ইরাক যখন কুয়েত দখল করে তখন আমি ছোট। স্কুলে পড়ি। কিন্তু আমার মনে আছে, কুয়েতে সামরিক হামলা চালানোর পর ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন রাতারাতি সাধারণ বাংলাদেশীদের কাছে মহান নেতা হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে সাদ্দাম কুয়েত দখল করার পর যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে গালফ উপসাগরের যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত নিল, তখন বাংলাদেশের আবেগী জনগনের কাছে সাদ্দাম হয়ে উঠলেন এক মুসলিম বীর। কুয়েতও যে মুসলিমদের দেশ, তা মানুষ আমেরিকার কারণে ভুলে গেল। কেউ কেউ বলা শুরু করলো, সাদ্দাম কুয়েত দখল করে ভালো করেছে। কারণ কুয়েতের লোকরা নাকি ভালো না। তারা নাকি টাকা পয়সা নিয়ে আমোদ-ফূর্তি করে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে আমার আশেপাশের লোকজনের কাছে ইরাক ও সাদ্দাম হোসেনকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আবেগের কমতি ছিল না। অনেকেই সাদ্দামের নামে ছেলের নাম রাখা শুরু করে দিল।
আমেরিকা উপসাগরীয় যুদ্ধে যোগ দেয়ায়, হঠাৎ করে দেখলাম কেরোসিনসহ অনেক কিছুর দাম বেড়ে গেল। আর বেড়ে গেল রেডিওতে খবর শোনা। রেডিওতে শুনতাম, সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে-এটা হয়েছে, সেটা হয়েছে। তবে সিএনএন কি, আমি তা তখন জানতাম না। উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাক হেরে গিয়ে কুয়েত ছেড়ে দেয়। তার দু’বছর পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে দু’ঘন্টা করে সংবাদ সম্প্রচার শুরু করে সিএনএন। ততদিনে আমাদের বৈঠক খানায় টেলিভিশন চলে এসেছে। আমি বেশ নিয়মিতভাবে সিএনএন এর দর্শক হয়ে যাই। আমার কানে ভাসতো—ইউ আর ওয়াচিং সিএনএন ফ্রম আটলান্টা, ইউনাইটেড স্টেটস। মাঝে মাঝে আটলান্টার উচু উচু ভবন গুলো দেখা যেত। অজান্তেই মনে লালন করতাম, আহা, যদি একবার যেতে পারতাম। অবশেষে সেই ইচ্ছে পুরণ হলো ২৬ বছর পর।
কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধুর সাথে আমেরিকার জর্জিয়া রাজ্যের রাজধানী আটলান্টা সিটি দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের গাড়ি যখন আটলান্টার শহরতলিতে প্রবেশ করেছিল, তখন আমি সিএনএন সদর দপ্তরের চূড়ায় পরিচিত নিয়ন সাইন দেখতে পেলাম। মেরিয়েটা স্ট্রিট এবং অলিম্পিক পার্ক রোডের সংযোগস্থল এবং সেঞ্চুরি অলিম্পিক পার্কের উল্টোদিকে (১৯৯৮ সালে এখানে সামার অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়, সেসময় পার্কটি নির্মান করা হয়) সিএনএস ভবন।
আটলান্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একটি বড় শহর। ডাউনটাউন তাই ব্যস্ত। আমেরিকানদের গাড়ির অভাব নেই। তাই সুযোগ মতো এবং কম খরচে গাড়ীর পার্কিং পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। একটু ঘুরতেই অলিম্পিক পার্কের কাছেই আমরা পার্কিং পেয়ে গেলাম। এরপর কোকাকোলা’র হেড অফিস আর যাদুঘর ঘুরে হেঁটে হেটে পৌঁছে গেলাম সিএনএন সদর দপ্তরে।
সিএনএন সেন্টারে ঢোকার মুখেই সিএনএন লেখা বড় একটি সাইনবোর্ড। অনেকেই দেখলাম সেখানে ছবি তুলছে। কিন্তু সাইনবোর্ডটি ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। একের পর এক লোক আসছে আর ছবি তুলছে। আমি খুব কষ্টে, লোকজনকে অনুরোধ করে ফাঁকা করে একটা ছবি তুললাম। (এই ছবিটাই উপরে দেয়া হয়েছে)
সিএনএন এর এই অফিসটাকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিউজ স্টেশন। এটি আকারে বিশাল। চারটি ১৫ তলা ভবন চারদিক থেকে মিলে চক্রাকার শেপ দিয়েছে, আর মাঝখানে রয়েছে একটি বিশাল খোলা জায়গা। সেখানে হাঁটার পথ, ফুড কোর্ট ছাড়াও রয়েছে, বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। পর্যটকদের জন্য সেখানে অনেকগুলো খাবারের দোকান। প্রতিদিন কয়েক’শ পর্যটক সিএনএন সেন্টার দেখতে আসে। তবে আপনি যদি তাদের নতুন স্টুডিও এলাকা ঘুরে দেখতে চান, তাহলে আপনাকে টিকিট কিনতে হবে। বিভিন্ন ধরণের ট্যুর টিকিট রয়েছে। সবচেয়ে কম টিকেটের দাম ১৫ ডলার। যেটাকে স্টুডিও ট্যুর বলে।
টিকেট কাটার পর সিরিয়াল ধরে ২০ জন করে গ্রুপ করে স্টুডিও ট্যুর করানো হয়। একজন পেশাদার গাইড থাকেন। তিনি সিএনএন এর যোগাযোগ বিভাগের কর্মী। তিনি পুরো স্টেশনটি ঘুরে দেখানোর পাশাপাশি কিভাবে বিভিন্ন যন্ত্র ও স্ক্রিন কাজ করে তার বর্ণনা দেন। সিএনএন একটি একক নিউজ চ্যানেল। এটি ছাড়াও এই ভবন থেকে কার্টুন নেটওয়াকসহ দশটিরও বেশি চ্যানেল সম্প্রচার করা হয়। সিএনএন এর মালিক টেড টার্নার ১৯৮০ সালে এখানে সিএনএন প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে একসময় একটি বাস্কেটবল স্টেডিয়াম ও টার্নার গ্রুপের ওমনি হোটেল ছিল। পরে স্টেডিয়াম ভেঙ্গে সিএনএন ভবন তৈরি করা হয়। এই দপ্তরে প্রায় চার হাজার সাংবাদিক ও কর্মী কাজ করেন। ভবনে ঢোকার পর মনে মনে ক্রিস্টিন আমানপোর, এন্ডারসন কুপার, রিচার্ড কোয়েস্ট বা ফরিদ জাকারিয়াকে খুঁজতে ছিলাম। পাইলে বলতাম, ভাইরে, আপারে, আপনাদের দেখে দেখে চোখ নষ্ট করেছি। বলা বাহুল্য, গাইড আপা ছাড়া সিএনএনের আর কারো সাথে আমার দেখা হয়নি।
আসলে এই অফিস থেকে আপনি সাংবাদিকদের দৌড়াদৌড়ি দেখতে পাবেন না। কারণ সারা আমেরিকার বড় শহরগুলোতে সিএনএন এর অফিস আছে। আটটি শহরে বড় অফিস এবং স্টুডিও আছে, যেখান থেকে সংবাদ তৈরি করে এখানে পাঠানো হয়। আমেরিকার বাইরে লন্ডন, আবুধাবি ও হংকং-এ সিএনএনের স্টুডিও আছে। বিশ্বজুড়ে আরো আছে ৩৬টি ব্যুরো অফিস। নয়াদিল্লি, ইসলামাবাদ ও ব্যাংককে সিএনএন ব্যুরো অফিস আছে।
সিএনএনের গাইড জানান, আটলান্টা ছাড়াও, ডেনভার, নিউইয়র্ক, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলেস, সানফ্রান্সিসকো, ডালাস, মিয়ামি এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে তাদের স্টুডিও থেকে সরাসরি সংবাদ প্রচারিত হয়। এই শহরগুলো থেকে দরকার হলে হেলিকপ্টারে করে সংবাদ কভার করা হয়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যকে সিএনএন খুব গুরুত্ব দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের জেরুজালেম, আবুধাবি, দুবাই, আম্মান, বৈরুত এবং কায়রোতে তাদের অফিস রয়েছে। এখন ২০০টিরও বেশি দেশ এবং অঞ্চলের হাজার হাজার স্থানীয় টেলিভিশন স্টেশনগুলির সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সংবাদ কাভার ও ফুটেজ বিনিময় করে সিএনএন।
সিএনএন ট্যুর গাইড তাদের স্টুডিও’র ম্যাজিক্যাল ওয়াল দেখালেন। এটিতে অনেকগুলি ইলেকট্রনিক ব্যাকড্রপ রয়েছে। নিউজ উপস্থাপক দরকার মতো এই ব্যাকড্রপ এবং কম্পিউটারের স্ক্রিন পরিবর্তন করতে পারেন। তারমানে হচ্ছে খবর পাঠক একটা বোতামে চাপ দিলেও পেছনের স্ত্রিন বদলে যায়। তিনি চেয়ার থেকে নেমে ম্যাজিক্যাল স্ত্রিনের যে কোন যায়গায় টাচ করে ম্যাপ ছোট বড় করে, ছবি বিশ্লেষণ বা ভিডিও প্লে করতে পারেন। স্টুডিও দেখার পরে যে কেউ প্রথম তলায় এসে খোলা জায়গায় সুস্বাদু খাবার উপভোগ করতে পারেন। ‘সিএনএন স্টোর’ নামে বিশাল একটি স্যুভেনির শপ আছে, হাজার রকম সুভ্যেনির পাওয়া যায় সেখানে। সিএনএন সেন্টারে আপনার এই ভ্রমণ মনে রাখতে সিএনএন লেখা বা এমব্রয়ডারি করা টি-শার্ট, ক্যাপ বা মগ কিনতে পারেন। আমি সিএনএন লেখা একটি ক্যাপ কিনলাম ১৬ ডলার দিয়ে। আপনি ভবনের যে কোনও জায়গায় ছবি তুলতে পারেন, কোন বাধা নেই। কারণ, আপনি ছবি তোলা মানেই ওদের প্রচার। একজন দর্শনার্থী ওদের প্রচারের অংশ।
আমি দু ঘন্টার মতো ছিলাম ভবনটিতে। প্রথম স্টুডিওটি এখন জাদুঘরের অংশ। সেখানে বেশকিছু ছবি তুললাম। যখন সিএনএন সেন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এলাম, তখন বাইরে তুষারপাতের মতো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, তাপমাত্রা নেমে এসেছিল শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এত কাছ থেকে এত বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠান -- সিএনএন দেখা এতই রোমাঞ্চকর ছিল, আমি প্রথম কয়েক মিনিট শীতের তীব্রতা বুঝতেই পারিনি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:১৮