"39 − x^2 = 10x সমীকরণটি কীভাবে সমাধান করব, বাবা?" মানহা বললো।
"সমস্যা কোথায়?" আমি বললাম।
“যদি সমীকরণটি হতো 39 = 10x অথবা 39 = x^2 , তাহলে এটি সহজেই সমাধান করা যেত। কিন্তু x ও x^2 একসঙ্গে থাকায় সমস্যা হয়ে গেল।“
"এটি একটি দ্বিঘাত সমীকরণ," আমি বললাম, "কারণ সমীকরণে অজানা রাশির, অর্থাৎ যার মান নির্ণয় করতে হবে তার, সূচক বা ঘাত 2। আল খোয়ারিজমির পদ্ধতিতে সমাধান করো একে।"
"আল খোয়ারিজমি কে, তাঁর নিয়মটি কী?"
"গণিত এবং বিজ্ঞানের নানা শাখায় ছড়িয়ে আছে দ্বিঘাত সমীকরণের অসংখ্য প্রয়োগ। এ সমীকরণগুলোর উপর প্রথমবারের মতো সমন্বিত ও বিশদ গবেষণা করেন পারস্যের মহান গণিতবিদ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমি, যিনি অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইরাকের বাগদাদ নগরীতে বিকাশ লাভ করেছিলেন। তাঁর নামের শেষাংশ থেকে ধারণা করা হয় যে তিনি জন্মেছিলেন বৃহত্তর খোরাসান অঞ্চলের খোয়ারিজম নামক মরূদ্যান নগরীতে, আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে; স্থানটি আরল সাগরের দক্ষিণে এবং আমু দরিয়া নদীর ভাটি অঞ্চলে আধুনিক উজবেকিস্তানের খিভাতে অবস্থিত। জন্মভূমি খোয়ারিজম থেকে আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাগদাদে গমন করেন তিনি, খেলাফতের গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র বায়তুল হিকমা বা জ্ঞানের নিবাসে জ্ঞানসাধনায় ব্রতী হতে।
বায়তুল হিকমায় গবেষণার সময় ইসলামিক উত্তরাধিকার, সম্পত্তি বন্টন, ভূমি জরিপ, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে তিনি দেখেন, হিসেবনিকেশে প্রায়ই দ্বিঘাত সমীকরণ সৃষ্টি হচ্ছে যেখানে অজানা কোনো রাশির মান নির্ণয় করতে হবে। সুশৃঙ্খলভাবে এ জাতীয় সকল সমীকরণ সমাধান করার জন্য তিনি প্রথমে দুটি নিয়ম বিধিবদ্ধ করেন: আল জাবর এবং আল মুকাবালা।
ধরা যাক, আল খোয়ারিজমি 39 − x^2 = 10x সমীকরণটির মুখোমুখি হলেন। কীভাবে তিনি সমাধান করবেন এটি?
আল খোয়ারিজমির সময়ে গণিতশাস্ত্রে x, y, z, a, b, c, +, −, × ÷ এসব প্রতীকচিহ্নের প্রচলন ঘটেনি। তাই সমীকরণটিকে তিনি পাবেন কিংবা বর্ণনা করবেন কথার মাধ্যমে এভাবে:
উনচল্লিশ দিরহাম বিয়োগ এক মাল সমান দশ জিদির
দিরহাম মানে সমীকরণের ধ্রুবক সংখ্যা, জিদির হচ্ছে অজানা রাশি বা মূল (x) এবং মাল হচ্ছে অজানা রাশির বর্গ (x^2)।
তোমাদের বোঝার সুবিধার্থে প্রতীকের মাধ্যমেই আল খোয়ারিজমির সমাধানটি ব্যাখ্যা করছি আমি। তাহলে তাঁর সামনে আছে একটি সমীকরণ
39 − x^2 = 10x
সেযুগে ঋণাত্মক সংখ্যার প্রয়োগ বিকাশ লাভ করেনি, ফলে দ্বিঘাত সমীকরণে রাশির বিয়োজন প্রক্রিয়া (−) রেখে দিয়েই সমীকরণ সমাধান করার নিয়ম ছিল অজানা। এরূপ পরিস্থিতি আসলে প্রথমেই যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে, আল খোয়ারিজমি বলেন, তা হচ্ছে আল জাবর— অর্থাৎ সমীকরণের উভয়পাশে প্রয়োজনমতো সমপরিমাণ রাশি যোগ করে সমীকরণ থেকে ঋণাত্মক রাশিগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে
39 − x^2 = 10x
বা, 39 − x^2 + x^2 = 10x + x^2 [আল জাবর]
বা, 39 = 10x + x^2
বা, x^2 + 10x = 39
সমীকরণটি আল খোয়ারিজমি প্রস্তাবিত একটি প্রমিত রূপে পরিণত হলো। এরপর যে কাজটি করবেন তিনি তা হচ্ছে বামপাশে বর্গ সম্পূর্ণকরণ (completing the square)। তিনি দেখেন তাঁর সমীকরণের বামপাশে আছে x^2, যা x বাহুর উপর একটি বর্গ, এবং 10x, যাকে x ও 10 দৈর্ঘ্য-প্রস্থের একটি আয়তক্ষেত্র ধরা যায়। সমাধান বর্ণনার পাশাপাশি প্রমাণ হিসেবে, সমীকরণের বামপাশ নির্দেশ করার জন্য এভাবে একটি বর্গ ও আয়ত আঁকবেন তিনি।
তারপর আয়তটিকে সমান দুই ভাগে ভাগ করে এক অংশ আগের মতো বর্গের ডানে এবং অন্য অংশ বর্গের নিচে বিন্যস্ত করবেন এভাবে:
তারপর তিনি দেখতেন ডানদিকে নিচের ফাঁকা ক্ষেত্রটি যদি ভরাট করা হয়, অর্থাৎ সমীকরণের বামপাশের সঙ্গে যদি এ ক্ষেত্রটি যোগ করা হয়, তাহলে (x + 5) বাহুবিশিষ্ট একটি বৃহত্তর বর্গ পাওয়া যায়। এখন ছোট ক্ষেত্রটি হচ্ছে 5 বাই 5 মাপের একটি বর্গক্ষেত্র যার ক্ষেত্রফল 25 বর্গ একক।
সুতরাং আল খোয়ারিজমির বামপক্ষ এখন দাঁড়াবে
x^2 + 5x + 5x + 5.5 বা (x + 5)^2
কিন্তু সমীকরণের সমতা বিধানের জন্য বামপক্ষে কোনো রাশি যোগ করলে ডানপাশেও সম পরিমাণ রাশি যোগ করতে হবে। অর্থাৎ আল খোয়ারিজমি এ পর্যায়ে আরেকটি আল জাবর প্রক্রিয়া প্রয়োগ করবেন এবং ডানপাশ দাঁড়াবে
39 + 5.5 বা 64
সুতরাং (x + 5)^2 = 64
বা, x + 5 = √64 (আল খোয়ারিজমি এখানে ঋণাত্মক মূলটি বাদ দিতেন কারণ, পূর্বেই বলেছি, ঋণাত্মক সংখ্যা সে যুগে তেমন বিকাশ লাভ করেনি।)
বা, x + 5 = 8
বা, x + 5 = 5+3
এখন আল খোয়ারিজমি বামপক্ষে শুধু অজানা রাশি রাখার জন্য উভয় পক্ষ থেকে 5 বাদ দিবেন বা কাটাকাটি করবেন। উভয় পক্ষ থেকে সমতুল্য পরিমাণ রাশি কাটাকাটি করাকে বলা আল মুকাবালা।
সুতরাং আল খোয়ারিজমির চূড়ান্ত সমাধান হবে
x = 3
“কী মজার, আর কঠিনও নয় তেমন, বাবা!” বিস্ময়ে বলে উঠে মানহা।
“এখানে উল্লেখ্য, ঋণাত্মক সমাধান গ্রহণ না করলেও আল খোয়ারিজমি সকল ধনাত্মক সমাধান যথাযথ গ্রহণ করতেন এবং তিনি জ্ঞাত ছিলেন যে দ্বিঘাত সমীকরণের দুটি সমাধান হয়। উদাহরণস্বরূপ, তিনি প্রমাণ করেন
x^2 + 21 = 10x
সমীকরণটির দুটি সমাধান: x = 3 অথবা x = 7।”
প্রাচীন এক মহাপ্রাণের গল্প চালিয়ে যেতে থাকি আমি, মুগ্ধ হয়ে শোনে মেয়েরা। “আল জাবর ও আল মুকাবেলা এবং বর্গ সম্পূর্ণকরণ প্রক্রিয়া সুশৃঙ্খলভাবে ব্যাখ্যা করে আল খোয়ারিজমি একটি গ্রন্থ লেখেন, যার নাম আল কিতাব আল মুখতাসার ফি হিসাব আল জাবর ওয়া আল মুকাবালা (The Compendious Book on Calculation by Completion and Balancing)। গ্রন্থটি গণিতশাস্ত্রে প্রতিষ্ঠা করে সমীকরণ তত্ত্ব, সূচনা করে নতুন এক যুগের এবং পরবর্তী ছয়শ বছর ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যালয়সমূহে পঠিত হতে থাকে গণিতের প্রমিত পাঠ্যপুস্তক হিসেবে। গ্রন্থটি ইউরোপীয় রেনেসাঁয় গণিতের প্রসারে প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ গ্রন্থের দরুন স্বকীয়ভাবে আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ লাভ করে গণিতের শক্তিশালী শাখা অ্যালজেব্রা, আল জাবর শব্দ থেকে যার নামকরণ। মহাত্মা আল খোয়ারিজমিকে সম্মানভরে তাই আমরা বলি, বীজগণিতের জনক।”
“বীজগণিতের জনক কেন? তাঁর পূর্বে কি বীজগণিত ছিলই না?”
“আমরা যখন কাউকে সম্মানসূচকভাবে কোনো বিষয়ের জনক হিসেবে ভূষিত করি, এর মানে এই নয় যে তাঁর পূর্বে বিষয়টির কোনো রূপে কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারবে না। এর মানে হচ্ছে, বিষয়টিকে তিনি প্রথমবারের মতো সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করেছেন, দিয়েছেন বিষয়টির স্বকীয় ও স্বতন্ত্র পরিচয় যা ছিল না পূর্বে। আল খোয়ারিজমির পূর্বে প্রাচীন ব্যাবিলনের রাজকীয় জ্যোতির্বিদ, মিসরের উচ্চ পুরোহিত এবং ভারতীয় উপমহাদেশের আচার্যগণ দ্বিঘাত সমীকরণসংক্রান্ত একটি-দুটি সমস্যা বিক্ষিপ্তভাবে আরও অনেক গাণিতিক সমস্যার ভেতর আলোচনা করেছেন বটে। তবে তাঁদের সমাধানগুলো ছিল রহস্যময়, তালিকার মতো বা শ্লোকের মতো, মুখস্ত করে শুধু প্রয়োগ করতে হবে, কেন কাজ হবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু আল খোয়ারিজমি প্রথমবারের মতো সকল প্রকার দ্বিঘাত সমীকরণ এবং এদের সমাধানের সাধারণ নিয়ম সুবিন্যস্তভাবে ব্যাখ্যা করেন, একটি-দুটি বিশেষ সমস্যা আলোচনা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার: তিনি প্রমাণ করে দেখান কেন সমাধানটি কাজ করে এবং পরবর্তী গণিতবিদগণকে তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত করেন, অ্যালজেব্রা শাখার নামকরণই যার প্রমাণ। এজন্যই তাঁর এই সম্মাননা।”
“বুঝেছি, বাবা,” মানহা বলে।
________________
প্রথম প্রকাশ: Stargazer & Ropestretcher
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ২:৪৪