
আদর আমার ,
আজ এই মেঘলা আকাশের বাদল দিনে খোলা চিঠি দিলাম ভাসিয়ে ইথারের এক অসীম সীমানায়। এ চিঠি যদি কখনো ভুল করেও তোমার চোখে না পড়ে ক্ষতি নেই কিছু । আমি জানব এ চিঠি তোমার কপোল ছুঁয়ে গেছে , তোমার এলোমেলো চুলে নাড়া দিয়ে গেছে , চোখে জল এনে দিয়ে গেছে তোমার জমিদার বাড়ির সেই পরিপাটি করে সাজানো দোতলার এক হাসনা হেনা ফুলের গন্ধে ভাসা সুন্দর ঘরটিতে বসে ।
আজ আমি বলব , হ্যাঁ সবই খুলে বলব তোমাকে। আজ আর তোমাকে জেরা করতে হবে না সবাইকে লুকিয়ে , তোমাকে বলতে হবে না আমার দু গালে হাত দিয়ে " জান ,সত্যি করে বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা ? " আমার বুকে মাথা রেখে তোমাকে আর চোখের জল ফেলে বলতে হবে না , " একটি বার ,শুধু একটি বার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো "।
প্রিয়তমা আমার
আমি সেদিন বলতে পারিনি , আমার না বলা কত কথা , কত জমানো কষ্ট কত ব্যাথা -বেদনা । আমার বুকটা হাহাকার করে উঠেছে , দুমড়ে-মুচড়ে গেছে অকুল পাথারে ওঠা ঝড়ো তুফানে পড়া এক ভেঙ্গে যাওয়া জাহাজের মতো । আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা তুমি জানতে চেয়েছো ! উহ্ কি করে বোঝাবো আমার বুকের ভেতরে কি হচ্ছে ! লক্ষ লক্ষ দামামা আর হাজারো সাইরেন আমার বুকে করুণ সুরে বেজে উঠেছে মুর্হুমূহু । আমি তোমাকে বলতে পারলাম না। আমার চেয়েও বেশী ভালোবাসতে পারে তোমাকে এ পৃথিবী আর কে আছে ? আমার বুকটা ভেঙ্গে চুরে একাকার হয়ে গেল অথচ চোখে জল এলো না ! আমি খুব শক্ত করে তোমার মুখের ওপর বলে দিলাম , না বাসি না , তোমাকে ঘৃণা করি প্রচন্ড, প্রচন্ড ... তুমি চলে যাও , আর কখনো আমার সামনে এসো না ! কখনো না , ভুল করেও না....আমি তোমার মুখ আর দেখতে চাই না !
আদর আমি কাঁদলাম , কতক্ষণ কাঁদলাম আমি জানি না , সে কান্না আমার আজো শেষ হয়নি , জানি আর কখনো শেষ হবে না , জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে কাঁদতে হবে । আমার পাপের কোন শেষ নেই । কত পাপ করেছি আমি তোমার সঙ্গে। কত ব্যাথা দিয়েছি , কত কাঁদিয়েছি তোমায় কারণে -অকারণে ....। তবু তোমার চোখের জল আমি মুছিয়ে দিইনি । কি দারুণ ব্যাপার তাই না ! আমি তো পুরূষ মানুষ , আমি সব পারি । আমার হৃদয় যে ইস্পাত দিয়ে গড়া , আমি যে সিংহ রাশির পুরুষ , আমাকে কোন মেয়ের সামনে কাঁদলে চলে না , আমাকে হাসতে হবে , উঠে দাড়াতে হবে , সবার সামনে হাসি মুখ নিয়ে খোঁজ খবর রাখতে হবে। বুকের ভেতর যত কষ্টই থাকুক আমাকে এগিয়ে যেতে হবে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত নিয়ে , সিংহের মতো গর্জন করে .......তবেই না আমি সুপুরূষ !
সত্যি তো ? আমি কি আসলেই পুরূষ হতে পেরেছি ? জীবনের আজ এ পর্যায়ে এসে আমাকে কাপুরূষ মনে হয় । না হলে কেন আমি তোমাকে সেদিন ওভাবে ফেলে রেখে পালিয়ে এলাম এই শহরে ? কেন আমি আসার সময় একটিবারও তোমাকে বলে এলাম না ? কেন আমি তোমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে এলাম না ? সবকিছু জানার পরও তুমি যখন আমার কাছে চলে আসতে চাইলে আমি কেন তোমাকে ঠিকানা দিলাম না ? আমি কেন এত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না ? সারাজীবন আমি বলতাম , যারা পাপী তারাই মসজিদ-মন্দিরে যায় প্রার্থনা করতে , তাদের পাপ কমাতে । আমার কথা শুনে তুমি হাসতে , আমাকে বোঝাতে কিন্তু কখনোই আমার ওপর জোর করনি। আজ আমাকে জোর করার মতো কেউ নেই , আজ আমাকে কেউ মন্দিরে যেতে বলে না । আজ আমি নিজেই প্রতি সপ্তাহে একদিন মন্দিরে যাই , আমার পাপের ভার কমাতে , জানি তাতে পাপ কমে না বরং আরো বেড়ে যায় বহুগুন। হায় ভগবান ! অসীম তোমার খেলা , আমাকে পাপী বানিয়েই ছাড়লে , তোমার কাছে নিয়েই ছাড়লে.....নাস্তিক হতে দিলে না !
তোমার কাছে থাকতে তোমার জন্মদিন কবে যেত আমি ঠিক পেতাম না । তুমি আমাকে সারাজীবনই আত্নভোলা মানুষ বলেছো । কোন কিছুই ঠিক মনে রাখতে পারতাম না । অথচ আজ আমার কেমন যেন স্মৃতির পাতায় পাতায় লেখা সবকিছু মনে পড়ছে , কোন কিছুই আমি ভুলতে পারছি না। বুদ্ধদেব গুহর সেই লাইনটি আজ আমার খুব মনে পড়ে - " প্রাসাদ যে আমার একদিন অনুপম ছিল , আজকের ধ্বংসাবশেষই তার প্রমাণ ।" কি নিদারূণ সত্য , কি ভয়ংকর সুন্দর এ বাণী , কি গভীরতা এর মাধুর্যের ! আর সে গভীরেই আজ আমি ডুবে গেলাম ! আজ আমাকে ফেরানোর কেউ নেই , কেউ আজ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে না , আদর করে আমাকে আজ কেউ মুখে খাবার তুলে দেয় না , আমার জন্য আজ সকালের নাস্তা বানিয়ে কেউ পালিয়ে নিয়ে আসে না , মন্দিরের বেদীতে বসে কেউ আজ আমার জন্য প্রার্থনা করে না , সকাল থেকে সন্ধ্যার বাতাসে আজ আমার জন্য কেউ বসে থাকে না অধীর আগ্রহে.....। কখন আমি আসব , কখন এসে তোমার সামনে ওই সোফাটায় বসব , সেই একটু দেখাতেই তুমি শান্তি পেতে , তোমার হাসি ভরা মুখ দেখে আমার যে কি হতো তা বোঝাতে পারব না । আমি জানি আজও সেই সোফাটা তোমার বেডরুমের একপাশে বসে আছে , ওখানে তুমি ছাড়া আর কারোর বসা নিষেধ। আজো আমার প্রিয় খাবার গুলো তোমার মুখে ওঠেনি । তোমার শ্বশুর বাড়ির সবাই জানেন, অতসব সুন্দর সুন্দর খাবার গুলো তোমার নাকি ভালো লাগে না ! তাহলে বলো সন্ধ্যাবেলায় আমার মুখে কি করে রুটি -কাবাব ওঠে ? কি করে সারাদিনের ক্লান্তির মাঝে আমি কফি খাবো ? কি করে টেংরা -ইলিশ- খাসীর মাংশ , আলপেনলিব চকোলেট , আইসক্রীম , আচার ,আম-কাঠাঁল-লিচু -কুল -আঙ্গুর-আপেল আমার মুখে ওঠে ? আরো কত কি যে আমার জীবন থেকে বাদ হয়ে গেল !
মনে পড়ে এক বৃষ্টি মুখর দিনে তুমি ঠিক এমনই সময় এসেছিলে আমার ঘরে । তুমি গান পছন্দ করতে । গান শুনতে চাইলে , আমি শোনাই নি । তুমি কষ্ট পেয়েছিলে খুব আর তাই বড় অসময় এসে গেল আমার জীবনে । গীটারের তার ছিড়ে গেল । আমি আর সে গীটারে হাত দিইনি আজো । যার জীবন থেকে হারিয়ে গেল দীপশিখা তাকে কিভাবে আর জ্বেলে রাখা যায় !
আমি যখন সময় কাটানোর জন্য অথবা কাজের জন্য বের হয়ে যাই দুরের পথে তখন নীল আকাশের দিকে আমার চোখ চলে যায় । আচ্ছা তুমি তো নীল আকাশ ভালোবাসতে , ওই নীল আকাশের কোন এক মেঘের ফাঁকে তুমি আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারো না ? আমার আর এ জীবন ভালো লাগে না , সব কিছু কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে । এই শহরে এত মানুষ , এত কোলাহল , এত ব্যস্ততা , এত মুখ তবু সেই হাজারো মানুষের ভীড়ে একটি প্রিয় মুখ মেলাতে যাই , পারি না । শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আজ আমার কিছু নেই । আমার দীর্ঘশ্বাস তুমি কি এখন শুনতে পাও ? শুনতে না পেলে খুশী হবো খুব , আমি তো তোমার সুখই চেয়েছিলাম ..........।
আমার অপমান তুমি সহ্য করতে পারোনি । তুমি বলেছিলে আমাকে বড় হতে হবে , অনেক বড় , এত বড় হতে হবে যে আমার পা থাকবে মাটিতে কিন্তু মাথা থাকবে উঁচু হয়ে। সমাজের মানুষ আমাকে এক নামে চিনবে । আদর আমি এখন আর কত বড় হবো ........?
সিগারেট আমি কখনো সহ্য করতে পারতাম না । সারা জীবন আমার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মাদকের বিরুদ্ধে বলে এসেছি । পান-বিড়ি-সিগারেটকে না বলেছি অথচ দ্যাখো নিয়তির কি নির্মম পরিহাস , আজ আমার সিগারেটকেই বড় বেশী আপন মনে হয় ! সিগারেটের শেষ আগুনটা এসে যখন আমার আঙ্গুল দুটোকে পুড়িয়ে দেয় তখন মনে হয় শ্মশানের ওই আগুন জ্বলা চিতাটায় সেদিন কেন ঝাঁপ দিলাম না ? আমার সীতাকে , আমার দেবীকে যে কত কাল আগে ,কত যুগ আগে , কি নিদারুণ ভাবে , নিজের হাতে ওখানে তৃতীয়বার শেষ বিসর্জন দিয়েছি !
তোমার বিস্ময়
০৬.০৬.০৮