স্কটিশ পশুচারকের, যার কাজ হচ্ছে মালিকের পশু নিয়ে পাহাড়ে চরানো, খাওয়ানো এবং সেগুলোর দেখাশোনা করা, লালন-পালন করে বড় করা। খুব সাধারণ একজন মানুষ কিভাবে ১০০০ পাউন্ড ঋণ নিয়ে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়, তার সুখের সংসারে যন্ত্রণার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে এবং তারপরেও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কিভাবে মরিয়া হয়ে সে নিজেকে এবং তার স্ত্রী-সন্তানদেরকে সেই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনে, সেই কাহিনীই দেখানো হয়েছে এখানে। যেহেতু এটা কয়েকশো বছরের পুরনো একজন স্কটিশের গ্রাম্যজীবনের কাহিনী, কাজেই এই মুভির পোশাক সজ্জা, লোকেশন এবং আবহ সঙ্গীতের সাথে ব্রেভহার্ট ছবিটির এই জিনিসগুলোতে দর্শকরা মিল খুঁজে পাবেন। স্ত্রী ম্যারির (জেসিকা ল্যাঞ্জ) সাথে তার যে মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক এবং ভালোবাসাবাসির দৃশ্যগুলো দেখানো হয়েছে তা আসলেই মনে রাখার মত। মোটের ওপর ছবিটি বেশ ভাল, তবে এখানে একটি ধর্ষণের দৃশ্য রয়েছে (ভিলেন আর্চিবল্ড (টিম রথ) নায়ক রব রয়ের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তার স্ত্রী ম্যারিকে ধর্ষণ করে)। পরিচালক চেষ্টা করেছেন খুবই শ্লীল এবং ভদ্রভাবে ব্যাপারটি দৃশ্যায়িত করতে এবং সফলও হয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই, এমন দৃশ্য অসংখ্য মুভিতে থাকে এতেও কোনও সন্দেহ নেই... কিন্তু পর্দায় এ ধরনের দৃশ্য দেখাটা আমার কাছে কষ্টকর মনে হয়। তবে ছবিটি ভালো , যে জীবনবোধ এখানে তুলে আনা হয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার।
Kinsey
ছবির পোস্টারেই দেখতে পাচ্ছেন এই মুভির বটম লাইন হলো ‘Let’s talk about sex’. এটা একজন হতভাগ্য গবেষকের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এক দুঃখের কাহিনী। প্রফেসর আলফ্রেড কিন্সি ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একজন অধ্যাপক যিনি প্রধানতঃ ‘গল ওয়াস্প’ নামক এক ধরণের কীট/পতংগ নিয়ে গবেষণা করেন এবং পড়ান। ভালোবেসে একজন ছাত্রীকে (লরা লিনি) বিয়ে করার পর তিনি নিজ উদ্দ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের সাথে তাদের বিভিন্ন যৌন সমস্যার কথা আলাপ করতেন এবং সেগুলোর যথসাধ্য সমাধান দিতেন। এই কাজ করতে গিয়েই তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, যৌন বিষয়াবলী সম্পর্কে মানুষ কত অজস্র ভুল ধারণা নিয়ে বাস করে এবং এই বিষয়গুলো নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ যুক্তি সম্বলিত কোনও বইপত্রও নেই। তাহলে মানুষ জানবে কিভাবে? আর যদি না-ই জানতে পারে তাহলে তাদের এসব ভূল ধারণা দূরীভূতই বা হবে কিভাবে? তখন তিনি এ নিয়ে বিশদাকারে জরিপ এবং গবেষণা শুরু করলেন । ডঃ কিনসির প্রথম প্রকাশিত বইটি ছিলো Sexual Behavior in the Human Male (১৯৪৮) যেটিকে সেক্সোলজি বিষয়ে মানবকল্যাণে অগ্রগণ্য হিসেবে ধরা হয়। একই কাজের ধারাবাহিকতায় তিনি পুরুষদের মত নারীদের সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার নিয়েও কাজ করা শুরু করেন কিন্তু তাকে বিপুল সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। রকেফেলার ফাউন্ডেশন তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, অর্থসাহায্য দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং হতভাগ্য ডঃ কিনসিকে বাধ্য হয়ে তার গবেষণার কাজ সেখানেই থামিয়ে দিতে হয়, তারপরও তিনি ব্যক্তিগতভাবে সাধারণ মানুষের সাথে তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ারিং এর কাজটি একাই চালিয়ে যান। ছবিটা দেখলে কিছুটা হলেও মন খারাপ হবেই। আইএমডিবি’র হিসাব অনুযায়ী এই মুভিটি বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে মোট ১১টি পুরস্কার ও ২৭ টি নমিনেশন পেয়েছে।
Before and After
এই ছবিটিকে থ্রিলার গোত্রে ফেলা যায়। বাবা লিয়াম এবং মা মেরিল স্ট্রিপ বড় ধরনের একটা ধাক্কা খায় যখন পুলিশ হঠাৎ একদিন এসে তাদের কিশোর সন্তান জ্যাকবকে তারই সমবয়সী একটি মেয়ের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে ধরে নিয়ে যায়। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না যে তাদের পুত্রধন এমন কাজ করতে পারে, কিন্তু যখন দেখে যে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পুত্রধন একটি কথাও বলে না, মুখে কুলুপ এঁটে থাকে তখন তারা ধাঁধায় পড়ে যায়। সকল কিছুকে ছাপিয়ে সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা এবং পারিবারিক বন্ধনেরই জয়জয়কার দেখানো হয়েছে এই ছবিতে। রোজেলিন ব্রাউনের 'বিফোর অ্যান্ড আফটার' উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। নট আ ব্যাড ওয়ান আই থিঙ্ক।
Nell
কিভাবে যে রটেন টোম্যাটোজ এই ছবিটিকে মাত্র ৪৮% রেটিং দিলো বুঝি না। এত চমৎকার একটা মুভি, হয়তো খুব সরল, খুব সাদামাটা কিন্তু খুব ভালো লাগার মত, মন ছুঁয়ে যাবার মত একটা ছবি। উত্তর-পশ্চিম ক্যারোলিনার একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করে নেল নামের একটি মেয়ে (জোডি ফস্টার) যে কোনওদিন বাইরের পৃথিবী দেখেনি, প্রচলিত কোনও ভাষায় কথাও বলতে পারে না, সবসময় কেমন একটা ঘোরের জগতে, স্বপ্নের জগতে বাস করে। ডাঃ জেরি (লিয়াম) এবং ডাঃ পলার (নাতাশা রিচার্ডসন) উপর দায়িত্ব পড়ে তাকে চেষ্টা করে স্বাভাবিক পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার and that’s where the story begins ! ছবির কাহিনী-সংলাপ-নির্দেশনা সবই চমৎকার, আর সবেচেয়ে ভালো লাগবে এই ছবির লোকেশনগুলো, কি যে অদ্ভুত সুন্দর সব জায়গায় ধারণ করা হয়েছে দৃশ্যগুলো, না দেখলে বোঝা যাবে না। মজার ব্যাপার হলো, এই ছবি রিলিজ হবার ঠিক পরপরই বাস্তব জীবনে লিয়াম এবং নাতাশা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন, ২টি সন্তানের জন্ম দেন এং ১৫ বছর সুখে সংসার করেন। দুর্ভাগ্য যে, এই সুখের সংসারের ছবিটি ছিঁড়ে ছত্রখান হয়ে যায় যখন এ বছর মার্চে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে নাতাশা কানাডায় আইস স্কি করতে গিয়ে আচমকা আহত হন এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে তাঁকে মাত্র ২দিনের মাথায় সংসার-স্বামী-সন্তান ফেলে চিরনিদ্রার দেশে চলে যেতে হয়। অভিনেত্রী নাতাশাকে আমি চিনতাম না, কিন্তু এই নেল ছবিটি দেখার পর এবং ইউটিউবে তাদের অসম্ভব সুখী দাম্পত্য জীবনের কিছু ভিডিও চিত্রায়ণ দেখে আমি কিছুতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
এই সেই ব্রডওয়ে মঞ্চনাটক 'আনা ক্রিস্টি', যেখানে অভিনয়ের পর তারা অনুভব করেছিলেন যে তারা পরস্পরকে পাগলের মত ভালোবেসে ফেলেছেন।
পোস্ট অনেক লম্বা হয়ে গেছে। আশা করছি পরবর্তী পর্বে আরও ভালো কিছু ছবির (এবং আমার পাগলামির ) রিভিউ দিতে পারবো।