দৃশ্যপট ১ : "মাঝে মাঝে আমি প্রত্যুষে ফজর নামাজ পড়িয়া প্রাতঃভ্রমনে বের হয়।" পাক্কা তিন চার ঘণ্টা হাটা হয়। তেমনি গতকাল বের হয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে বিচিত্র সব দৃশ্য অবলোকন করছি। আবার বিভিন্ন জায়গায় বসে খানিক বিশ্রামো নেই মাঝে মাঝে। তো প্রাতঃভ্রমণের শেষ দিকে যখন বাসার দিকে ফিরছিলাম তখন একটা জায়গায় চোখ গেল। দেখলাম ফেরিওয়ালার পাশে এক ছেলে কানে কি যেন লাগিয়ে গ্লাসে দেখছিল। আরো কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম এক ফেরিওয়ালা তার ভ্যানে চিরুনি,চুরি,কলম এর সাথে ব্লুটুথও বিক্রি করছে। আর ছেলেটি সেখান থেকে সেটা কানে লাগিয়ে চেক করছিল!! দেখে ভালোই লাগছিল। আজকাল ভ্যানেও ব্লুটুথও বিক্রি হচ্ছে, দেশ ডিজিটাল হচ্ছে ভেবে। এরপর আমিও হাতে একটা ব্লুটুথ নিলাম। নিয়ে দাম জিজ্ঞাস করার পর ফেরিওয়ালা বললো ২০ টাকা!!! শুনে আমি থতমত খেয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। ভাই কত, আবার জিজ্ঞাসা করলাম। ২০ টাকা। পরে তাকে বললাম নষ্ট হয়ে যাবে নাকি আবার? এবার সে অবাক হল। বললো ভাই, এটা "বডিগার্ড" সিনেমার সালমান খানের কানের যন্ত্র। ধরেন কানের ধুলের মত আর কি। সবাই স্ট্যাইল করার জন্য এটা কানে লাগায়। হাসবো না কাঁদবো ভাবতে পারছিলামনা, ঠিক তখন পাশের ছেলেটি কানে সে যন্ত্র লাগিয়ে খুব ভাল করে গ্লাসে দেখছিল। সে আমাকে বলে আপনি কি "বডিগার্ড" দেখেন নাই নাকি? আমি বললাম পেপারে পড়েছি। ও তাহলেতো জানবেননা। সেখানে সালমান খান এটা পড়েছিল। আমিও একটা কিনলাম। ছেলেটি আমাকে বললো। আমি মাথা নাড়িয়ে বুঝার ভান করে লক্ষ্য করলাম ছেলেটির কানে দুল দেয়া। চোখে সানগ্লাসও আছে। বুঝলাম কাউকে অনুকরন করছে। যাক অনেক ফালতু সময় সেখানে চলে গেল। দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম।
দৃশ্যপট ২: বাসার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন মোড়ের দোকান থেকে পাউরুটি নিচ্ছিলাম। স্কুলে যাবার সময়। সবাই স্কুলে যাচ্ছে। এমন সময় লক্ষ্য করলাম একটি অভিজাত স্কুলের ছাত্রিবাহী বাসে(মাইক্রো) চেঁচামেচি করছে কিছু উঠতি বয়সী মেয়ে। পাশে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আসলে তারা চেঁচামেচি করছেনা, তারা এই সকালেই গাড়িতে বাজানো "সবচে হট, সবচে হার্ড, আগিয়া বডিগার্ড"(আমি কিচুক্ষন শুনে শুধু এই তিনটা কথা বুঝলাম) এমন কিছুর তালে তালে তালি দিয়ে আনন্দ!! করছিল। কি করবো ভাবতেই গাড়ি ভৌ দোড়, কারন যে ছাত্রীর জন্য আমাদের এলাকায় এসেছে সে গাড়িতে আপলোড করেছে ইতিমধ্যে।
দৃশ্যপট ৩: বাসায় পৌঁছলাম। গোসল-নাস্তা সেড়ে বের হতে হবে। তাই দ্রুত সব শেষ করে ঘর ছাড়লাম। টিকেট কেটে বাসের অপেক্ষা করছি। বাসে লম্বা ৩ সিটওয়ালা একটি সিটে সম্ভবত সিটি কলেজের দুই ছাত্রের সাথে বসলাম। বসে দুই টাকা দামের একটা পেপার কিনে পড়ছি। পাশের দুই ছাত্র তখন "বডিগার্ড" রিভিও করছে। খুব নাকি ভাল হয়েছে। (আশা করি এ ব্যাপারে "উস্তাদ দুর্যোধন" অচিরেই একটি লেখা নাজিল করবেন।) এরপর গানের ব্যাপারে কথা এল। একজন থেকে "আই লাভ ইউ" আরেকজন থেকে "তেড়ি বেড়ি" বেশি ভাল লেগেছে। আলোচনা কমলে এক ছাত্র "তেড়ি বেড়ি" গানটা মনে হয় মোবাইলে দিয়ে একটি হেড ফোন নিজের কানে আরেকটি বন্ধুর কানে দিয়ে বিড়বিড় করে গাচ্ছিল। ভালোই "বডিগার্ড" এর পাল্লায় পড়লাম দেখি। ও হ্যা মর্নিং শোজ দ্যা ডে।
এবার চলুন পিছনে ফিরে যায় একটু-
ফ্ল্যাশবেক ১: এবার ঈদে আমাদের তিনজনের ঈদ বাজারের উপর একটা বিশেষ এসাইনমেন্ট ছিল। সে কারনে অনেক মার্কেট এবং দোকানে আমাদের প্রচুর সময় দিতে হয়েছিল। সেখান থেকে কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। বাবার সঙ্গে রাজধানীর অভিজাত একটি মার্কেটে ঈদের শপিং করতে এসেছে বিএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণীর প্রথম বর্ষের ছাত্রী রেসি। সে বাবার সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবল দেখছে; এখনো কিছু কেনেননি। তবে তার পছন্দের তালিকায় প্রথম রয়েছে শিলা-মুন্নী। রেসি বলে, সবাইতো এসব পোশাকই কিনছে। আমি কি কিনবো এখনো জানি না, তবে শীলা-মুন্নী আমার বেশ ভালো লেগেছে। সবাই করছে সেজন্য আপনিও করবেন? তাল না মিলালে কি চলা যায়? প্রশ্নকর্তার দিকে রেসির উল্টা বাউন্সার।
মুল্য মাত্র তিন লক্ষ টাকা শাড়িটির। শাড়িটি রিয়েল স্টোনে তৈরি করা। আর এটি ঈদ উপলক্ষ্য আনা হয়েছে মুম্বাই থেকে। পিংক সিটি শপিং কমপ্লেক্স এর ঐ দোকান থেকে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় শাড়িটি ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। ক্রেতার নাম প্রকাশে দোকানী অনিচ্ছুক।
ফ্ল্যাশবেক ২: এক দোকানের সামনে দেখলাম একটি মেয়েকে খুব বকাবকি করছে এক লোক। দ্রুত সেদিকে পা বাড়ালাম। জানা গেল মেয়ের পছন্দের সঙ্গে বাবার পছন্দ একবারেই মিলছে না মাইশা করিমের। ভদ্রলোক অনেকটা অভিযোগের সুরে বলেন, ‘ড্রেসের নাম কী শুনেন, ‘ডিংকাচিকা’! নাম শুনেই আর এসব জিনিস কিনতে ইচ্ছে করছে না। তার উপর যা দাম! কোন মানেই হয় না ১৫/২০ হাজার টাকায় একটি ড্রেস কেনার। অথচ মেয়েকে তা বোঝাতে পারছি না। মেয়ের কথা, এখান থেকেই কিনে দিতে হবে পোশাক। তাই একটু বকেছি।
ফ্ল্যাশবেক ২: বড় একটি দোকানে বসে বাজার পর্যবেক্ষন করছি। সম্ভবত ঈদের দুদিন আগের। হটাৎ এক ভদ্রলোক প্রচন্ড ক্ষেপে গেলেন স্ত্রীর উপর সবার সামনেই। পড়ে জানতে পারলাম তিনি একজন প্রকৌশলী নাম সাইমন রেজা। রাগারাগি এবং জগড়ার কারন খুজতে গিয়ে জানলাম তার নিজের পছন্দ দেশীয় বিভিন্ন বুটিক হাউজের পোশাক। কিন্তু পছন্দের সঙ্গে কিছুতেই মিলছে না স্ত্রী তাশফিয়া তানিয়া ও আট বছরের মেয়ে সুরভীর পছন্দের। মা-মেয়ে দুইজনেরই পছন্দ শিলা-মুন্নী (পোশাকের নাম)। যা একেবারেই পছন্দ করছেন না তারেক। এই নিয়ে মার্কেটেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একচোট ঝগড়া। স্বামীর শেষ পর্যন্ত অনড় অবস্থান দেখে খুবই খুশি হলাম।
ফ্ল্যাশবেক ৩: এবারের ঈদে মোটামুটি বলা যায় স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশে অনলাইনে ডিজিটাল ঈদ পালন করেছি। তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি। তারপরেও ঈদ বলে কথা। ২য় দিন ঘর ছেড়ে বের হলাম খুবই প্রিয় এবং কাছের এক রিলেটিভসের বাসায়। আমার খালার বাসায়। খালা অবশ্য মাঝে মাজে আসে বেশিরভাগ সময় গ্রামেই থাকেন। খালাত ভাই আর ভাবি এবং উনাদের তিন সন্তান থাকে। খালাতো ভাই ইউএসে থাকেন। তো সেখানে গিয়ে কলিং বেল দিলাম। ছোট খালাত ভাই এসে দরজা খুলে দিয়ে সালাম করলো। উদ্দেশ্য সবার জানা। সেলামী। যাক সেলামী দিয়ে সোফায় বসে পিচ্চির সাথে গল্প করছিলাম। কিন্তু আর কারো সাড়া শব্দ পাচ্ছিনা দেখে ভাবছিলাম মনে হয় বাহিরে বেড়াতে গেছে। পরে ভাতিজাকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার আম্মু-আপুরা কোথায়। সে উত্তর দিল সবাইকে নিয়ে এমনকি কাজের মেয়েসহ নাকি উনারা টিভি দেখছেন। যাক খালার বাসায় আমার পুরো এক্সিস আছে। তাই ওকে নিয়ে চললাম টিভি রুমের দিকে। আমাকে দেখে সবাই কিছুটা টাস্কি খেল। সেখানে গিয়ে দেখি ভাবির চোখে পানি সাথে উনার মেয়েদেরও। ব্যাপার কি!! ঈদের সময় চোখে পানি সবার!! ও হ্যা তখন সেখানে হিন্দি সিরিয়াল এর খুব প্যাথেটিক ডায়ালগ চলছিল।
দৃশ্যপট এবং ফ্ল্যাশবেক পর্যালোচনাঃ
দৃশ্যপট এবং ফ্ল্যাশবেক সমুহ পর্যালোচনা করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, বাঙ্গালী ভাল কিছু অনুসরন করতে পারেনা। যদি পারতো "বডিগার্ড" এর জামা কাপড় চশমা অনুসরণ না করে কিংবা ভারতীয় রগরগা ছবি নকল না করে আমাদের পরিচালকরা, রাং দে বাসন্তী, লিজেন্ড অফ ভগবত সিং, লগান, সাফারোশ এর মত দেশপ্রেম জাগ্রত করা মুভি বানাতো।
সবার যদি ইঞ্জিনিয়ার সাইমন রেজার মত ওয়াইফ এবং সন্তানদের সস্তা আবেগ বাদ দিয়ে দেশী পোশাকের উপর অনড় থাকতো তাহলে আমাদের পোশাক শিল্পের যা বিদেশী বাজারে সুনামের সাথে সমাদৃত তার নিজ দেশে লাথি খেতে হতোনা।
শুনতে খারাপ লাগবে। আসলে আমাদের দেশপ্রেম আসবে কোথায় থেকে? দেশের মায়েরাই তো মিসগাইডেড হয়ে গেছে সবার থেকে বেশি। কি পোষাক-আশাক আর কথা বার্তা চাল-চালন, মাসুলভ কোমলতা-কঠোরতা আজ হারাতে বসেছে। পোশাক আশাকে মা-মেয়ে যেন প্রতিযোগিতা করছে। আমার খালাত ভাইয়ের ওয়াইফের কথায় ধরুন, বাসায় হিন্দি সিরিয়াল দেখছে একসাথে। আবার সবাই মিলে চোখের জলও ফেলছে একসাথে। কিন্তু হাজারো বোমা মারলে কি এদের রাস্তায় পরে থাকা অভুক্ত শিশু, বৃদ্ধা মা-বাবা কিংবা খোঁড়া,অন্ধদের দিকে তাকিয়ে এদের চোখের জল বাদ যাক হৃদয়ে কি কোন অনুভূতি আসবে বা আসে??
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ৯:১৯