বেশ কয়েক বছর অাগের কথা৷ সময়টা ছিল পৌষ মাস। দুই দিন ধরে আবার তীব্র শৈত্য প্রবাহ চলছিল। কনকনে ঠান্ডায় হাত পা জমে যাওয়ার যোগাড়। এরই মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ঢাকার সায়দাবাদ বাস স্টেশন এলাকার একটি রাস্তার ফুটপাতে যেখানটায় রাস্তার পাশে রয়েছে সারি সারি বাস কাউন্টার। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় নানান কোম্পানির বাস। আমার গন্তব্য ফেনী। আশপাশে আরও আর অনেক মানুষ আছেন। তারা কে কোথায় যাবেন কে জানে। বলা যায় বিশাল এক জনারণ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমি একা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই।
ঘন কুয়াশায় খোলা আকাশের নিচে কনকনে শীতে শরীর গরম করার জন্য লোকজন সিগারেট খাচ্ছে অনবরত। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধে আমার মাথা ধরে গেছে। বমি বমি লাগছে। কিন্তু ধোঁয়া থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। যেখানেই গিয়েই দাঁড়াই সেখানেই কেউ না কেউ সিগারেট ফুঁকছে। একটা চায়ের দোকান দেখে এককাপ চায়ের কথা বললাম। এসময় এরা খেজুরে গুড় আর কৌটার দুধ দিয়ে এক ধরনের চা বানায়। চা-টা ভালো হয়েছে তবে ঠান্ডা হয়ে গেছে। এক কাপ চায়ে এক চামচ ঠান্ডা গুড় দিলে সেই চা আর গরম থাকার কোনো কারণ নেই।
এরই মধ্যে ঘন অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে শীতের রাতের প্রথম প্রহরটা। আর আমাকে প্রাস করল কী এক বিষণœতা! মনটা পূর্ণ হয়ে গেছে কী এক বিষাদে। আমার ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। মনটা যেন তখন কিসের জন্য হাহাকার করতে থাকে। আজও এমন হচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আবার কেমন জানি এক ধরনের অপরাধবোধ মনের মধ্যে কাজ করছে। মনে হচ্ছে এই জগৎ সংসারের প্রতি আমি অনেক অন্যায় করেছি। কী অন্যায় করেছি জানি না।
আমার এক সিনিয়র কলিগ আছেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার। কিন্তু কখনও চেম্বার নিয়ে বসেন নি বা প্রাকটিস করেন নি। তবে হোমিওপ্যাথি নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা আছে। তিনি যখন চাকরি থেকে অবসর নিবেন তখন হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস শুরু করবেন। এখন প্রাকটিস না করলেও তার কাছে কেউ কোনো রোগের কথা বললে ছোাট্ট একটা কাগজে ওষুধ লিখে দেন। এর জন্য তাকে কোনো ফি দিতে হয় না। বরঞ্চ এই ফ্রি প্রাকটিসে তার বেশ উৎসাহ লক্ষ করা যায়। উদ্দেশ্য হল বিদ্যাটার চর্চা অব্যাহত রাখা যাতে যতদিনে অবসর ততদিনে বিদ্যাটা ভুলে না যান। আমার অফিসটা আমাদের ব্যাংকের আঞ্চলিক অফিস। অফিসের বড় বড় বসরা মাঝে মাঝেই পরিদর্শনে আসেন। বড় বসদেরও অনেককে দেখেছি তার কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র লেখিয়ে নেন। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী পাইকারী হোমিও ওষুধের দোকান থেকে অনেক কম দামে ওষুধ কিনতে পাওয়া যায়। তো তার কাছে আমার সমস্যার কথা বলি একদিন। তিনি বললেন ‘এটা একটা মানসিক ব্যাধি’। ছোট্ট একটা টুকরা কাগজে কিছু ওষুধও লিখে দিয়েছিলেন। খাওয়া হয় নি যদিও। আমার কাছে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আর ফকীরের ফু দেওয়া পানি খাওয়া একই মনে হয়।
সকালেই ঢাকা এসেছিলাম একটা জরুরি কাজে। আমার ধারণাই ছিল না যে এমন একটা বিপদে পড়তে পারি। সেই বিকেল থেকে এখানে অপেক্ষা করছি। কিন্তু কোন বাসই এখান থেকে ছেড়ে যাচ্ছে না। প্রথমে একটা আশা সবার মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন সবাই নিশ্চিত যে আজ আর বাস ছাড়বে না। আর ঢাকায় আমার এমন কোনো নিকটাত্মীয়ের বাসাও নেই যেখানে গিয়ে উঠতে পারি। আর যে কারণে বাস চলছে না ঠিক একই কারণে হোটেলগুলোও কোন বোর্ডার নিতে পারছে না। তাই কোনো হোটেলে যে উঠব তারও উপায় নেই।
এতসব কিছুর কারণ হল রিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো পরের দিন “চল চল ঢাকা চল” নামে এটি কর্মসূচি দিয়েছে। আর সেই কর্মসূচিকে প্রতিরোধ করতে সরকার তার সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। মানুষ যাতে ঢাকায় আসতে না পারে তার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল করে দেয়া হয়েছে। বাস, রেল, লঞ্চ কেনো কিছুই চলছে না। মানুষ যাতে আগে থেকে ঢাকায় এসে থাকতে না পারে তার জন্য ঢাকার হোটেলগুলো যাতে কোন বোর্ডার না নিতে পারে সে জন্য যা যা করা দরকার করে রেখেছে সরকার এবং সরকার দলীয় লোকজন। এলাকার আইন প্রণেতাকে দেখা গেল বেশ ব্যস্ত। সবকিছু তদারকী করছে বিপুল বিক্রমে। ক অক্ষর গো মাংস এই মানুষটি তার অপকর্মের জন্য সারা দেশে বেশ পরিচিত। তাকে দেখলেই বুঝা যায় গডফাদার, ইয়াবা ব্যবসায়ী আর দাগী সন্ত্রাসী কারোরই এই ব-দ্বীপের আইনপ্রণেতা হতে অসুবিধা নেই।
কী করব ভেবে ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। এদিকে ঠান্ডার সাথে ঘন কুয়াশা যেন আস্তে আস্তে বাড়ছিল। পর্যাপ্ত শীতের কাপড়ও সাথে ছিল না। সিগারেটের ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য হাঁটতে হাঁটতে সায়দাবাদ থেকে মানিক নগরের দিকে অনেক দূর চলে এলাম। একটি চায়ের দোকান দেখে আর এক কাপ চায়ের কথা বললাম। এসময় একটি লোককে দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে কথা বলছে আর শীতে হি হি করে কাঁপছে। লোকটির পরনে ময়লা ট্রাউজার আর জ্যাকেট। লম্বা চুল দাড়িতে জট ধরেছে। চা খেতে খেতে লোকটিকে দেখছিলাম। নির্ঘাত রাস্তার পাগল। একটি কুকুর দেখলাম লোকটির সামনে কুৎ কুৎ আওয়াজ করছে আর মাঝে মাঝে লোকটির গা ঘেষছে। মনে হয় ক্ষিধে পেয়েছে। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে লোকটি বলে উঠল, ‘ঐ বেটা কুত্তা গেলি না। তুইও তো দেখি শালা মানুষের মতো শুরু করলি।’
এটা কী বলল লোকটা! কুকুরটাও নাকি মানুষের মতো শুরু করেছে। ঘণ কুয়শার হিম শীতল রাত্রিতে স্ট্রীট লাইটের নিয়ন আলো কেমন মায়ময় পরিবেশ তৈরী করেছে। পরিবেশের কারণেই কিনা জানি না, কুকুরকে করা পাগলের সেই হেঁয়ালিপূর্ণ প্রশ্নটি আমার মাথায় গেঁথে গেল। আমি ভাবছিলাম কেন মানুষের প্রতি তার এতো রাগ! কে জানে, মানুষের কাছ থেকে পাওয়া বড় কোনো দুঃখই হয়ত তাকে পাগল বানিয়েছে! চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে গেলাম লোকটার দিকে।
এদিকটায় মানুষজন তেমন একটা নেই। একেতো কনকনে ঠান্ডা তার উপর আবার উত্যপ্ত পরিস্থিতি। একটা দুইটা রিকসা টুং টাং শব্দ করে চলে যাচ্ছে। ‘চা খাবেন?’ জিজ্ঞেস করলাম লোকটিকে। প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে আছে মধ্য বয়সের পাগল মানুষটি। মনে হয় খাবে, যদিও মুখে কিছু বলছে না। একটি বন রুটি, দু'টি কলা আর চা নিয়ে দিলাম লোকটির হাতে। বনটি দুই ভাগ করে অর্ধেক নিজে খেল আর বাকি অর্ধেক কুকুরটিকে দিয়ে দিল। আমি আরেকটি বন দিলাম। এটিও দুই ভাগ করে অর্ধেক নিজে খেল আর বাকি অর্ধেক কুকুরটিকে দিয়ে দিল। কলা দুটি নিজেই খেল। কে জানে কুকুর হয়ত কলা খায় না। কুকুরের হয়ত ভিটামিনের দরকার হয় না। রুটি কলা খাওয়া শেষ হলে হাতে থাকা পানির বোতলটি এগিয়ে দিলাম লোকটির দিকে। সবটুকু পানি খেয়ে বোতলটি ফেলে দিল। তারপর চা’টা খেল বেশ আরাম করে।
কাপ হাতে নিয়ে বিল দিতে গেলাম। চা ওয়ালা জিজ্ঞেস করে ‘ভাইজান কি বাস ধরতে আসছিলেন? বাড়ি কই ভাইজানের?’
‘বাড়ি তো ভাইয়া ফেনী। ফেনী শহরেই একটা ব্যাংকে কাজ করি। বাস না পাইয়া তো ভাইয়া বিপদে পড়ে গেলাম। কাল তো অফিস আছে’-আমি উত্তর দিলাম।
‘আরে আমার বাড়িও তো ফেনী। ফেনীর ছাগল নাইয়া থানা।’ বলল লোকটি। তারপর বলল, ‘ভাইয়া এক কাজ করেন, বিশ্বরোড জনপথ মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান। দেখবেন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাস তো চলবে না। তবে এ্যাম্বুল্যান্স, মাইক্রো, কিংবা পিকআপ কিছু একটা পেয়েও যেতে পারেন।’
চা দোকানদারের কথামত জনপথ মোড়ে দাঁড়িয়ে এসে দাঁড়িয়েছি। আস্তে আস্তে বাসের কাউন্টারগুলো সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আজ এবং কালও কোনো বাস ছাড়তে নিষেধ করা আছে তাই অপ্রত্যাশিত ছুটি পেয়ে কর্মচারিরা উৎসবের আমেজে আছে। রাত বাড়তে থাকায় এখন লোকজনও কমে এসেছে। ফলে সিগারেটের গন্ধও আর নেই। একদল টোকাই দেখলাম আগুন জ্বালিয়ে ঘিরে বসেছে। আমিও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ ওম পাচ্ছি।
টোকাইদের সাথে আগুন পোহাতে পোহাতে ভাবছিলাম পাগলের কথাগুলো। আসলে কথাগুলো মাথা থেকে যাচ্ছিল না। এটা কেবলই পাগলের প্রলাপ বলে যতই মাথা থেকে তাড়াতে চাই ততই যেন শীতের মতোই জেঁকে বসে মাথার ভেতর। মাথার ভেতর কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকে, ‘ঐ বেটা কুত্তা গেলি না। তুইও তো দেখি শালা মানুষের মত শুরু করলি।’ হয়ত পরিবেশটাই এমন যে কিছুতেই কথাগুলি তাড়াতে পারলাম না মাথা থেকে। বরঞ্চ কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথায় ঢুকল আরেকটি চিন্তা-‘আসলে পাগল কারা? সেই লোকটি, নাকি আমরা, যারা এই শীতের অন্ধকার রাতে রাস্তায় আগুন পোহাচ্ছি, নাকি....নাকি এই অন্ধকার নগরীর পিতাগণ?