বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ মোহাম্মদ রফিক। দীর্ঘ ১৩ বছর বাংলাদেশ জাতীয় দলকে নিরলস সার্ভিস দেবার পরে অবসরে গেলেন সাউথ আফ্রিকার সাথে সিরিজের শেষ টেষ্ট খেলে । অবসরের প্রাক্কালে আমার নেয়া এই সাক্ষাৎকারটির মুল ইংরেজী ভার্সন একই সাথে ক্রিকইনফো এবং বাংলাক্রিকেটে প্রকাশিত হয়েছে । সাক্ষাৎকারটিতে রফিক খোলাখুলিভাবে কথা বলেছেন অবসর, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা এবং টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পর্যুদস্ত অবস্থা নিয়ে । সামহোয়্যারইনের ব্লগার বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎকারটির বাংলাতে শেয়ার করছি ।
----
পূর্ববর্তী পর্বের পর..
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছেন। এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারে নিশ্চয়ই মনে রাখার মত অনেক স্মৃতি আছে !!
মোহাম্মদ রফিক : ক্রিকেটের সাথে আমার সম্পর্কটা খুব আবেগের। খুব সাধারণ একটি পরিবার থেকে আসা এই রফিককে ক্রিকেট অনেক কিছু দিয়েছে। আজ বিশ্বের নানা দেশের মানুষ কেরানীগঞ্জের এই মানুষটাকে চেনে কেবলমাত্র ক্রিকেটের কারনেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার অনেক স্মৃতি আছে যেগুলো অবসরের পরও আমার সবসময় মনে পড়বে। আমাকে যদি ৫টি সেরা স্মৃতি বেছে নিতে বলা হয় তাহলে সবার প্রথমে থাকবে ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফি জয়ের স্মৃতিটি, কেননা এই জয়ের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এরপরেই থাকবে ২০০০ সালে অভিষেক টেস্ট খেলার স্মৃতি, ১৯৯৭ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে ৭৭ রান করে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়, ২০০৪ সালে গ্রস আইলেটে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি এবং সবশেষে ২০০৭ এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারতের বিপক্ষে জয়লাভ।
এছাড়াও বোলার হিসাবে পাকিস্তানের বিপক্ষে মুলতান টেষ্ট এবং অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টের কথা বিশেষভাবে স্মরণ থাকবে। এই দুটি টেস্টেই আমরা দুটি প্রতিষ্ঠিত টেস্ট দলের বিপক্ষে জয়ের খুব কাছাকাছি পৌছে গেছিলাম, যদিও শেষ পর্যন্ত টেষ্ট ক্রিকেটের দুই লিজেন্ডের (মুলতানে ইনজামাম উল হক এবং ফতুল্লায় রিকি পন্টিং) কাছে হার মানতে বাধ্য হই। মুলতান টেস্ট নিয়ে আমার কিছু আক্ষেপ আছে। আমাদের কয়েকটি জেনুইন আবেদন আম্পায়াররা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর যে কোন একটি আউট দিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে আমরা প্রথম টেস্ট জয় পেতাম।
আপনি বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের দলে ছিলেন আর অবসর নিচ্ছেন বাংলাদেশের ৫৩তম টেস্টে। এই দীর্ঘ সময়েও বাংলাদেশ কেন টেস্ট দল হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলো? এখনও দুটি ভাল পারফর্ম্যান্সের মধ্যে সময়ের বিশাল ব্যবধান থাকে কেন?
মোহাম্মদ রফিক : আমার মনে হয় ক্রিকেটের উন্নতির জন্য যা যা করা দরকার ছিল তা আমরা ঠিকমতো করতে পারিনি। আমাদের উন্নতির জন্য নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে শীর্ষ টেস্ট দলগুলির সাথে নিয়মিত খেলা দরকার আর সেই সাথে ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং ক্রিকেটারদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। একটা বাদ দিয়ে আরেকটাতে কোন ফল হবেনা।
এটা আসলেই লজ্জার ব্যাপার যে ৭ বছর পরেও এখনো আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটের মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। আমরা যখন ভাল খেলছিলাম তখন ১৩ মাসের টেস্ট বিরতি আমাদের ক্ষতি করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমাদের আর একটি সমস্যা হলো আম্পায়ারিং। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমরা ভুল আম্পায়ারিং এর শিকার হয়েছি যেটি আমাদের তরুণ ক্রিকেটোরদের আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠতে সাহায্য করেনি। একটি বা দুটি জয় পেলে পুরো ব্যাপারটিই পাল্টে যেতে পারতো।
এছাড়া আমাদের ক্রিকেট নীতিতেও সমস্যা আছে। আমাদের টিম ম্যানেজমেন্ট কখনোই চূড়ান্ত একাদশ নির্বাচনে পূর্ণ স্বাধীনতা পায় না। একাদশ নির্বাচনে কোচ এবং অধিনায়কের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি থাকা উচিত। টেলিফোন করে দেশের বাইরে বিভিন্ন ট্যুরে একাদশ ঠিক করে দেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। এটা কোচ এবং অধিনায়ককে তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা দিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দেয় না।
যারা কোন স্বার্থ ছাড়াই ক্রিকেটকে ভালবাসে এরকম লোকদের ক্রিকেট বোর্ডে থাকা উচিত। ক্রিকেট বোর্ড পেশাদার না হলে আমাদের টেস্ট অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সময় লাগবে।
সবাই ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলে। কিন্তু সেই অনুযায়ী অগ্রগতি নেই। আপনার কি কোন নির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে?
মোহাম্মদ রফিক : আমার প্রস্তাব খুব সহজ এবং সাধারণ। আমাদের দুটো জিনিস দরকার, কোচ এবং পর্যাপ্ত পরিমানে ইনডোর। বিদেশের কোচিং একাডেমী থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা পর্যাপ্ত পরিমান কোচ আর প্রতিটি বিভাগীয় শহরে কয়েকটি করে ইনডোর নির্মাণ করা দরকার। আমরা বৃষ্টি মৌসুমে প্রায় ৬ মাস খেলতে পারি না। এই সময়ে খেলোয়াড়রা ইনডোরে প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে পারবে। ভালো খেলোয়াড় হবার জন্য এবং ফিটনেস ধরে রাখার জন্য ১২ মাসই অনুশীলনের প্রয়োজন আছে।
আর বেশী করে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত কোচ দরকার আমাদের উঠতি ক্রিকেটারদের সঠিক বেসিক শিখাবার জন্য। এখন শীর্ষ পর্যায়ে খেলছে এমন অনেক খেলোয়াড়েরও বেসিকে সমস্যা আছে কারণ তারা খেলা শুরুর দিকে একজন ভালো প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত কোচের কাছে যাবার সুযোগ পাননি। আমাদের জনসংখ্যা অনেক বড় এবং ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আছে। এই অবস্থায় আমি মনে করি এই দুটি ব্যাপার ঠিক করা গেলে সময়ের সাথে সাথে বাদবাকি ব্যাপারগুলোও ঠিক হয়ে যাবে।
আপনি অবসরে যাচ্ছেন, খালেদ মাসুদ এর মাঝেই অবসরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, হাবিবুল বাশারও ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে। আপনারা তিনজন দীর্ঘদিন বাংলাদেশকে সার্ভিস দিয়েছেন। আপনি কি মনে করেন আপনারা তিনজন প্রায় একসাথে চলে যাবার ফলে দলে কোন শূন্যতা তৈরী হবে?
মোহাম্মদ রফিক : আমি মনে করিনা যে কোন শূন্যতা তৈরী হবে। কেউই অপরিহার্য নয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে সবাইকেই অবসরে যেতে হবে। আমাদের দলে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ আছে। এইসব তরুণদেরই বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আশরাফুল একজন পজিটিভ অধিনায়ক যদিও রান না পাবার কারণে কিছুটা চাপের মধ্যে আছে। আর যতটুকু দেখেছি তাতে সিডন্সকেও একজন ভালো কোচ মনে হয়েছে। আমি বাংলাদেশের সামনে উজ্জল ভবিষ্যত দেখি।
আপনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন প্রবাদপুরুষ। বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকেরা আপনাকে দীর্ঘ সময় মনে রাখবে। সবার শেষে এই সমর্থকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
মোহাম্মদ রফিক : বাংলাদেশের সমর্থকরা আমাকে অনেক ভালবাসা ও শ্রদ্ধা দিয়েছেন। আমি জানি না তার কতটুকু আমি পরিশোধ করতে পেরেছি। আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চাই। আমি স্বপ্ন দেখি যে আমাদের সবার চেষ্টায় বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে শীর্ষ ৫টি টেস্ট টিমের একটিতে পরিণত হবে।
আপনার সময়ের জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং বাংলাক্রিকেটের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা।
মোহাম্মদ রফিক : আপনাকেও ধন্যবাদ।
"বাংলাদেশের পক্ষে খেলতে পারাটা আমার জীবনের সেরা অর্জন" - অবসরের প্রাক্কালে নেয়া মোহাম্মদ রফিকের সাক্ষাৎকার । শেষ পর্ব
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩৫টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন
দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?
দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখস্তান.....
শেখস্তান.....
বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের বিয়ের খাওয়া
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন