নরওয়ের অজলোতে আমার মোবাইলে তোলা কিছু ছবি। ছবি তোলার ব্যাপারে আমার ধারণা একেবারেই কম, কিন্তু আজ প্রথম বুঝতে পারলাম, ছবি যারা তোলেন, তাদের ভেতর এ নিয়ে কী অসম্ভব আবেগ কাজ করতে পারে। দুয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি ক্যামেরা কেনার পরিকল্পনা আছে, ক্যামেরা ও ছবি তোলার ব্যাপারে অভিজ্ঞদের মতামত পেলে খুব খুশি হব।
শহরকেন্দ্রের ঠিক কাছেই নরওয়ের জাতীয় নাট্যশালা। বাস থেকে নেমে একটু ঘুরে সামনে গিয়ে ছবি তুললাম, রাগী চেহারার এক ভদ্রলোক হঠাৎ ডানদিক দিয়ে ফ্রেমের ভেতর ঢুকে পড়লেন।
ভদ্রলোকের একক ছবি তোলার জন্য তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, নেমপ্লেটে বর্নস্টার্ন বিয়র্নসন (Bjørnstjerne Bjornson) লেখা দেখেও কিছু স্মরণ করতে পারলাম না। পরে অবশ্য তাঁর পরিচয় জেনে অভিভূত হয়েছি: নরওয়ের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা এবং ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী।
বিয়র্নসনের উল্টোপাশে শ্মশ্রুমণ্ডিত শান্ত সমাহিত, কিছুটা চিন্তামগ্ন, আরেকজন মানুষ; দু হাত পেছনে রেখে হেঁটে যাচ্ছেন আপনমনে, প্রথম দেখায় বাগদাদের বাজারে হেঁটে যাওয়া আরব্যরজনীর কোনো চরিত্র মনে হয়। নাম দেখে এঁকে সহজেই চিনে ফেললাম, ভূবনবিখ্যাত নাট্যকার, আধুনিক নাট্যতত্ত্বের জনক, হেনরিক ইবসেন (Henrik Ibsen, ১৮২৮–১৯০৬)। তাঁর A Doll’s House আমাদের বেইলিরোডে নিয়মিত অভিনীত হয়।
ইবসেনকে ছাড়িয়ে সামনে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছেন হেনরিক ভার্গেল্যান্ড (Henrik Wergeland, ১৮০৮–১৮৪৫), নরওয়ের জাতীয় কবি— আমাদের ঝাঁকড়া চুলের নজরুলের সাথে বেশ মিল তাঁর। বিদ্রোহ করেছেন নরওয়ের উপর সুইডিশ শাসনের বিরুদ্ধে, দিয়েছেন জ্বালাময়ী বক্তৃতা, লিখেছেন আগুনঝরা কবিতা। সুইডিশ-শাসনের পূর্বে ডেনমার্কের অধীনে প্রায় ৪০০ বছর কাটে নরওয়ের, ফলে ভাইকিংদের কাছ থেকে পাওয়া প্রাচীন নর্স মাতৃভাষাটি হারিয়ে ফেলে নরওয়ে, ডেনিশ থেকে উদ্ভূত বুকমল (bokmål) বা "বইয়ের ভাষা" হয়ে উঠে শিক্ষিত শ্রেণীর ভাষা। ভার্গেল্যান্ড সংগ্রাম চালিয়ে যান নরওয়ের গণমানুষের আঞ্চলিক কথ্যভাষাগুলোর একটি প্রমিত লিখিতরূপ প্রতিষ্ঠা করতে। আর এ কারণেই নরওয়েতে বর্তমানে দুটি রাষ্ট্রীয় ভাষা চালু রয়েছে, একটি ডেনিশউদ্ভূত বুকমল এবং অন্যটি প্রাচীন নর্স প্রভাবে সৃষ্ট আঞ্চলিক ভাষাগুলোর প্রমিতরূপ, নেনর্সক (Nynorsk) বা "নতুন নরওয়েজিয়ান"। বুকমল ও নেনর্সক সমর্থকদের মধ্যে গত দু'শ বছর ধরেই চলে আসছে সুতীব্র দ্বন্দ্ব, যা এখনও প্রতিনিয়ত নরওয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে যায়।
ভার্গেল্যান্ডের বাড়ানো হাতের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে নরওয়ের সংসদভবন (Stortinget), আমাদের সংসদ ভবনের তুলনায় বেশ ছোট আকারের; ১৬ কোটি মানুষের সংসদ এবং ৫০ লাখ মানুষের সংসদে এ পার্থক্য অবশ্য অস্বাভাবিক নয়।
সংসদ থেকে উল্টা দিকে আবার জাতীয় নাট্যশালার দিকে রওয়ানা দিলাম, অজলোর প্রধান রাস্তা কার্ল লোহান (Karl Johan) সড়ক ধরে। ডান পাশে চোখ পড়ল অজলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ক্যাম্পাস, আইন অনুষদটি এখনও এখানেই আছে।
কার্ল লোহান সড়কের মাথায় দু'পাশে উদ্যান, বা'দিক দিয়ে ঢুকলাম। সামনে এগুতেই দেখি নীলস হেনরিক আবেল (Niels Henrik Abel, ১৮০২–১৮২৯), মহাশূন্যে পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। গ্যালওয়া বেঁচেছিল মাত্র ২১ বছর, আবেল ২৭, রামানুজন ৩১; পৃথিবীর ক্ষুদ্র জীবন তাদের অমরত্বকে দীর্ঘায়িতই করেছে কেবল।
আবেলের পেছনেই অজলো রাজবাড়ি, সামনে অশ্বপৃষ্ঠে আসীন নরওয়ে-সুইডেনের এককালের রাজা কার্ল লোহান (১৭৬৩-১৮৪৪)।
এঁর রাজা হওয়ার কাহিনী বড়ই চমকপ্রদ। সুইডেনের রাজা ত্রয়োদশ চার্লস বৃদ্ধাবস্থায়ও নিঃসন্তান রয়ে গেলে রাজ্য জুড়ে হাহাকার পড়ে গেল। রাজা মারা গেলে সুইডেন আর বুক ফুলিয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশকে বলতে পারবে না, আমাদেরও রাজা আছে—কী দুঃখের কথা! সবাই শলাপরামর্শ করে শেষে রাজার আস্তাবলের সবচেয়ে বড় হাতিটিকে ছেড়ে দিল; হাতি এ রাজ্য সে রাজ্য ঘুরে কোত্থেকে যেন কার্ল লোহানকে শূঁড়ে করে এনে সুইডেনের সিংহাসনে বসিয়ে দিল। লোহান অবশ্য যুদ্ধবিগ্রহে বেশ পারদর্শী ছিলেন। অতীতে পূর্বদিকের যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে ফিনল্যান্ডকে হারায় সুইডেন; লোহান ক্ষমতায় এসেই পশ্চিমে ডেনমার্ককে চেপে ধরে যেন নরওয়েকে সুইডেনের হাতে দিয়ে দেয়। ছোটখাট দুয়েকটি যুদ্ধের পর নরওয়েকে হস্তান্তর করে ডেনমার্ক, কিন্তু নরওয়ে এ সময় তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বল ও কৌশলে সুইডেনের সাথে নরওয়েকে যুক্ত করে রাখেন কার্ল লোহান বেশ অনেক বছর, যদিও নরওয়ে তখন থেকেই তার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে আসছে। আগামী ১৭ই মে আসছে সে দিবস।
আচ্ছা, আমি বোধহয় এখানে একটু রূপকথা ঢুকিয়ে দিয়েছি, ঐ যে হাতির অংশটুকুতে। তবে আপনারা কার্ল লোহানের সত্যিকারের ইতিহাস পড়লে উপলব্ধি করবেন, আমার রূপকথা সত্য থেকে বেশি দূরে নয়!
রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখা হয় ক্যামিলা কলেট (Camilla Collett, ১৮১৩–১৮৯৫)–এর সাথে, হেনরিক ভার্গেল্যান্ডের বোন, নরওয়ের প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক, আমাদের প্যারিচাঁদ মিত্র ও বঙ্কিমের প্রায় সমসাময়িক। নারীজাগরণের পথিকৃত, সারা জীবনই লড়েছেন তিনি তাঁর চারপাশের প্রতিকূলতা ঝড়-ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে। প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় গায়ের উপর কাপড়টি এখনও শক্ত করে ধরে রেখেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১১ সকাল ১০:৫৪