শুভ্রের সাথে হঠাৎ এইভাবে আবার দেখা হয়ে যাবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কারণ একই শহর, একই আকাশ, একই পৃথিবী তবুও কত শত আপনজনদের সাথে আমাদের দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দেখা হয় না। এ ব্যপারটা ভাবলে আমার বড় অবাক লাগে! শুভ্রের সাথেও গত পাঁচ বছরের এতগুলো দিনে একটাবারও দেখা হয়নি আমার, কথাও হয়নি আর। তাই আমি সে আশা ছেড়েও দিয়েছিলাম। শুভ্র আসলেই আজও আমার কাছে এক অবাক বিস্ময়! কি করে পারলো? কি করে পারলো মানে এই এতগুলো দিন আমার সাথে একটা কথাও না বলে থাকতে পারলো কি করে শুভ্র? মাঝে মাঝে এমনই ভাবি আমি আর বিস্মিত হই! আসলে আমার নিজেরই বড় কষ্ট হয়। শুভ্রকে ভীষন মিস করি আমি। তবুও নিজের ইগোর কাছে পরাজিত হতে পারিনি। আশা করেছি শুভ্রই যোগাযোগ রাখবে বা যোগাযোগের চেষ্টা করবে। কিন্তু শুভ্র তা করেনি।
অবশ্য কেনো করেনি এর উত্তর আমি জানি। মানে শুভ্রকে যদি প্রশ্ন করি তো সে এই জবাবটাই দেবে। সে বলবে আমি ঠিক যেভাবে পেরেছি সেভাবেই সেও পেরেছে বা তাকে পারতে হলো। কারণ শুভ্র কখনও কারো ইচ্ছা বা অনিচ্ছার মাঝে এন্টারফেয়ার করাটা পছন্দ করে না আর তাই আমি যেহেতু কোনো যোগাযোগের চেষ্টাই করিনি তাই সেও সেটাই করেছে। তবে আমি এও জানি যে আমি একবার ডাকলেই পৃথিবীর যত বড় কাজ থাকুক আর তার পরের যত প্রেমিকাই তার আসুক না কেনো শুভ্র সব ফেলে ঠিকই আমার কাছেই চলে আসবে। আর তাই আমি ওকে আর ডাকিনা। জানিনা কোন অভিমানে? আসলেই আমার ওর উপর কিসের অভিমান জানিনা আমি। বরং অভিমান তো ওরই হবার কথা ছিলো তাইনা?? ১০০ ভাগের ৮০ ভাগ দোষটাই আসলে আমার নিজেরই ছিলো এমনই মনে হয় আজকাল আমার। হয়ত এ আমার অন্ধ ভালোবাসা। নিজেকেই ক্ষমা করতে পারিনা আমি। নিজেকে ক্ষমা করিনা ওর জীবনটা নষ্ট করে দেবার জন্য।
কিন্তু আসলেই কি জীবনের কোনো কিছুই নষ্ট হয়? মনে হয় না কথাটা সঠিক। জীবনের প্রতিটি মূহুর্তই তো আসলে মূল্যবান! এই যে হাসছি, এই যে কাঁদছি, এই যে আনন্দে ভাসছি। এরই নামই তো জীবন। প্রতিটা মূর্হর্ত, প্রতিটা ঘটনাই এখানে মূল্যবান। শুভ্র আমার জীবনের সবচাইতে বড় মূল্যবান অধ্যায়। ঐ অধ্যায় আমাকে অনেক শিখিয়েছে। ঐ অধ্যায় আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। ঐ অধ্যায়ই আমাকে শিখিয়েছে ভালোবাসা নামে কি এ এক অমূল্য রতন আমাদের জীবনে অদৃশ্যে আসে। তারপর দৃশ্যমান হয়। সেই দৃশ্যমান অদৃশ্যের দোলাচলে বয়ে চলে যায় আমাদের এই নশ্বর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
মাঝে মাঝে ভাবি শুভ্রের এই আরেকজনের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা জীবনে আমি যে আজও অজান্তে উঁকিঝুঁকি দেই এটা কি সঠিক? আমারও নতুন করে যে জীবনটা শুরু হলো সেখানে মন না দিয়ে ফেলে আসা দিনে বার বার ফিরে যাওয়াটাও কি ঠিক হচ্ছে আমার? যদিও সশরীরে নয় মনে মনে চলে যাই আমি আমার পুরোনো অতীতে। কিন্তু সেই অতীত আর তার আর আমার বর্তমান মিলিয়ে কি এক কষ্ট, কি এক হাহাকার আমার মনে জেগে ওঠে। যা আমি কাউকেই কখনো বলতে পারিনা। আমি শূন্যতায় ভাসি। এ কি পাপ? এ কি অন্যায়! খুব ভালো করেই জানি লোকে শুনলে বলবে এ বড় অন্যায় এ অনেক বড় অপরাধ। যাদের সাথে নতুন করে পথ চলা শুরু হলো তাদের সাথে অন্যায়। তাদের কাছে অপরাধী আমি। কিন্তু মনের তো কোনো হাঁত পা বা শরীর নেই যে খাঁচায় বন্দী করে রাখবো তাকে।
সে যাইহোক, যে কারণে আজকের এই লেখার সূচনা। সেদিন আড়ং এ গিয়েছিলাম অনেকদিন পর। ইদানিং তেমন কোথাও যাই না আমি আর। ঘর আর অফিস আর মাঝে মাঝে কিছু সামাজিকতা ছাড়া প্রায় সব কিছু থেকেই গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। তো সেদিন কোনো কারণে নয় অকারনেই বের হয়েছিলাম। জরুরী কিছু নয় তবে খুব ঘনিষ্ঠ একজনের জন্মদিন উপলক্ষে উপহার কিনতেই সেখানে যাওয়া।
পাঞ্জাবীর সেকশনে নিজের মনেই ওদের ডিসপ্লের সার্কেলটাতে ঘুরিয়ে চলেছিলাম। পছন্দ হচ্ছিলোনা ঠিকঠাক তাই ঘুরিয়েই চলেছিলাম একটার পর একটা পাঞ্জাবী। হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। কিছু দূরেই শুভ্র আর তার সাথে হাসিখুশি বউটা । ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলাম আমি। ওরা আমাকে দেখেনি তাই চোখ নামিয়ে মাথা যতদূর সম্ভব নীচু করে আড়াল করা যায় নিজেকে সেভাবেই ফের অকারণ পাঞ্জাবী নির্বাচনে মন দিলাম। এদিকে এগিয়ে আসতে আসতেই ঐ চঞ্চলমতী মেয়েটা আবার অন্যদিকে চলে গেলো। ওরা আমার খুব কাছাকাছি ছিলো হঠাৎ শুভ্র ঘুরে দাঁড়ালো। এগিয়ে আসলো আমার দিকে। আমি মাথা তুললামই না।শুভ্র উল্টোদিকের রডটা ধরে থামিয়ে দিয়ে দাঁড়ালো আমার মুখোমুখি। হঠাৎ আমার চোখ জলে ভরে উঠেছিলো। তাই তাকাতে পারছিলাম না মানে মুখ তুলে তাকাতে চাইছিলাম না। অনেক কষ্টে সেটা সামলে ওর দিকে হাসিমুখে চাইলাম। যেন দেখিনি। হঠাৎ দেখলাম এভাবেই গলায় অভিনয় ফুটিয়ে বললাম।
- আরে তুমি? শুভ্র হাসলো। সেই ভুবন ভোলানো হাসি।
- হ্যাঁ আমি। কেনো গন্ধ পাওনি? দুষ্টুমী ওর চোখে। কি আশ্চর্য্য! এই নির্লিপ্ততা কোথায় পেয়েছে শুভ্র! নিজেকেই প্রশ্ন করি মনে মনে।
- গন্ধ আবার কি? জানতে চাইলাম আমি।
- চেনা মানুষের গন্ধ। এই যে আমি তো পেলাম। এ দিকটায় আসতেই গন্ধ পেলাম তুমি আছো কোথাও আশেপাশেই। চেনা চেনা তুমি তুমি গন্ধ। ঘুরে দাঁড়ালাম নিশ্চিৎ হতেই। ওর বলার স্টাইলে হেসে ফেললাম আমি। ওর বউ এগিয়ে আসলো। আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো,
- বাব্বা কি ভাগ্যি। আপনার সাথে দেখা হয়ে গেলো। কতবার বলেছি শুভ্রকে একটা বার একটু দেখতে চাই, কথা বলতে চাই আপনার সাথে। সে ফোন নাম্বারটা পর্যন্ত দিলো না। আচ্ছা বলেন দিলে কি হত? আজ দেখা যখন হয়েই গেলো। আপনাকে ছাড়ছি না। আজ ছুটির দিন আপনাকে যেতেই হবে আমাদের সাথে। আমাদের সাথে আজ খাবেন। একদম সন্ধ্যায় ছাড়া পাবেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হত বিহবল হয়ে পড়েছিলাম। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি। শুভ্র তখনও মিটি মিটি হাসছিলো। বললো,
- পড়েছো রাবনের হাতে, খানা খেতে হবে এক সাথে। জলমোতীকে তো চেনোনা। কোনোই ছাড় নেই আজকে। ইউ আর এরেস্টেড।
আমার কি যে হলো। আমি না করলাম না। হয়তোবা কৌতুহল কেমন আছে তারা? আমার গাড়িতেই উঠিয়ে নিলাম ওদেরকে। শুভ্র আবারও অবাক করে দিয়ে জলমোতীকে পিছের সিটে বসিয়ে নিজে বসলো সামনের সিটে। আমার ড্রাইভিং সিটের পাশেই। আমার বুকের মধ্যে হাতুড়ি বাঁজছিলো। ভাবছিলাম জলমোতী মেয়েটা নিশ্চয় ভীষন মাইন্ড করবে এই উড়নচন্ডী পাগলাটে শুভ্রের কান্ড কীর্তি দেখে।
কিন্তু জলমোতীর যেন শুভ্রের কান্ডে কোনোই মাথা ব্যথাই নেই। সে হাসি মুখে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো। আমি বুঝলাম শুভ্রকে ভালোবাসতে গেলে ওর মত করে ওকেই ভালোবাসতে হবে এটা এই পুচকে মেয়েটা কদিনেই বুঝে গেছে। যা আমি বুঝিনি আমাদের সেসব দিনে। শুভ্রকে আমি আমাদের মত করে দেখতে চেয়েছি, জোর করেছি, রাগ অভিমান অবশেষে বিসর্জন। কিন্তু ভালোবাসা তো একে বলে না। ভালোবাসা বলে জলমোতী শুভ্রকে যেভাবে ভালোবেসেছে ঠিক তেমনটাই। তবে কি আমি শুভ্রকে ভালোবাসিনি? দীর্ঘশ্বাস পড়ে আবারও। বার বার আনমাইন্ডফুল হয়ে যাচ্ছি আমি। বার বার ব্রেক চাপছি উল্টা পাল্টা। শুভ্র চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু মুখে ফুটে আছে সেই চিরায়ত হাসি।
প্রায়ই আমার ইচ্ছে হত দেখতে শুভ্র কেমন আছে তার নতুন জীবনে? প্রায়ই আমি কল্পনায় ঘুরে বেড়াতাম শুভ্র আর জলমোতীর অদেখা কোনো বাসা ঘর বাড়ি এবং ভালোবাসায়। সেই ইচ্ছেটাই পুরোন হলো আজকে আমার। আমি খুব খেয়াল করে দেখেছি আমি মন দিয়ে যা চাই তাই পাই। আমি আসলেই বড় ভাগ্যবতী। এমন কপাল নিয়ে খুব কম মানুষই জন্মায় পৃথিবীতে। এই পৃথিবীর অনেক অসফলতার মাঝেো তাই আমার সফলতার গল্পও কম নয়। শুভ্রের সাথে ডিসকনটিনিয়েশন এটাও আমারই চাওয়া ছিলো।
জলমোতী মেয়েটা আসলেই একটা লক্ষী মেয়ে তা তার সুচারু পরিপাটি ঘরবাড়ি আর চেহারা দেখে কাউকে আর নতুন করে বলে দিতে হবে না। সে অপরিসীম দক্ষতায় বাকী একঘন্টার মাঝে ৩ রকমের মাছের কারী আর ভর্তা ভাজী এমনকি গরুর মাংসের দোঁপেয়াজাও রান্না করে ফেললো। শুভ্রও তাকে টুকটাক সাহায্য করছিলো। আর আমি বসে বসে দেখছিলাম ওদের ঘরকন্যার গল্প। ছোট্ট দু'কামরার সে সংসারে দেখা হয়ে গেলো যেন তিন ঘন্টার পূর্ণ দৈর্ঘ্য এক চলচিত্র।
নাহ ওরা আর চিলেকোঠায় থাকে না।ঠিক ওদের জন্যই বুঝি বানানো হয়েছে এ বাড়িটা। দুটো ঘর, এক চিলতে বারান্দা, কিচেন টয়লেট দিয়ে যেন টোনাটুনির সাজানো সংসার। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম জলমোতীর চোখ মুখ নাক, হাতের আঙ্গুল, পায়ের পাতা। ওর কথা বলা, ওর হাঁটাচলা। ওর ঐ ছিপছিপে দুহাতে ও জড়িয়ে ধরে শুভ্রকে। যেই শুভ্রকে আজ আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে দেবার অধিকারটুকু হারিয়েছি আমি।
জলমোতী শুধু আমাকে দুপুরে খাইয়েই ছাড়লোনা। সন্ধ্যার পর চা খাইয়ে সাথে মুগ পাকনের জীভে লেগে থাকা স্বাদ লাগিয়ে আমাকে বিদায় দিলো। শুভ্র আমাকে এগিয়ে দিতে এলো ।গলির মুখের এক কোনে দাঁড়া করিয়ে রাখা গাড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালাম আমরা। সরু পথের গলি ধরে হেঁটে আসার মুহুর্তটুকুতে শুভ্র একটা কথাও বলেনি আমার সাথে। পিছে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ছিলো জলমোতী।
গলির মুখে বাঁক নিয়ে গাড়িতে ওঠার আগ মুহুর্তে ফিরে দাঁড়ালাম আমি। হাসিমুখে শুভ্রকে বললাম, যাই শুভ্র। জানিনা কখনও আবার হঠাৎ কোনোদিন কোথাও কোনোখানে অপ্রত্যাশিত দেখা হয়ে যাবে কি যাবে না আবার। তুমি ভালো থেকো। তাড়াতাড়ি সংশোধন করে নিলাম। তোমরা ভালো থেকো। চোখে জল ভরে আসছিলো আবার আমার অকারণ স্বভাব দোষে। দ্রুত গাড়ি্তে উঠতে গেলাম।
শুভ্র বললো, দাঁড়াও। আমি থমকে দাঁড়ালাম। শুভ্র আমাকে বুকে টেনে নিলো। নির্দ্বিধায়, অবলীলায় নিশংকোচে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, তোমাকে সব সময় ভালোবাসি। এই কথা বলতে কোনোই দ্বিধা নেই আমার। সারাটা জীবনই তুমি আমার ভালোবাসা হয়েই বেঁচে থাকবে আমার কাছে। দেখা হোক বা না হোক। সন্ধ্যার আবছায়া আলো আঁধারীতে আমরা দুজন ছায়ামূর্তী দাঁড়িয়ে রইলাম একসাথে কিছুক্ষন।
এরপর গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। ঝাপসা জলভর্তি চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছিলোনা । তবুও এগিয়ে গেলাম সামনে। শুভ্র আর জলমোতীকে পিছনে ফেলে। হয়ত সারাজীবনের জন্যই।
বারবারই ভাবি এ গল্প আর লিখবো না। তবুও যখনই লিখতে বসি তখনই মনে পড়ে যায় একলব্য, শুভভাইয়া, মিররমনি, চুয়াত্তরভাইয়া, কামরুজ্জামান ভাইয়া ঢুকিচেপা আপু,খলিলভাইয়া এমন অনেক ভাইয়া আপুকেই। মাহা ভাইয়াকে মিস করি অনেক অনেক। যদি কোনোদিন চিলেকোঠার প্রেম বই আকারে প্রকাশ করি সেটা আমি তার জন্যই করবো হয়ত। কিন্তু এ গল্পের শেষ কোথায়? আজও জানিনা আমি।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১০:১৮