এ কারণেই এক পৃথিবী মানুষের মাঝে শুভ্রই আমার জীবনের এক ধ্রুবতারা হয়ে থাকবে। শুভ্র নিজেও বোধ হয় সে কথা ভালোই জানে। আমার আজও মনে হয় আমার জীবনের যে কোনো চরম দূর্যোগেও আমি সবার প্রথমে শুভ্রকেই ভাববো। যে কোনো বিপদেও আমি তাকেই ডাকতে পারি অবলীলায় নির্দ্বিধায়। শুভ্র আমাকে ঠকাবে না। আমাকে তার যতটুকু দিয়ে সম্ভব তাই দিয়েই করবে সে আমার জন্য। এমনই বিশ্বাস আমার। সে তো শুধু আমার প্রেমিক বা হাসব্যান্ডই ছিলো না সে ছিলো আমার পরম বন্ধুও। আর ছিলো মানে অতীত হয়ে গেলেও সে আসলে আমার চিরজীবনের বন্ধুই। হয়ত এভাবেই থাকবো আমরা সারাজীবন।
লোকে বলবে তা কেনো? যেই সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছো তার সাথেই আবার কিসের এত দহরম মহরম। নির্লজ্জ বেশরম বলতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা হবে না কারো। সে আমি বেশ জানি। কিন্তু ভাবি, পৃথিবীতে মা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট হয় না, ভাই বোনের সম্পর্কও নষ্ট হয় না বলতে গেলে কোনো সম্পর্কই নষ্ট হয় না তেমন কিন্তু হাসব্যান্ড ওয়াইফ বা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সে নষ্ট হলে সে চিরতরে চিরনষ্ট হতেই হবে। এমনকি নানী দাদী মা খালারাও এই সম্পর্ককে ভাঙ্গা থালা বাটি কাঁচের গ্লাস প্লেটের সাথে তুলনা করেন। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি কাঁচের গ্লাস থালা বাটির মত। একবার ভাঙ্গলে জোড়া লাগে না। লাগাতেও হয়না। মানে সোজা কথা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট হওয়া মানেই নাকি তারা দুজন শত্রু। মুখ দেখাদেখি হওয়া তো দূরের কথা তাদের কথা মনেও আনা বারণ সে নাকি পাপ! আমিও সেটাই জানতাম এবং মানতামও ।
কিন্তু শুভ্রই আমাকে বুঝিয়েছিলো এসব আসলে ভন্ডামী। আর এই ভন্ডামী জিনিসটাই দুনিয়াতে না থাকলে দুনিয়া অনেক সহজ ও সুন্দর হত। হ্যাঁ আসলেই তাই। শুভ্রই সঠিক। ভন্ডামী শিখেছি আমরা আমাদের অজান্তেই খুব ছোট থেকেই আমাদের মাথায় কিছু ভন্ডামী ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যা চিরসত্য বা ধ্রুবসত্য হয়ে আমাদের মস্তিস্কে প্রোথিত হয়ে গেছে। লুকিয়ে চুরি করে যে জন লক্ষ টাকা চুরি করছে সেই জনই আবার দুইটাকার চোরকে পিটাতে পিটাতে মেরেই ফেলে। মাথায় ঘোমটা টেনে ওড়না না পরা মেয়েদেরকে ধিক্কার দেয় যে জন সেই আবার ঘোমটার আড়ালে খেমটা নাচে। হায়রে ভন্ডামী। ভন্ডামীর জালে আটকা পড়ে থাকি আমরা। তাই এই নশ্বর জীবনে অবিনশ্বর কষ্ট দুঃখ ও কিছু ক্ষোভ নিয়ে নিরানন্দে কেটে যায় জীবন। কিন্তু এই ভান্ডামী কার জন্য? সমাজ, সংসার, পৃথিবীর কাছে নিজেকে ভালো প্রতীয়মান করার জন্য নিজের কাছেই হেরে থাকা?
সে যাইহোক আজ আমার মনটা ভীষন খারাপ। মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা। সন্তান হারাবার দুঃখ সন্তানের মুখ সেদিন না দেখেও আমি যা অনুভব করেছিলাম সেই অনুভূতিটাই চির স্মরনীয় হয়ে আছে আমার জীবনে। আজও মাঝে মাঝেই আমার মন কাঁদে সেই অনাগত সন্তানটির জন্য। ঠিক একই সাথে আমার মনে ভাসে আরও একটি মুখ। আমার চাইতেও বুঝি সেই শিশুটির জন্য তার চাওয়াটাই অনেক বেশি ছিলো। তার সেই চাওয়া এবং পাওয়া অপূর্ণ রেখেই চিরবিদায় নিতে হলো তাকে পৃথিবী থেকে। আমি বুঝিনা এই জগত সংসার এত বিচিত্র কেনো? এত বিচিত্র কেনো আমাদের অনুভুতিগুলো?
সেই চিলেকোঠার বাড়ি, সেই মফস্বল এলাকার ঝিমধরা ঘুঘুডাকা শীতল মেঝের শান্তিময় বাড়িটা কেনো বার বার আমার হৃদয়ে ভাসে?
সেই কঠিন কঠোর শ্বাসত চেহারার শ্বাশুড়িমায়ের মুখ, সদাই হরিষ শ্বশুরমশাই, চঞ্চলা হরিনীর মত কিশোরী ননদ শৈলী। সবাই তারা কেনো প্রায়ই আমার স্বপ্নে আসে? ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। জেগে উঠে দেখি চোখের জলে বালিশে ভিজে গেছে। লজ্জা লাগে, দ্রুত চোখ মুছে ফেলি আমি। সেসব রাতে হয়ত আমার আর ঘুম আসে না। জেগেই কেটে যায় বাকিটা রাত্রী।
এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে সেসব দিনগুলোতে। সেই চিলেকোঠার প্রথম দিন, সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা স্বর্গরাজ্য, শুভ্রের সাথে খুনসুটিময় ভালোবাসার গল্পগুলি এবং চিলেকোঠার শেষ দিন যখন তখন মনে পড়ে যায় আমার। মনে পড়ে শুভ্রের শেষ কথাগুলিও। আসলে শুধু শেষ কথা না শুভ্র বলেছিলো শুধু একটা না আমার অনেক কথাই কখনও ভোলা হবে না তোমার কখনও। শুভ্র অনেক কিছুই বুঝতে পারে, অনেক কিছুই জানে শুধু জানেনা অনেক কথাই না কোনো কথাই তার কখনও ভোলা হবে না আমার। এসব ভুলতে চেষ্টা করিনা আমি আর। আমি নিজের সাথে আর কোনো ভন্ডামীতে নেই। এই প্রতিজ্ঞাই আমার। শুভ্রের শিক্ষা।
মাঝে মাঝে আরও একটা কথা ভাবি। একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে দাম্পত্ত্য বা সংসার বলতে কি শুধুই একজন মানুষ নাকি তাকে ঘিরে থাকা সব ক'টি মানুষই থাকে আসলে। শুধু মানুষগুলিই নয় এই জীব ও জড়ের সংসারে প্রতিটা ইট কাঁঠ পাথর আসবাব এমনকি তৈজসেও যে মায়া জড়িয়ে থাকে সেই মায়া নিয়েও তো একটা বাঙ্গালী মেয়ের সংসার জীবন তাই নয় কি? তাই নিয়ে নিমগাছের মত শেকড় প্রোথিত হয়ে যায় তার সংসারের উঠোনের মধ্যিখানে। আর সেই সংসারের মায়া কাটিয়ে আসা মানে জীব ও জড় স্থাবর ও অস্থাবর সকল কিছুর মায়া কাটিয়ে আসা। এতই কি সহজ? এত মায়া কি কাটানো যায়? কিছুতেই না কোনো ভাবেই না। তবুও আমরা ভন্ডের মত মায়া কেটে গেছে এই অভিনয় করে চলি।
এই ভন্ডামী আর করবো না আমি। নিজের সাথে নিজের এই মিথ্যে অভিনয়ে আমি আর নেই। এই জগতে যা যা আমার ভালো লেগেছিলো যাকে যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম যেখানে যেখানে আমার মন ঘুরে বেড়ায় সবকিছু নিয়েই ভাববো আমি। আর কোথাও না হোক মনের ক্যানভাসে রং আর তুলি দিয়ে স্পস্ট রঙ্গিন করে আঁকবো সে সব ছবি। সাজিয়ে রাখবো মনের দেওয়ালে সেই সব গল্পগুলি। যতদিন বেঁচে থাকবো আমি আমার মত করেই বাঁচবো।
কিন্তু এই যে শুভ্রকে নিয়ে আমার জীবনের এক বিশাল অধ্যায় শুভ্রের বর্তমানে বা অবর্তমানে গেঁথে রইলো আমার জীবনে এই অধ্যায়ের শেষ নেই। শেষ হবে সেদিনই যেদিন আমার জীবনের শেষ হবে। জীবন শেষ হয়ে যাবে কিন্তু রয়ে যাবে এই স্মৃতির পাতা। কেউ হয়ত পড়বে না। পড়ুক বা না পড়ুক কি যায় আসে? তবুও কেনো লিখি আমি। এ প্রশ্নের উত্তর জানিনা। হয়ত লিখতে গিয়ে স্মৃতির রোমন্থনটাই আমার এক রহস্যময় ভালো লাগা। তবুও কি এই বিশ্বসংসারে এতটুকু সময় আছে মন খুলে লেখার। শুধু হঠাৎ চিন্তায় এসে যাওয়া স্মৃতিগুলি উথাল পাথাল করে আমার হৃদয়ের মনিতটে।
কি লিখতে এলাম আর কত কথাই না বলে গেলাম। আজ এই লেখার কারণটাই ছিলো গতকাল থেকে হঠাৎ মন খারাপের কারনটাই।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বেশ ভালোই কাটছিলো আমার নিত্য নৈমত্তিক ঝামেলাগুলি নিয়ে, কাজগুলি নিয়ে।হঠাৎ দুপুরের দিকে শুভ্র জানালো জলমোতী এবং তার আজ ভোরে আগত সন্তান দুজনকেই হারিয়েছে সে। স্মম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। সকল কিছুর মাঝে আমার অনেক বড় একটা সান্তনা ছিলো যেই শুভ্রকে মূল্য দিতে পারিনি আমি সঠিক সময়ে। যেই শুভ্রকে হারিয়েছি আমি বড় অবহেলায়। সেই শুভ্রকে যতনে আদরে রেখেছে যেই মেয়েটি সেই মেয়েটির উপর শ্রদ্ধা ছিলো আমার। আমি যা পারিনি সে তা পেরেছিলো। বলতে গেলে তার কাছে হেরে গিয়েছিলাম আমি। আমি হারতে ভালোবাসিনা। সকল কিছুতে জয় পেতে চাই আমি। কিন্তু তার কাছে হারে আমার কোনো লজ্জা ছিলো না । সেই জলমোতী হারিয়ে গেছে। ঐ চঞ্চলমতী সদা হাস্যজ্জ্বল মেয়েটা আর কখনও হাসবে না, কথা বলবে না। স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি এমনটা হতে পারে।
শুভ্র খুব অবলীলায় বলে যাচ্ছিলো কি কি হয়েছিলো। কিভাবে এত বড় দূর্ঘটনাটা হলো। সে কতটা শকড। কিন্তু আমি অতবড় একটা মর্মস্পর্শী ঘটনার পরেও শুভ্রের এই নির্লিপ্ত অবিচল ভাব দেখে বিস্মিত হলাম। মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জাগলো। শুভ্র কি আসলেই কাউকে কখনও ভালোবেসেছিলো। নাকি সে এই জীবন পথের এক মূর্তমান চলন্ত রেলগাড়ি। যে রেলগাড়িতে কিছু সময় পর পর যাত্রীরা ওঠে এবং নেমেও যায় আর তাতে রেলগাড়ির কোনো কিছু যায় আসে না।
আমি জানতাম এবং আজও জানি আমার যে কোনো বিপদে অথবা আনন্দে সবার আগে যার নামটা মনে পড়বে সে শুভ্র। শুভ্রেরও হয়ত তাই। তার বাবা এবং বোন সেখানে আছে বলে তারা সবই জানেন কিন্তু তারা এবং কিছু খুব কাছের আত্মীয় ছাড়া শুভ্র সবার আগে আমাকেই মনে করেছে। কিন্তু হায়! কি করে ওর এই বিপদে সাহায্য করবো আমি? এই ব্যথার সান্তনার বাণী কি? জানা নেই আমার.....
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ১১:২১