“এবার আরেকটি বক্ররেখা নিয়ে আলোচনা করা যাক। তোমরা জান, চাঁদ পৃথিবীর একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ, যা পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে।”
“হ্যাঁ, বাবা,” ফারিন বলে এবার। “চাঁদ ২৯ দিনে একবার আমাদের পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে যায়।”
“আসলে চাঁদ যেমন পৃথিবীর টানে ঘুরছে, পৃথিবীও তেমনি চাঁদের টানে ঘুরছে,” আমি বললাম।
“কিন্তু পৃথিবী কীসের চারদিকে ঘুরছে, চাঁদের চারদিকে নিশ্চয়ই নয়?” প্রশ্ন করে মানহা।
“ব্যাপারটি বোঝার জন্য,” হেসে বলি আমি, “মনে করো সুবিশাল মহাকাশে আর কিছুই নেই, কেবল পৃথিবী আর খুব দূরে দুটি তারা ছাড়া। তারা দুটি নিখুঁত গোলকের মতো, আকারে ও ভরে ঠিক সমান। মহাকর্ষের নিয়মে পরস্পরকে টানছে তারা দুটি, টানছে পৃথিবীকেও। পৃথিবীও তারা দুটিকে টানছে নিজের দিকে। কিন্তু তারা দুটি পৃথিবী থেকে এত দূরে অবস্থিত যে তারা ও পৃথিবীর মধ্যে টান খুবই ক্ষীণ, প্রায় শূন্য। অন্যদিকে তারা দুটি পরস্পরের টান জোরালোভাবে অনুভব করার মতো যথেষ্ট কাছে রয়েছে। এই টান বা মহাকর্ষের কারণে তারা দুটি একজায়গায় স্থির থাকবে না, ঘুরতে থাকবে। এখন পৃথিবী থেকে কোনোভাবে তারা দুটি যদি আমরা দেখতে পেতাম, তাহলে কী দেখতাম, একটি তারার চারপাশে ঘুরছে অন্য তারাটি?”
বিষয়টি নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবে মানহা। তারপর বলে, “না, তারা দুটি যেহেতু সবদিক দিয়ে পরস্পরের সমতুল্য, মহাকর্ষের প্রভাবে দুটোই সমানভাবে ঘুরবে। সুতরাং সমান দূরত্বে থেকে একই কক্ষপথে ঘুরা উচিত তাদের।”
“তার মানে আমরা বলতে পারি, তারা দুটির কোনো একটি অন্যটিকে কেন্দ্র করে ঘুরবে না, বরং উভয়েই তাদের কেন্দ্রদ্বয়ের সংযোগকারী রেখাংশের ঠিক মধ্যবিন্দুকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে এবং যেকোনো একটি মুহূর্তে তারা দুটি অবস্থান করবে কক্ষপথের ব্যাসের দুই প্রান্তে।”
“হ্যাঁ।”
“আমরা তারা দুটির ভর সমান বিবেচনা করেছিলাম। কিন্তু একটি তারার ভর যদি অন্যটির ভরের দ্বিগুণ হয়, তাহলেও কি তারা আগের মতো একই কক্ষপথে পরিভ্রমণ করবে?”
“না,” আবারও খানিক ভেবে বলে মানহা, “যে তারাটি ছোট তার উপর মহাকর্ষ টানের প্রভাব হবে বেশি, তাই এটি বড় কক্ষপথে বেশি পরিমাণ ঘুরবে। অন্যদিকে বড় তারাটি ঘুরবে ছোট কক্ষপথে, কম পরিমাণ। এরকমই হওয়া উচিত।”
“ঠিক বলেছ। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে আমরা দেখতে পাব, তারা দুটি তাদের মাঝের একটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার দুটি ভিন্ন কক্ষপথে যেন পরিভ্রমণ করছে। এই বিন্দুটির অবস্থান হবে তুলনামূলকভাবে বড় তারাটির কাছে, ছোট তারাটি থেকে দূরে। এখন কোন তারা থেকে ঠিক কত দূরে হবে বিন্দুটির অবস্থান, তা নির্ভর করবে তারা দুটির ভরের উপর। যেহেতু বড় তারার ভর ২ গুণ, তাই এর কেন্দ্র থেকে বিন্দুটির অর্থাৎ কক্ষপথের কেন্দ্রের দূরত্ব হবে ছোট তারার কেন্দ্র থেকে কক্ষপথের কেন্দ্রের দূরত্বের অর্ধেক বা ১/২ গুণ।”
“বুঝতে পেরেছি, ভরের অনুপাতের ঠিক উল্টো দূরত্বের অনুপাত।”
“মহাকাশে পরস্পরের সাপেক্ষে প্রদক্ষিণরত যেকোনো দুটি বস্তুর ক্ষেত্রে সবসময় এরূপ একটি বিন্দু পাওয়া যায়, যার চারপাশে বস্তুদ্বয় প্রকৃতপক্ষে পরিভ্রমণ করে থাকে বলে প্রতীয়মান হয়। বিন্দুটিকে বলা হয় বস্তু দুটির সাধারণ ভরকেন্দ্র বা ব্যারিসেন্টার (barycenter),” আমি বললাম।
“বড় বস্তুটির ভর যদি ১০০ গুণ হয়, ব্যারিসেন্টার-এর অবস্থান হবে ছোট তারার তুলনায় বড় তারার ১০০ গুণ কাছে,” মানহা বলে। “তাহলে তো ক্ষেত্রবিশেষে ব্যারিসেন্টারটি বড় বস্তুর ভেতরেও চলে আসতে পারে!” বিষয়টি চিন্তা করে একটু অবাক হয় সে।
“ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটে পৃথিবী ও চাঁদের ক্ষেত্রে,” হেসে বলি আমি। “পৃথিবীর ভর চাঁদের ভরের প্রায় ৮১ গুণ এবং পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব মোটামুটিভাবে ৩৮৫০০০ কিলোমিটার। সুতরাং পৃথিবী ও চাঁদের ব্যারিসেন্টারটি পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩৮৫০০০×১/(১+৮১) বা ৪৬৯৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে। কিন্তু পৃথিবীর ব্যাসার্ধই হচ্ছে প্রায় ৬৩৭০ কিলোমিটার। এর মানে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬৭৫ কিলোমিটার দূরে পৃথিবীর অভ্যন্তরে পৃথিবী ও চাঁদের ব্যারিসেন্টারটির অবস্থান। কাজেই কেউ যদি পৃথিবী ও চাঁদের কক্ষতলের উপর কিংবা নিচ থেকে তাকিয়ে দেখতে পেত, সে দেখত চাঁদ যেন ঠিক পৃথিবীকেই প্রদক্ষিণ করছে; আর পৃথিবী তার জায়গা থেকে পুরোপুরি সরে না গিয়ে ক্রমাগত মোচর খাচ্ছে, একটি মোটা রিঙের ভেতর একটি রড আটকিয়ে রিঙটিকে রডের চারদিকে ঘুরালে যেরকম দেখতে, অনেকটা সেরকমভাবে। কিন্তু সুক্ষ্মভাবে হিসেব করলে সে বুঝতে পারবে, চাঁদ ঘুরে না যথার্থভাবে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে,পৃথিবী ঘুরে না চাঁদের চারপাশে, বরং তারা উভয়েই ঘুরে তাদের ব্যারিসেন্টারকে কেন্দ্র করে।”
“চাঁদের কক্ষপথের ব্যাপারটি অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে এখন, বাবা।”
“এতক্ষণ আমরা তারা দুটির কক্ষপথকে বৃত্তাকার বিবেচনা করেছি,” আলোচনা চালিয়ে যেতে যেতে বলি আমি। “বৃত্তাকার ছাড়া অন্য আরেক ধরণের কক্ষপথেও তারা দুটি পরিভ্রমণ করে স্থিতিশীল থাকতে পারে। তারা দুটির ভর সমান হলে, ব্যারিসেন্টারকে প্রতিমুহূর্তে ঠিক মাঝখানে রেখেই এরা নিচের ছবির মতো ভিন্ন দুটি কক্ষপথ সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ এরূপ ক্ষেত্রে তারা দুটির দূরত্ব সবসময় সমান থাকবে না, বরং ঘুরতে ঘুরতে তারা দুটি একসময় পরস্পরের সবচেয়ে কাছে চলে আসবে (যখন প্রথম তারা A1 ও দ্বিতীয় তারা B1 অবস্থানে), অন্যসময় চলে যাবে সবচেয়ে দূরে (যখন প্রথম তারা A2 ও দ্বিতীয় তারা B2 অবস্থানে)।”
“ঠিক দুটি চ্যাপ্টা বৃত্ত!” ফারিন বলে।
“হ্যাঁ, চ্যাপ্টা বৃত্তই যেন, যদিও একে আমরা বলি উপবৃত্ত,” হেসে বলি আমি। “আসলে মহাকাশে নিখুঁত বৃত্তাকার কক্ষপথ বিরল, প্রায় সকল আবদ্ধ কক্ষপথই উপবৃত্তাকার। উপবৃত্তাকার কক্ষপথ কতটুকু দীর্ঘ হবে, কতটুকু চাপা হবে, নির্ভর করে কখন কোথায় কীভাবে মহাকাশের বস্তুগুলির সৃষ্টি হয়েছিল এরূপ নানা বিষয়ের উপর।”
“তাহলে পৃথিবী এবং চাঁদের কক্ষপথও উপবৃত্তাকার?” মানহা প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ। এ কারণে যখন আমরা বলি পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব, আমরা বুঝাই পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে চাঁদ যখন চলে আসে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে, তাকে আমরা বলি চাঁদের অনুভূ (perigee) অবস্থান। ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ যখন আবার চলে যায় পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে, তাকে আমরা বলি চাঁদের অপভূ (apogee) অবস্থান। কক্ষপথ যেহেতু বৃত্তাকার নয়, তাই ব্যারিসেন্টারকে আমরা কেন্দ্র বলি না, বলি কক্ষপথের ফোকাস (focus)। পৃথিবী ও চাঁদের ব্যারিসেন্টার যেহেতু পৃথিবীর ভেতরে অবস্থিত, তাই সাধারণভাবে আমরা বলে থাকি, পৃথিবীই হচ্ছে চাঁদের কক্ষপথের ফোকাস।"
“কিন্তু, বাবা, পৃথিবীর তো সূর্যের চারদিকেও একটি কক্ষপথ রয়েছে?”
“ঠিক বলেছ। পৃথিবী বা সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহের কক্ষপথ বলতে আমরা সাধারণত সূর্যের চারদিকের কক্ষপথটিই বুঝিয়ে থাকি। এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম শুধু মাত্র দুটি করে বস্তু নিয়ে, অর্থাৎ দুটি তারা কিংবা পৃথিবী ও চাঁদ নিয়ে। এ ধরণের আলোচনাকে বলা হয় দ্বি-বস্তু সমস্যা (two-body problem) সংক্রান্ত আলোচনা। বাস্তবে মহাকাশে, এমনকি আমাদের সৌরজগতেই, রয়েছে নানা ধরণের অগুনতি বস্তুসমূহ। বস্তুর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জটিল হতে থাকে কক্ষপথের হিসেবনিকেশ, কিন্তু দ্বি-বস্তুর যে মূলনীতিগুলো আমরা আলোচনা করলাম, তা বহু-বস্তুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তা প্রয়োগ করেই বিশ্লেষণ করা হয় বহু-বস্তু সমস্যা (many-body problem)।”
একটু থেমে আবার বলি আমি, “তো চাঁদের কক্ষপথ বলতে আমরা বুঝাই, পৃথিবীকে ফোকাসে রেখে চাঁদ যেভাবে পরিভ্রমণ করে। পৃথিবীর কক্ষপথ বলতে আমরা বুঝাই, উপরোক্ত ফোকাসের চারদিকে মোচড় খেতে খেতে, চাঁদকে টেনে টেনে নিয়ে, সূর্যকে ফোকাসে রেখে যেভাবে পরিভ্রমণ করে পৃথিবী, অন্যান্য গ্রহের মতো। আবার সূর্যও যেমন সৌরজগতের ব্যারিসেন্টার, যা অধিকাংশ সময় সূর্যের ভেতরেই থাকে, ঘিরে মোচড় খায়, তারও রয়েছে আরেকটি কক্ষপথ: তা হচ্ছে পুরো সৌরজগতকে সাথে নিয়ে আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গার (the Milky Way) ঘূর্ণন কেন্দ্রকে ঘিরে যে পথে পরিভ্রমণ করে সূর্য। আকাশগঙ্গারও কি রয়েছে কক্ষপথ? তা বিস্তারিত আলোচনা করব আরেক দিন, মহাকর্ষ তত্ত্ব (law of universal gravitation) ও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (general theory of relativity) নিয়ে আলোচনার সময়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০২