somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তনিমা বাসে চড়ে হাঁটতে হাঁটতে গুলশান যায়

২৭ শে মে, ২০১৬ রাত ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল আটটা বাজে। এর মধ্যেই জৈষ্ঠের গনগনে রোদ্দুরে বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দিনটা। মিরপুর রোডে সিটি কলেজের পাশের বাসস্টান্ডটায় এসে দাঁড়ায় তনিমা। একটা পাবলিক বাস এলো একটু পরই। বাসটা স্টান্ডে এসেও একেবারে দাঁড়িয়ে গেল না; বরঞ্চ গতি একদম কমিয়ে ধীরে ধীরে এগোতেই থাকল। কিছু মানুষ নেমে গেল এই অবস্থায়ই। একজন তো ডান পা আগে দিয়ে নামতে গিয়ে পড়িমরি করে কোনো মতে সামলে নিল। যদিও হেলপার বারেবারে বলছিল, ‘বাম পাও দিয়া নামেন।’

যাদের নামার নেমে যাবার পরই হুরমুর করে উঠতে শুরু করল মানুষজন। তনিমাও দৌড়ে গিয়ে ডান পায়ের সামনের অর্ধেকটা বাসের দরজার ধাতব পাটাতনে রাখল আর ডান হাত দিয়ে শক্তকরে বাসটির দরজার পাশের হ্যান্ডেলটা ধরে ফেলল। বাম হাতে তার ব্যাগটা। তারপর দরজায় জটলা করে থাকা কিছু মানুষের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল এবং কোনো মতে ভেতরের অনেকগুলো শরীরের মধ্যে নিজের শরীরটাকে ঠেলে সেঁধিয়ে দিল, পেছন থেকে যদিও হেলপার চেচাচ্ছিল-‘মহিলা সিট নাই, আপা উইঠেন না’। কিন্তু এখানে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো বাসে সিট পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। তাই যত কষ্টই হোক কোনোকিছুকে পাত্তা না দিয়ে সে উঠে যায় বাসে এবং ড্রাইভারের পেছনের আসনগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এই সিটগুলো নারী এবং প্রতিবন্ধিদের জন্য মার্কা মেরে রাখা হয়েছে৷ কপাল জোরে মিনিট পনের পরেই একটা মহিলা আসন খালি হয়। সে বসতে যাবে তার আগেই একজন পুরুষ সুকৌশলে শরীর বাঁকিয়ে দখল নিল সেই সিটের এবং আগে থেকেই বসা দুই পাশের দুই মহিলার নিতম্বের মাঝখানে ঠেলে নিজের নিতম্বখানা ঢুকিয়ে বসার জায়গাটা করে নিল৷ কন্ডাক্টর একবার বলল, ‘মামা মহিলা সিট ছাড়েন।’ কিন্তু তাতে কোনো ভাবান্তর নেই সেই লোকের; বরঞ্চ একটা চালাক চালাক ভাব নিয়ে তনিমার দিকে তাকায়। তনিমা দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুড়িয়ে নেয়। কন্ডাক্টর আবারও বলে, মামা মহিলা বসতে দেন। লোকটা উত্তর দেয়, ‘পুরুষ সিটে অনেক মহিলা বইসা আছে। তারা উইঠা গেলে আমিও মহিলা সিট ছাইড়া দিমু।’

এরপর কেউ এনিয়ে আর কোনো কথা বলল না; বরং ঢাকার পাবলিক বাসে প্রতিনিয়ত যা যা ঘটে সেসব নিয়েই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে ৷ যাত্রীদের কেউ কেউ ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টরের সাথে খেচখেচানি শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ ভাড়া দেওয়ার পর আবার ভাড়া চাওয়ার জন্য কন্ডাক্টরকে প্যাঁদানি দিতে চায়। কন্ডাক্টর সেসব গায়ে মাখে না। সে যাত্রীদের ঠেলে ঠেলে আরও জায়গা করতে চায়- তার আরও যাত্রী উঠানো দরকার, রাস্তায় অনেক যাত্রী আছে; আরও জায়গা খালি করতে তাই মরিয়া সে।

এসবকিছু তার পেটের মধ্যে নিয়ে বাসটি যানজট ঠেলে আস্তে আস্তে চলছিল৷ কিন্তু মহাখালি অাসার পর গাড়ি অার চলে না৷ এখানের তীব্র জ্যামে আটকে যায় বাসটি। তারপর সময় যেতে থাকে কিন্তু বাসটি সামনে যায় না৷ কতক্ষণ অাটকে অাছে সেটা জানতে চায় না তনিমা; তাই সে ঘড়ির দিকে তাকায় না। কারণ তাতে অফিসে সময় মতো পৌঁছতে পারবে কি পারবে না সেই টেনশন বেড়ে যায়। তাই ঘরি না দেখে মনোযোগটা অন্যত্র সরিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে সে। কেউ কেউ কন্ডাক্টরকে খুঁজছে। ভাড়াটা ফেরত নিয়ে হেঁটেই চলে যাবে। কিন্তু কন্ডাক্টর কোথায় লাপাত্তা। ড্রাইভার তার সিটে বসে দেয়াশলাইয়ের কাঠির এক মাথা দিয়ে গভীর মনোযোগসহকারে দাঁত খোঁচাচ্ছে, আবার আরেক মাথা দিয়ে কান চুলকাচ্ছে, আর থেমে থেমে সিগারেটে লম্বা করে টান দিচ্ছে। বাসের একমাত্র ফ্যানটা তার মাথার ওপর ঘুরছে। এদিকে প্রচন্ড গরমে যদিও যাত্রীরা ঘেমেনেয়ে একাকার বাসের ভেতরে আর কোনো কোনো ফ্যান নেই। আর সিটগুলি এমন নোংড়া যে তাকালে বমি আসে।

তনিমা বুঝতে পারে আশপাশে কয়েকজোড়া চোখ তার দিকে স্থির হয়ে আছে। শরীরের সাথে ঘেষে দাঁড়ানো মানুষগুলোর গা থেকে বের হচ্ছে উৎকট দুর্গন্ধ, যতই সে প্রাণপণে মনোযােগটা অন্যত্র সরিয়ে রাখতে চায় কিন্তু পারে না। গন্ধটা নাকে আসেই। গরমে ঘেমেনেয়ে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা কাপড়চোপড় যেন তাকে চেপে ধরে দম বন্ধ করে দিতে চায়। এই গরমে পাবলিক বাসে কোনো ফ্যান কেন থাকবে না সেটা তার বুঝে আসে না।

চাকরিটা তনিমা নতুন নিয়েছে৷ মাত্র তিন মাস হয়৷ বিবিএ পড়ার সময় বাবার ইচ্ছায় ক্রেডিট ট্রান্সফার করে ইউএসএ চলে গিয়েছিল। সেখানেই বিবিএ শেষ করে এমবিএ করল ফিন্যান্স এবং ইন্টান্যাশনাল বিজনেসে। তারপর একটা স্কলারশীপ পেয়ে যাওয়ায় ইকোনোমিক্সে একটা পোস্টগ্রাজুয়েট ডিপ্লোমাও করে। আমেরিকাতে ভাল একটা চাকরী যোগাড় করে নিতে পারত সে; অনেকেই যেটা করে। তনিমার ব্যাংকার বাবারও সেরকমই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তনিমার ইচ্ছা সে দেশে চলে আসবে এবং ব্যবসা করবে। তাই সে দেশে চলে আসে।

তনিমা যখন দেশে চলে আসল তখন তার বাবা সিটি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইফতেখার আলমেরও অবসরের সময় হয়ে আসে। বাবা বললেন ব্যবসা করবি ঠিক আছে; সবকিছু গুছিয়ে নিতে কিছু সময় লাগবে। এখন আমার অফিসে জয়েন কর। এখানে কিছুদিন চাকরি করলে অনেক কিছু জানতে পারবি। ব্যবসা করতে হলে সেই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে৷ আমি অবসরে যাচ্ছি। ম্যানেজম্যান্টকে বলে তোকে সেখানে একটা চাকরি নিয়ে দেওয়া যাবে। এভাবেই বাবার ইচ্ছা এবং চেষ্টায় সিটি ব্যাংকে তার চাকরিটা হয়ে যায়। অফিসটা গুলশানে। জিগাতলার বাসা থেকে প্রতিদিন বাসেই যাতায়াত করে।

পথ তো ফুরায়-ই। অবশেষে তনিমার এই পথটুকুও ফুরায়; বাসটি গুলশান এসে পৌঁছায়। প্রথম দিন গুগল ম্যাপে চেক করেছিল তনিমা- হেঁটে গেলে এক ঘন্টা বাইশ মিনিট লাগবে। আর গাড়িতে গেলে তেইশ থেকে সাতাশ মিনিট। সেই পাঁচ ছয় কিলোমিটারের দূরত্ব বাসটি অতিক্রম করল আড়াই ঘন্টায়। এই অাড়াই ঘন্টায় এক মিনিটও বাসটি টানা চলে নি৷ এক ভদ্রমহিলা শুক্রাবাদ থেকে বসুন্ধরা সিটি পর্যন্ত একটি বাচ্চার হাত ধরে হেঁটে হেঁটে চলে অাসে৷ তনিমা জানালা দিয়ে দেখছিল- একবার বাসটি অাগে চলে যায় অাবার ভদ্রমহিলা বাসের অাগে চলে যান৷ তনিমার মনে হল "ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল" ধরনের ব্যাপার হচ্ছে, সে বাসে চড়ে হেঁটে হেঁটেই যাচ্ছে৷ বাসে না এসে হেঁটে চলে অাসলে কতক্ষণ লাগত কে জানে? কে জানে? ভাবে তনিমা৷
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৮:৩১
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×