সকাল থেকে রফিক সাহেবের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে অাছে, একদম চুপ মেরে অাছেন তিনি, কারো সাথেই কথা বলছেন না৷ একটি বেসরকারি ব্যাংকের জুনিয়র কর্মকর্তা তিনি৷ রাতে তাদের অফিসের ডিভিশনাল হেড হাসনাত করিম সাহেবকে নিয়ে একটি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছেন৷ স্বপ্নে তিনি দেখেন যে, হাসনাত করিম সাহেবের বুকের মাংসটা কীকরে যেন থেতলে গেছে, খেজুর গাছ থেকে যেমন করে রস বের হয় তেমন করে রক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে৷ কোনো কথা বলছেন না কিংবা চেচামেচি বা অার্তনাদও করছেন না হাসমত করিম সাহেব, শুধু কেমন করুন অার অসহায় চোখে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে অাছেন রফিক সাহেবের দিকে৷ সেই স্বপ্ন দেখে ভোর রাত চারটার দিকে রফিক সাহেবের ঘুমটা ভেঙ্গে যায়৷ এরপর অার ঘুমাতে পারেন নি তিনি৷
সদ্যই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন হাসনাত করিম সাহেব৷ চব্বিশ বছরের সুন্দরী অাধুনিকা দ্বিতীয় বউ পেয়ে উচ্চ পদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা হাসমত করিম সাহেবের বাষট্টি বছরের জোড়াতালি দেওয়া হৃদযন্ত্রটি যেন পঁচিশের স্পন্দন ফিরে পেল৷ অবসর গ্রহণ করছিলেন ষাট বছর বয়সে৷ এরপর পাঁচ বছরের জন্য নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন যা অাবারো নবায়নযোগ্য৷ কেউ বলে এটা তাঁর যোগ্যতা অাবার কেউ বলে তাঁর রয়েছে ম্যানেজ করার মতো অসাধরণ ধূর্ততা৷ সে যাই হোক নতুন বউ অার নতুন চাকরি নিয়ে হাসমত করিমের পা মাটি থেকে সব সময় এক শ' হাত উপরে থাকে এটা অফিসের সবাই জানে, বিশেষ করে অফিসে তার অধস্তন কর্মকর্তাগণ৷ শুনা যায় ব্যক্তিজীবনেও তিনি পুরাতন সব সম্পর্ক ভুলে নতুন জীবনটা যাপন করছেন, উপভোগ করছেন, নতুন করে জীবন সাজাতে করছেন নানা রকম পরিকল্পনা৷
কিন্তু তেষট্টিতে এসেই ঘটে গেল এমন এক ঘটনা যার কথা হাসমত করিম সাহেব একদম ভুৃলে গিয়েছিলেন৷ চাকরি অারও পাঁচ বছরের জন্য নবায়নের সব ব্যবস্থা শেষ করে সেদিন পার্টি দিলেন হাসমত করিম সাহেব৷ পার্টিতে ওয়েস্টার্ন পোষাক পরা যুবতি বউকে নিয়ে নাচলেন, গাইলেন এবং হালকা পানও করলেন৷ পার্টি শেষে বউ বলল, অাজ অামি ক্লান্ত, অাজ অাদর টাদর করতে পারব না; ঘুমাও৷ অাসলে হাসমত করিমের নিজেরও এনার্জি ছিল না, তারও ঘুম পাচ্ছিল খুব৷ যুবতি বউয়ের অালুলায়িত চুল অার নিরাবরণ বুকে হাত বুলাতে বুলাতে নানা বর্ণের স্বপ্ন চোখে নিয়ে তিনিও ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেই ঘুুমের মধ্যেই তাঁর জোড়াতালি দেওয়া অর্ধবিকল বেরসিক হৃদযন্ত্রটি অার কোনো রকম সেবা দিতে অস্বীকার করে বসল৷ দ্রুত তাঁকে যতক্ষণে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হল ততক্ষণে তিনি অার চিকৎসা সেবার বিষয়বস্তু নেই৷ অবশ্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের এনাটমি শাখার বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি তখনও একটা ভূমিকা রাখতে পারতেন বটে৷
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এবং পরিচালনা পর্ষদের অনেক সদস্য খবর পেয়ে সকাল হওয়ার অাগেই হাসপাতালে পৌঁছে গেল৷ ব্যাংকের ছোট কেরানী রফিক সাহেব খরটা পেলেন সকাল সাড়ে নয়টায় অফিসে পৌঁছার পর৷ সকাল এগারটায় জানাজা হবে, অফিসের সবাই জানাজায় অংশগ্রহণ করতে বের হয়ে যাচ্ছে৷ সবার সাথে রফিক সাহেবও গেলেন৷ জানাজা শেষে সবাইকে শেষ দর্শনের সুযোগ দেওয়া হল৷ লাইন ধরে লোকেরা একদিক থেকে এসে স্টেইনলেস স্টিলের খাটিয়ায় শোয়ানো হাসমত করিম সাহেবের মুখটা দেখে অারেক দিক দিয়ে চলে যাচ্ছিল৷
অাস্তে অাস্তে রফিক সাহেবও এগিয়ে গেলেন শেষবারের মতো হাসমত করিম সাহেবের মুখটা দেখতে; মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং বন্ধ চোখ দু'টির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ৷ লাশের সাথে এসময় কেউ কথা বলে না, কারণ মৃত মানুষ তো অার কথার উত্তর দিতে পারে না৷ উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করল, রফিক সাহেব ভাবলেশহীন কণ্ঠে তার সাবেক বসকে জিজ্ঞস করছে, স্যার! এবার যখন অামার প্রমোশনটা অাটকে দিয়েছিলেন তখন বলেছিলেন, অাগামি এসিঅারে জিরো নম্বর দিয়ে অামার পুরো চাকরিটাই খেয়ে ফেলবেন৷ অাগামি এসিঅার তো অারও অাট মাস পর হবে৷ অামার চাকরিটা না খেয়েই চলে গেলেন স্যার!