আজকে বলছি চিলেকোঠার প্রেম এর পিছনের গল্পটা। হুট করেই বিয়ে করে ফেলেছিলো এই গল্পের নায়িকা। বাবার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে উঠে এসেছিলো চালচুলোহীন কিন্তু খুব মেধাবী শুভ্রের চিলেকোঠার এক কামরার ঘরে। এডভেঞ্চার এবং এক্সাইটমেন্টে সাজিয়েছিলো সেই ভালোবাসার টোনাটুনির এক কামরার নীড়। ভেবেছিলো অসাধারণ মেধাবী শুভ্রের অর্থনৈতিক দিক কিছু কম হতে পারে তবে মেধা ও বুদ্ধির জোরে শুভ্র ছাড়িয়ে যাবে সবাইকে একদিন। প্রেমে পড়লে বুঝি এমনই পাগল হয় মানুষ। তবে স্বপ্ন ও বাস্তব বেশিভাগ সময় দু রকম হয়। তাই হয়েছিলো এ গল্পের নায়িকার জীবনেও। অবশেষে যা হয় তেলে আর জলে মিশ খায় না। শুভ্রের দৈন্যতা ও নায়িকার শ্বাসত সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্বন্দে নিয়ে গিয়েছিলো দু'জনকেই। অবশেষে যা হবার তাই হলো- বিচ্ছেদ। সেটাই অবধারিত ছিলো। সেটাই হয়েছিলো। কিন্তু গল্পের পিছনের গল্পের মত বিচ্ছেদের পিছনেও অনেকগুলো সুমধুর দিন থাকে। মায়াময় স্মৃতি থাকে আর থাকে কিছু বেদনাময় ইতিহাস।
এই গল্পের সত্যিকারের নায়ক কোনো কবিতা বা গানের মানুষ না। সে রক্তমাংসে গড়া এই রং রসের অপরূপ পৃথিবীরই এক আশ্চর্য্য মানুষ ছিলো। তার বুদ্ধিমত্তা, অসাধারণ বিশ্লেষনী ক্ষমতা ও আউট অব দ্যা বক্স ভাবতে পারার দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। যে কোনো সমস্যার সমাধান ছিলো তার আঙ্গুলের ডগায়। ভীষন পড়ুয়া আর সব সময় আমার পাশে আমার সকল আনন্দ বেদনা গান ও বিপদে বা আপদে ছায়ার মত ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা এক বন্ধু ছিলো সে। শুভ্র এমন একজন মানুষ ছিলো যার উপরে অনায়াসে নির্ভর করা যায়। নির্ভার হওয়া যায়। তবে সে শুধু আমার বন্ধুই ছিলো অনেক কটা বছর জুড়ে। ভীষন বিশ্বস্ত একজন মানুষ। যাকে বিশ্বাস করা যায় এবং একজন খাঁটি মানুষ ভাবা যায়। সে ছিলো বন্ধুর চেয়েও অনেক বড় এক বন্ধু সজন যাকে মনের কথা সবই নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাকে কখনও ভাবিনি কোনো মেয়ে বন্ধু বা ছেলে বন্ধু সে ছিলো শুধুই একজন বন্ধু।
তাই তো আমি প্রথম পর্বে লিখেছিলাম- তাকে আমার কখনও ছেলে বা মেয়ে বন্ধু এমন করে জেন্ডারের হিসাবেও বন্ধু মনে হয়নি। সে নারী পুরুষ সকল কিছুর উর্ধে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। সে ছিলো আমার অতি বিশস্ত শুধুই এক বন্ধু। যাকে দিয়ে আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম। সে দিন বললে দিন আর রাত বললে রাতই মনে হত আমার। এত বিশ্বাস আমি আমার জীবনে কাউকেই করিনি। এত কনভিন্স আমি কখনও কাউকে দিয়ে হইনি। যাইহোক এই বন্ধুটাই ছিলো সেই গল্পের শুভ্র। তার সকল স্বভাব চরিত্র তার অনেক কথকতা আমি যেমন এই গল্পে এনেছি তেমনি অনেক কিছু কল্পনা বা অন্য কোনো বাস্তব ঘটনা থেকেও আর কিছু অবাস্তব ঘটনা থেকেও। যেমন প্রথম পর্বে আমি লিখেছি -
যেদিন বিয়ে করলাম সেদিন সকালবেলায় যখন মাকে জানিয়েছিলাম। মা তখন সবে মর্নিং ওয়াক সেরে এসে তার বেডরুমের প্রিয় বারান্দায় বসে তার প্রিয় পাখিদের সাথে মর্নিং টিকাপ হাতে বসেছিলেন। আমি যখন জানালাম আজ আমি একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। মা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বললাম মা এত অবাক হবার কিছু নেই। তুমি যে তোমার আনিসভাইকে ছেড়ে আমার বিত্তশালী বাবার সাথে বিয়ে করে ফেলেছিলে একদিন, তোমার বদরাগী বাবার ভয়ে সেটা আমি জানি। আর সেই কারণে তোমার আনিস ভাইও যে সেই রাতেই আত্মহত্যা করেছিলো সেই কথাটাও আমি জানি। এ নিয়ে সারাজীবন তুমি এক গোপন দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছো......
এই কথাগুলি এতটাই কাল্পনিক যে আমার ইহজীবন তিহ জীবন বা ইহলোক পরলোক, তার পরের পরের লোকেও কোথাও আমি আমার বদরাগী মাকে বলতে পারি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। তবে আমার গল্পে ভেবেছি এবং লিখেছি কারণ এটা আমার সুপ্তমনের ইচ্ছা ছিলো। আজ মনে হয় অনেক কিছু যদি ভয় না পেয়ে মাকে মনের কথা খুলে বলতে পারতাম। হা হা না পেরেছি তো কি আমার লেখায় তো বলে দিলাম!
পর্ব ২ ছিলো পুরোটাই কল্পনা। অমন রাত কখনও কোনোদিন আমার জীবনে এসেছিলো কিনা সেটা বলছি না তবে এই পর্বের পুরোটুকুই ছিলো মস্তিস্ক প্রসুত কাল্পনিক।
পর্ব- ৩ - এখানে আমার ঘরবাড়ি গুছানোর যে একটা চিরায়ত অভ্যাস আছে তা দিয়েই কল্পনা ও দিব্য দৃষ্টি দিয়ে কেমন করে সাজাবো গুছাবো ঘর সেসবই লিখেছিলাম- এই সাতদিনে আমি শুভ্রর এই চিলেকোঠার ঘরটার হতচ্ছাড়া চেহারাটা অনেকটাই বদলে দিয়েছি। প্রথমে অবশ্য শুভ্রই এর সূচনা ঘটিয়েছে। আর সব কিছু সহ্য হলেও ওয়াশরুমের ভয়ংকর অবস্থাটা আমি কিছুতেই সহ্য করে উঠতে পারছিলাম না। ওয়াশ রুমে যেতে হলেই আমার করুন চেহারা দেখে শুভ্র ঠিকই বুঝে ফেললো আমার মনের অবস্থা। তাই একদিন সকালে নিজেই ঝেঁড়ে মুছে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলো সব ভাঙ্গা চোরা পুরান বালতি মাগ, কাপড়ের দড়িদাড়া সব কিছু। উফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। আর সেই সুযোগে তড়িঘড়ি আমিও সেদিন বিকেলেই ওর সাথে গিয়ে নিয়ে এলাম নতুন ঝকঝকে তকতকে যা কিছু প্রয়োজন ওয়াশরুম আর কিচেনের জন্য। এর পর এই চিলেকোঠার চেহারা বদলাতে উঠে পড়ে লাগলাম। মেঝেতে ফ্লোরম্যাট বসিয়ে জানালার পর্দা বদলে ফেলে, চাদর বালিশ টেবল ক্লথ বদলে সাফ সুতরো করে বলতে গেলে একেবারেই গ্রান্ড সুলতান লুক না হলেও গাজীপুরের যেকোনো সুন্দর রিসোর্ট লুক বানিয়ে ফেললাম।ঘরের সামনে রঙ্গিন ফুলের ছোট ছট টবও বসিয়ে দিয়েছি। এখন এই এই চিলেকোঠাই আমার স্বর্গ। মাঝে মাঝে নিজেই তাকিয়ে মুগ্ধ হই নিজের কারিশমায়।
আর এ পর্বের বাড়িউলী বউটা তাকে এঁকেছি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির মাঝে একটি উপন্যাস গজেন্দ্রকুমার মিত্রের উপকন্ঠের শ্যামা ঠাকুরনের বাড়ির বাড়িউলি বৌ মঙ্গলার আদলে। সেদিন বাড়িওয়ালার বউ এসে তো তার এই বিদঘুটে রুমের বদখত চেহারার ভোল পালটে যাওয়া দেখে একেবারেই টাসকি খেয়েছিলো। গালে হাত দিয়ে বসেছিলো সে আমার দেশী শপগুলো থেকে কিনে আনা রঙচঙা রিক্সা পেইন্টের ছোট টি-টেবল সেটের টুলটাতে । চারিদিকে তাকিয়ে তুকিয়ে শেষে পান দোক্তা খাওয়া মুখে বলেই ফেললো, বাব্বা ধন্যি মেয়ে বটে। চোখের পলকে দেখতেছি রাতকে দিন বানায় ফেলছো। তা বাবা তোমাকে দেখে তো বড় ঘরের মেয়ে মনে হয়। কোন বুদ্ধিতে এই নির্বুদ্ধির কাজটা করলা বলোতো! রোজগার নাই, পাতি নাই তো তোমার স্বামী খাওয়াবেটা কি?
পর্ব ৪ এর কথা বলতে চাই না। অর্ধেক তার গড়িয়াছি সত্যে অর্ধেক তার কল্পনায়। হা হা
পর্ব ৫ - যদিও বলতে গেলে ৯০% কল্পনায় লেখা তবে শুভ্র ও তার বাবা আর মায়ের ছবি দেখে এবং তাদের ফেসবুকের কার্য্যকলাপ ও ছবিগুলি দেখে আন্দাজ করে নিয়ে লিখেছিলাম।
পর্ব ৬ এই পর্বের অনেকখানিই জীবন থেকে নেওয়া। কার জীবন থেকে নাই বা বললাম।
পর্ব ৭ এর সদাই হরিশ শ্বশুর মশায়ের সাথে আমি মিশিয়ে দিয়েছি আমার নিজের খাদ্যরসিক বড়মামার স্বভাবটিকে। আর পিয়ানোর কথা সত্যিই শুভ্র বলেছিলো একদিন। তবে সে কথা রাখেনি। তাই আজ আমি আমার নিজের পিয়ানোই বাজাচ্ছি।
পর্ব ৮- গল্পে বর্নিত এমন একটি বাসায় আমি সত্যিই কখনও ছিলাম। আর বাকীটুকুর বিষয়ে বলতেই চাই না। হা হা
পর্ব ৯ এবং ১০- পর্ব ৯ এবং ১০ ভীষন ভীষন সত্যি সব ঘটনায় ঘেরা। তবে আমার জীবন থেকে নাকি অন্যের জীবন থেকে তা খোলাসা করলাম না। কিন্তু অমন সব খানাপিনা খেতে ইচ্ছে করেছিলো আমার কোনো এক সময়। এখনও করছে।
পর্ব১১ ) ১২- ভীষন রকম কল্পনায় ঘেরা লেখা।
পর্ব ১৩ - কাল্পনিক বটে তবে শুভ্র ঠিক অমনই ছিলো। অমনই স্বভাবের আর অমনই সব কান্ড করতো।
পর্ব ১৪- খুব একটা কাল্পনিক না। অমন করেই কখনও কোনোদিন সুন্দরবন বা কুয়াকাটা গিয়েছিলাম আমরা।
পর্ব ১৫ - প্রায় এমন করেই দেখা কুয়াকাটা ভ্রমন একটু অদল বদল করে লেখা
পর্ব ১৬ - কাল্পনিক কিন্তু শুভ্র ঠিক অমনই ছিলো উদাসীন ও ভীষন নির্লিপ্ত।
পর্ব - ১৭ অধিকাংশই কাল্পনিক। তবে অনেক কেঁদেছি এ পর্ব লিখতে গিয়ে।
পর্ব ১৮- সত্য এবং কাল্পনিকের মিশেলে রচিত।
পর্ব ১৯- সবচেয়ে বেশি মন দিয়ে মনে হয় লিখেছিলাম এই পর্বটাই। বলতে গেলে পুরোটাই কল্পলোকের এই লেখাটা তখন আমার হৃদয় মাঝারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এত কেঁদেছি লিখতে গিয়ে।
পর্ব ২০ ও শেষ পর্ব- পুরোটাই বলতে গেলে কাল্পনিক নহে। শুভ্রের সাথে আমার বন্ধুত্বের বিচ্ছেদের কারণ ও ডায়ালগগুলোই জুড়ে দিয়েছি এখানে।
প্রথম পর্বে লিখেছিলাম- দেবতা বা মহাপুরুষের প্রেমে মানুষ পড়তে পারে না। শুধুই শ্রদ্ধা করতে পারে। সেও কারো প্রেমে পড়তে পারে, তাও আবার আমার এও আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু এরপরেও বুঝলাম সে আমার প্রেমে পড়েছে মানে সে প্রেমে পড়েই গেলো এবং সে কথা আমাকে জানালো। এভাবে এক সাথে থাকতে থাকতে কখন সে আমাকে এইভাবে ভালোবেসে ফেলেছে নিজেও তা বুঝতে পারেনি। আমি তাকে ভালোবাসতাম ঠিকই কিন্তু তা ঠিক প্রেমে পড়ার মত নয়। কিন্তু তার সেই আহ্বান আমি উপেক্ষা করতে পারলাম না। এতদিনের এমন একজন বিশস্ত নির্ভরযোগ্য বন্ধুকে কি করে ফেরাবো আমি? কি করে উপেক্ষা করবো তাকে? তাকে ছাড়া জীবনে চলাটা তখন প্রায় অসম্ভব আমার কাছে।
আমি গভীর চিন্তায় পড়লাম। আমি বুঝতে পারছিলাম তার প্রস্তাবে রাজী না হলে আমাদের এই বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে। কারণ আমি তাকে বন্ধুর জায়গায় প্রেমিক না ভাবতে পারলেও সে যথারিতী ভাবতে শুরু করেছে। এই ভাবনা থেকে তার আর পরিত্রান নেই।
গল্পে লিখেছি- এরপর আর দূরে থাকতেই চাইলাম না আমরা। আর তাই এক আলো ঝলমল বসন্ত সকালে আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরেই ফেললাম।
হ্যাঁ গল্পটা জীবনেরও এমনই হতে পারত বা হত যদি আমি সেদিন শুভ্রের প্রস্তাবে রাজী হয়ে বাবার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এসে শুভ্রের হাত ধরে ঐ চিলেকোঠায় উঠতাম।
তবে না আমি কোনো কাজী অফিসে যাইনি। কোনো চিলেকোঠাতে জীবনে এক পাও দেইনি। শুধু শুভ্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার পর বসে বসে ভেবেছি। যদি এমন হত, চলেই যেতাম আমি শুভ্রের সাথে ওর ঐ চিলেকোঠার কামরায় তবে কেমন হত। সেই কেমন হত নিয়েই একের পর এক কল্পনায় ভেসেছি আমি আর লিখে গেছি চিলেকোঠার প্রেম।
কাজেই চিলেকোঠার প্রেমের শুভ্রর অস্তিত্ব ঠিকই ছিলো আমার জীবনে কিন্তু তার সাথে চিলেকোঠার প্রেমটা ছিলো শুধুই কল্পনা। এই সব কল্পনাই সত্যি হত যদি শুভ্রের প্রস্তাবে সেদিন রাজী হয়ে যেতাম। তারপর কি হত জানিনা। তবে দিব্য চোখে দূরদৃষ্টিতে যাহা মনে হত তাহা নিয়েই রচনা করেছি আমার চিলেকোঠার প্রেম।
সবাইকে ভালোবাসা.....
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১:২২