আমাদের অপরাধ ছিল ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির প্রতিবাদে দেয়াল লিখন আর পোস্টারিং করা।
ঘটনাক্রম:
৫/৩/১১ - দুপুর ১টা
বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ায় বসেছিল ছাত্র ফ্রন্ট কর্মী গৌতম, মুনিম, জয় আর রাজন। ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক রওনক আহসান তার ১০-১২জনের একটি দল-বল নিয়ে ঢুকে তাদের বাইরে ডেকে নিয়ে জানতে চায় কেন চাঁদাবাজি নিয়ে পোস্টারিং-দেয়াল লিখন করা হলো। আধা ঘন্টার মধ্যে ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি হয়েছে এর প্রমাণ হাজির করতে হবে নইলে খবর আছে। গৌতম ঠান্ডা মাথায় জবাব দেয়,"ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি হয়েছে তাতো পত্রিকাতেই এসেছে(সুত্র: , সাধারণ ছাত্রদেরও অজানা নয়।
[ View this link
View this link
View this link
View this link]
তাছাড়া পোস্টারিং/দেয়াল লিখনে কোন সংগঠনকে চিহ্নিত করে অভিযোগ করা হয় নি। সেখানে লেখা ছিল,"হলে-ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-দখলদারিত্ব বন্ধ কর।" যেটি সারা দেশে সংগঠনের একটি সাধারণ দাবি। তাছাড়া আপনাদের কাছে জবাবদিহি করার তো আমার কোন প্রয়োজন নেই।"
এতে ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্ষেপে গিয়ে গেটে টাঙানো নবীনদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানিয়ে ছাত্র ফ্রন্টের ব্যানার জ্বালিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিলে মুনিম গিয়ে তা কেড়ে নেয়। এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে রওনক মুনিমকে বেয়াদব সম্বোধন করে চড় মারা শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্র ফ্রন্টের চারজনের উপর। এতে টিকতে না পেরে ছাত্র ফ্রন্ট কর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে বাইরে চলে আসে। হলে অবস্থানরত বাকিরাও খবর পেয়ে দ্রুত ক্যাম্পাসের বাইরে আসে। ২টা/২.৩০টার দিকে ছাত্র লীগ কর্মীরা হলে হলে গিয়ে ছাত্র ফন্ট কর্মীদের রুম ভাংচুর-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ শুরু করে সকলের সামনে।
রশীদ হলের ৪০০৬ নং রুমে (গৌতম আর আমার(মামুন-সাধারণ সম্পাদক) রুম) কম্পিউটার, বিছানা-বইপত্র ইত্যাদি বের করে ভেঙেচুরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সোহরাওয়র্দী হলের ১০১২ নং রুমে (ছাত্র ফ্রন্ট সদস্য রাজনের রুম), শেরে বাংলার ৩০০৭ (পলাশ-ছাত্র ফ্রন্ট সদস্য), তিতুমীর হলের ৩০০২(নাজমুল- ছাত্র ফ্রন্ট সদস্য), নজরুল ইসলাম হলের ৩২৯ (মুনিমের রুম- ছাত্র ফ্রন্ট সদস্য) রুমগুলোতে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়।
আমরা ছাত্র ফ্রন্ট কর্মীরা তৎক্ষণাৎ ছাত্র কল্যান পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে ঘটনার হোতাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে এবং আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করি। ঘন্টাতিনেক তাঁর সংগে আলোচনা করে কোন নিশ্চিত আশ্বাস পাওয়া গেল না। বরং সহকারী ছাত্রকল্যান পরিচালক ড.রাকিব আহসান এবং শিক্ষক ড. মুনাজ আহমেদ নূর (ইনি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের উপদেষ্টা এবং আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা বলে অত্যন্ত পরিচিত) আমাদের বললেন তাঁরা অসহায় এবং আমরা যেন ঐদিন ক্যাম্পাসে না থাকি তার উপদেশ দিলেন(!)।
আমরা বলি যারা দোষী তারা ক্যাম্পাসে থাকতে পারবে আর যারা প্রতিবাদ করলো তারা বেরিয়ে যাবে এ কেমন কথা? আমরা সেদিন সাহস করে ক্যাম্পাসে থেকে যাই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিই এক রুমে সবাই থাকবো।
রাত নটার দিকে জয়ের রুমে(সোহরাওয়ার্দী-১০১৩) গিয়ে আমরা রাতে থাকতে গেলে তখন হলে আসেন সমস্ত হল প্রভোস্ট-ছাত্র কল্যান পরিচালকসহ উপাচার্য স্বয়ং।
আমরা পরিস্থিতি তাকে জানালে উপাচার্য স্যার এমন ভান করেন যেন ঘটনা তিনি জানেনই না। বরং এমন চোটপাট নিলেন আমাদের উপর মনে হলো আমরাই কোন বিশাল অপরাধ করে ফেলেছি। উনার মতামত কিছুই হয় নি, ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ নিরাপদ, আমরা যেন আমাদের নিজ নিজ রুমে থাকি। আমরা যখন তাকে বললাম আমরা প্রচন্ড ইসসিকিউর ফীল করছি, তখন শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন যারা যারা ইনসিকিউর ফীল করছো তারা আমার সঙ্গে আসো মেডিকেল সেন্টারে থাকো আজ রাত। গৌতম, নাজমুল আর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো মেডিকেল সেন্টারে। সেখানেই রাত কাটালাম। বাকিরা রিস্ক নিয়ে হলে থেকে গেল। কারো কারো রুমে প্রভোস্টের উদ্যোগে গার্ড পাহারায় রাখা হলো। সেদিনের মতো আর কিছু তেমন ঘটে নি।
০৬/০৩/১১ - সকাল ৯টা:
আমরা ৩ জন চীফ মেডিকেল অফিসারের অনুমতি নিয়ে যাই ক্যাফেটেরিয়ায় নাস্তা করতে। গিয়ে দেখতে পাই পুরো ক্যাম্পাসে পোস্টারিং করা হয়েছে আগের দিন আমাদের রুম থেকে লুট করা গৌতমের ডায়েরী থেকে কয়েকটি টুকরো টুকরো অংশের কপি দিয়ে তার সঙ্গে কিছু কমেন্ট যুক্ত করে। ৯.৩০ এর দিকে রওনক ১০-১২জনকে সঙ্গী করে নিয়ে ক্যাফেতে ঢুকে আমাদের ডেকে ক্যাফেটেরিয়ার একপাশে নিয়ে গিয়ে তার সাঙ্গদের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,"এরা কারা চিনিস? এরা কি করতে পারে জানিস? এক্ষুণি, ১০ মিনিটের মধ্যে তল্পি-তল্পা গুটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়বি।" আমি তখন গৌতমকে তাদের সামনে থেকে টেনে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার ভিতরে সবার সামনে নিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করতে করতে এমন ভাবে বলি যাতে ক্যাফেতে উপস্থিত প্রায় ৪০-৫০জন সাধারণ ছাত্র বিষয়টি জানতে পারে,"আপনারা আমাদের ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বলার কে? প্রশাসন বললে আমরা ছাড়তে পারি। আপনারা চাঁদাবাজি করতে পারবেন আর আমরা প্রতিবাদ করলেই সমস্যা? আপনারা ছাত্রলীগ বলে আপনাদের কথা আমাদের শুনতে হবে?"
সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাদের ওপর পশুর মতো হামলে পড়ে। লোহার চেয়ার দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে থাকে। এরপর দু'জন সহকারী ছাত্র কল্যান পরিচালক এসে আমরা আহত দেথতে পেয়েও উল্টো আমাদেরকে ধমকতে শুরু করেন,"উসকানি দিতে এসছো?!
এরপর কয়েকজন শিক্ষক এসে আমাদের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান।
২টার দিকে আমরা ভিসি স্যারের সঙ্গে দেখা করলে তিনি তখন শুকনো মুখে বলেন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে আর আপাতত হলে যেন না থাকি।
আমরা তখন প্রতিবাদ করে বলি যারা ঘটনা ঘটালো তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে এই ঘটনা ঘটতো না। আর এখনও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমাদেরকেই হল ছাড়তে বলা হচ্ছে। তাতেও তিনি কোন সুষ্ঠু আশ্বাস না দিয়ে আমাদের শুধু বললেন তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য উপস্থাপন করতে।
ভিসি স্যার কোন ব্যবস্থা নিবেন না বুঝতে পেরে সেদিন আমি আর গৌতম ক্যাম্পাসের বাইরে চলে গেলাম। বাকিরা প্রচন্ড রিস্ক মাথায় নিয়েও সেদিন হলে থেকে যায়। রাত ১টার দিকে খবর পাওয়া যায় হলে হলে ছাত্রলীগ মহড়া দিচ্ছে রুমে রুমে। সঙ্গে সঙ্গে যারা হলে ছিল তারা বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
০৭/০৩/১১ -
বিকাল ৪টায় আমরা ভিসি - ছাত্র কল্যান পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাই আর আমরা বলি আমাদের একাডেমিক প্রয়োজনে হলেই থাকতে হবে। ছাত্রকল্যান পরিচালক আশ্চর্য হয়ে আমাদের বলেন,"তোমাদের তো হলে আসার কথা ছিল না! আমি বলতে পারবো না। তোমরা প্রভোস্টের সঙ্গে কথা বল।" আমরা তখন প্রভোস্ট স্যারের সাথে যোগাযোগ করে বলি হলে থাকার ব্যপারে। প্রভোস্ট স্যার আমাদের সরাসরি বললেন হলে না থাকতে কারণ তদন্তের স্বার্থে নাকি আমাদের হল সিলগালা করা হয়েছে। আমরা আমাদের লুট হওয়া জিনিষপত্রের খবর জানতে চাইলে বলেন তদন্ত কমিটির কোন নির্দেশনা তিনি পাননি। অগত্যা আমরা আশাহত হয়ে আহসান উল্লাহ ক্যান্টিনে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে যত দ্রুত সম্ভব ক্যাম্পাস ছাড়ার পরিকল্পনা নিলাম।
রাত ১০টার দিকে আহসানউল্লাহ হলে খেয়ে দেয়ে বসেছিলাম আমি আর গৌতম। সাথে ছিলেন জাহিদ ভাই, প্রত্যয় ভাই (মাস্টার্স করছেন- স্মৃতি হলে থাকেন)। পাশের টেবিলে আরেফিন, জেহিন, রিফাতসহ প্রায় ৫-৬জন গৌতমের ক্লাশমেট বসে গল্প করছিল। গৌতমও তাদের সাথে যোগ দেয়। হঠাৎ ক্যান্টিনের উত্তর গেট দিয়ে মাসুম, মম, রাফি, শোয়েবের নেতৃত্বে ছোড়া,কাটা রড, নানচাকু, হকিস্টিক ইত্যাদি নিয়ে প্রায় ৩০-৪০জন ছেলে মুহূর্তের মধ্যে ক্যান্টিনে ঢুকে গৌতমকে এলোপাতাড়ি জখম করতে শুরু করে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে ফেলে দিয়ে পিছনে দু'তিনটি লাঠির বাড়ি দিয়ে ভালভাবে ধরবার আগেই আমি দৌড়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্মৃতি হলে ঢুকে যাই। পেছনে তাকিয়ে দেখি গৌতমকে ধাওয়া দিয়ে মারতে মারতে শেষ পর্যন্ত সেন্সলেস অবস্থায় স্মৃতি হলের সামনে ফেলে রেখে গেছে। মাথার পেছণ থেকে প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম বোধহয় মেরেই ফেলেছে। উদ্ভ্রান্তের মতো চিৎকার করতে থাকি। এম্বুলেন্স আসে। জাহিদ ভাই, প্রত্যয়দা, রাজিবদার সাথে আমি গৌতমের সেন্সলেস শরীর তাতে নিয়ে ডি.এম.সি-তে যাই।







এরপর থেকে আর ক্যাম্পাসে ফিরতে পারি নি এখনো।
পরের কিস্তিতে গৌতমের ডায়েরীতে প্রাপ্ত তথ্যগুলো ব্যাখ্যা করবো....
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১১ ভোর ৬:১৫