উত্তর আকাশের ধ্রুবতারাটির দিকে তাকিয়ে, মৌসুমি বায়ুর পথ ধরে আরব উপদ্বীপ ও পূর্ব আফ্রিকার মুসলিম বণিকগণ বাণিজ্য করত উপমহাদেশ ও দূরপ্রাচ্যের সাথে। ফিরতি পথে আসা পণ্য সাহারা মরুভূমির কাফেলা হয়ে পৌঁছে যেত উত্তর আফ্রিকায়, সেখানকার মুরদের (Moor) কাছে এশিয়ার জৌলুসের গল্প শুনত আটলান্টিক তীরের পর্তুগিজরা। প্রাচ্যের মুক্তা, মসলিন, রেশম, তুলা আর মসলার সম্ভাবনায় চকচক করে উঠে তাদের চোখ, এ ঐশ্বর্যের নাগাল কীভাবে পাওয়া যায়, ভাবতে থাকে তারা।
(ইবনে বতুতা, বাষ্পীয় এঞ্জিন আবিষ্কৃত হবার পূর্বে দীর্ঘতম পথের অভিযাত্রী, ভ্রমণ করেন ১২০,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ)
মঙ্গোল শান্তি'র (Pax Mongolica) সুবাদে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে জমজমাট হয়ে উঠেছিল এশিয়া ও ইউরোপের রেশম পথগুলো (Silk Route), চীনের মহাপ্রাচীর থেকে ভেনিসের খাল পর্যন্ত মানুষের পদচারণায় মুখরিত হতো স্থল বাণিজ্য পথ। কিন্তু অসহিষ্ণুতা,অন্তর্কলহ আর যুদ্ধ ধীরে ধীরে স্তিমিত করে দেয় মঙ্গোল শান্তির প্রভাব, একে ত্বরান্বিত করে বিউবোনিক প্লেগ, কৃষ্ণ মৃত্যু (The Black Death)। চীন নিজেকে গুটিয়ে নেয় তার মহাপ্রাচীরের ভেতর, দারিদ্র জোরালো আঘাত হানে ইউরোপে।
(প্রধান প্রধান রেশম পথ)
রেশম পথগুলোর জীর্ণদশা, যা কিছু অবশেষ তাও ভেনিসের দখলে। পর্তুগিজরা তাই এগুতে থাকল সমুদ্র পথ ধরে, জিব্রালটার প্রণালী (Strait of Gibraltar) পেরিয়ে আফ্রিকা উপকূল ঘেঁষে উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope) ঘুরে তাদের নৌযান পড়ল ভারত মহাসাগরের বুকে— ইউরোপের অন্যান্য জাতির তুলনায় সমুদ্র অভিযানে বেশ খানিটা অগ্রযাত্রা হয়ে গেল পর্তুগিজদের।
আফ্রিকা ঘুরে এশিয়া গমন, এ এক সুদীর্ঘ বিপদসঙ্কুল জলপথ; আর ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের সংযোজনকারী খাল সুয়েজ, সে তো সুদূর ভবিষ্যতের গল্প। ইটালির এক নাবিক আসলেন এ সময় স্পেনের রাজা ফার্দিন্যান্ড ও রানী ইসাবেলার রাজসভায়: পূর্বদিকে না গিয়ে যদি পশ্চিম দিকে যাত্রা করা হয়, তাহলে পর্তুগালের অনেক আগেই স্পেন পৌঁছে যাবে ভারতীয় উপমহাদেশের দোরগোড়ায়।
স্পেনের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৪৯২ সালের অগাস্ট মাসে পশ্চিম দিকে যাত্রা করেন নাবিক কলম্বাস, অক্টোবরে দেখা পান স্থলভাগের। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ (West Indies) আবিষ্কার করেছেন, ভ্রান্ত এ বিশ্বাসে উল্লাসিত হন কলম্বাস, ইউরোপকে চমকে দেয়ার জন্য বন্দী করে নিয়ে আসেন বেশ কিছু স্থানীয় অধিবাসী। এদের অনেকে সমুদ্রযাত্রায় মারা যায়, কিন্তু জীবিত যে ক'জন ইউরোপে পৌঁছতে পেরেছিল, ইউরোপকে চমকে দেবার জন্য তারা যথেষ্ঠই ছিল।
(নতুন মহাদেশ দখল করছেন কলম্বাস)
আটলান্টিকের বুকে সাম্রাজ্যবাদের খেলায় পর্তুগালের বিরুদ্ধে সমতা আনল স্পেন, ফলে পরবর্তী অংশ হয়ে উঠল আরো যুদ্ধংদেহী। রোমান ক্যাথলিক চার্চের স্পেনিশ বংশোদ্ভূত পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার দ্রুত হস্তক্ষেপ করেন এতে। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা মে পোপের অধ্যাদেশ (Papal Bull) জারি করেন তিনি—এতে আফ্রিকা উপকূলবর্তী ভার্দে অন্তরীপের দ্বীপপুঞ্জ (Cape Verde Islands) থেকে ১০০ লীগ (৩০০ মাইল) পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের বুক চিরে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত কাল্পনিক এক রেখা টানলেন তিনি, এবং ঘোষণা করলেন, এ লাইনের পশ্চিমে আবিষ্কৃত সকল ভূমির মালিক স্পেন। পর্তুগালের কথা উল্লেখ করেননি পোপ, ফলে লাইনের পূর্ব দিকে হলেও কোনো ভূমি দাবি করতে পারবে না পর্তুগাল।
স্বভাবতই এতে মন খারাপ হয় পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জনের। ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার সাথে সরাসরি দর কষাকষি শুরু করেন তিনি: কাল্পনিক লাইনটি যেন আরো পশ্চিমে সরানো হয় এবং পূর্বদিকের ভূমি পর্তুগালকে দেয়া হয়। জনের প্রচেষ্টা সফল হয়—১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে টর্ডেসিলা চুক্তির (Treaty of Tordesillas) মাধ্যমে লাইনটিকে ভার্দে দ্বীপপুঞ্জের ৩৭০ লীগ পশ্চিমে স্থাপন করা হয় এবং পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে একে স্বীকৃতি দান করেন।
(পোপ আলেকজান্ডার লাইন ও টর্ডেসিলা লাইন)
পোপ আলেকজান্ডারের অধ্যাদেশে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ স্পর্শ করার অধিকারই পায়নি পর্তুগাল, কিন্তু টর্ডেসিলা চুক্তির মাধ্যমে সে সুযোগ এসে গেল। আটলান্টিকের তীর থেকে শুরু করে নতুন মহাদেশের যতটুকু পারল ভেতরে ঢুকে গেল তারা, স্থাপন করল আধিপত্য। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বাকি অংশ রয়ে গেল স্পেনের প্রভাবে। এ কারণেই আজ ব্রাজিল মূলত পর্তুগিজভাষী এবং আর্জেন্টিনা স্পেনিশভাষী।
(লাতিন আমেরিকায় রোমান্স ভাষা। সবুজ: স্পেনিশ, কমলা: পর্তুগিজ, নীল: ফরাসি।)
তবে দ্বন্দ্ব থামেনি তারপরও। স্পেনিশরা টর্ডেসিলা লাইন থেকে পশ্চিমে যেতে লাগল, পর্তুগিজরা পূর্বদিকে। গোলাকার পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে প্রশান্ত মহাসাগরের মসলা দ্বীপগুলোতে আবার মুখোমুখি হলো তারা, শুরু করল মারামারি। তবে ইতোমধ্যে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ডাচ, ফরাসি, আর ব্রিটিশরা। পোপের অধ্যাদশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাম্রাজ্যবাদের খেলায়, শুরু হলো নতুন সমীকরণ।
টর্ডেসিলা চুক্তির প্রভাব পড়েছে আমাদের উপমহাদেশেও, চট্টগ্রাম উপকূলে পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল বাংলার মানুষ। তবে লাইনের পূর্ব পশ্চিমে তেমন কোনো তফাৎ হতো বলে মনে হয় না; সুবেদার শায়েস্তা খাঁ তখন পর্তুগিজদের পরিবর্তে স্পেনিশ দস্যুদের তাড়াতেন, এই যা!
ডিসক্লেইমার: স্পেনের নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদী খেলা এবং স্পেনের নান্দনিক ফুটবল খেলাকে এক না করে ফেলার দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণরূপে পাঠকের উপর ন্যাস্ত।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১০ দুপুর ২:৪২