জলমোতী মেয়েটা জলে গড়া মুক্তোর মতই শুভ্র সুন্দর। দারুন ছটফটে। হাসিখুশি আর চোখের তারায় যেন তার কৌতুক ঝলকায় অবিরত। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি এত সুন্দর একটা মেয়ে শুভ্রের বউ হবে। আমার সব সময় মনে হত কোনো এক কালী পেচীই জুটবে তার জীবনে এরপর। জানি এ কথা যারাই শুনবে তারাই ভাববে কোনো এক প্রছন্ন হিংসা থেকেই বুঝি বলছি আমি এসব। হা হা তা কিন্তু নয়। আদতেই আমার এমনটাই মনে হত। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে বউটা হয়েছে পুতুল পুতুল আদলে গড়া দারুন সুশ্রী একটা মেয়ে। আর কি দারুন হাসিখুশি চঞ্চলমতী। আমার কিন্তু শুভ্রের সাথে আর কথা হয়না। আমি ইচ্ছে করেই কখনও ভুলেও ফোন দেই না ওকে। শুভ্রও দেয়না। মনে হয় সেও ইচ্ছে করেই আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায় না। সে যাইহোক শৈলীর দেওয়া ফেসবুক আপডেট এবং ছবিগুলিই আমাকে এসব তথ্য যোগায়। রোজ সন্ধ্যায় বা গভীর রাতে আমি ফেসবুক খুলে বসি। শৈলীর ওয়ালে ঘুরে বেড়াই। ছবিগুলি দেখি, কল্পনার রাজ্যে ভাসি ওদের বাড়িতে জলমোতীর পাশে পাশে।
শৈলী আর তার দুটি ফুটফুটে ছেলেমেয়ে তাদের এই নতুন মামীকে পেয়ে দারুন খুশি। প্রায় সব ছবিতেই ওরা ওদের মামীকে জড়িয়ে থাকে। বুঝা যায় ওদের কাছে যেমন আদরের মামীটা, মামীর কাছেও তেমনই আদরের এই ফুটফুটে শিশুগুলো। আমি জলমোতীর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করি। আমি থাকলেও কি ওরা আমাকেও এভাবেই ভালোবাসতো? এভাবেই জড়িয়ে ধরতো আমাকে? মনে হয় না। আমার সাথে ওদের এক অদৃশ্য দূরত্ব ছিলো। আমার সদাই হরিষ শ্বশুরমশাই কিংবা আমাকে দারুন পছন্দ করা শৈলীও কখনও আমাকে জড়িয়ে ধরার মত সাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি বোধ হয়। আমি কি মানুষটাই এমন ছিলাম। নাকি ওদের গোত্রের বাইরের কেউ যে ওরা আমার থেকে অলখে এই দূরত্ব ধারণ করেছিলো?
আর আমার সদাই হরিষ শ্বশুর মশাই যেন এতদিনে পেয়েছেন এক যোগ্য সঙ্গী। কখনও বউ এর জন্য চকলেট কিনে আনছেন। কখনও বা কেক। সেই কেক মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন বৌমাকে। বৌমা শ্বশুরকে। বলতে গেলে মেয়েটা দুদিনেই ও বাড়িতে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ঐ আসলে ও বাড়ির জন্য বিধাতার নিজ হাতে গড়া বউটাই ছিলো সে কথা আজ আমি বেশ বুঝতে পারি। আমার খুব ভালো লাগে। যেন সত্যিকারের জীবনের কোনো সিনেমার বাস্তব চলচিত্র। মনে মনে ওদের জন্য প্রার্থনা করি। মনে মনে চাই ছন্নছাড়া ভবঘুরে শুভ্রটা এবার থিতু হোক। সুখে থাকুক এই ছটফটে সুন্দর হাসিখুশি মেয়েটাকে নিয়ে। এই মেয়েটাকেই ওর যোগ্য স্ত্রী হবার জন্য বিধাতা নিজ হাতে গড়েছিলেন তা আর কাউকে বলে দিতে হবে না।
আর আমি ছিলাম ভুল মানুষ। হুট করে শুভ্রের জীবনে একদম হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া এক অচেনা আগন্তুক। যার জন্য কোনো প্রস্তুতি ছিলো না শুভ্রের। আমার নিজেরও কি ছিলো? শুভ্রের যদি বা এমন অনাহুত রবাহূতের জন্য প্রস্তুতি না থাকে না থাকুক আমারও তো প্রস্তুতিবিহীন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সঠিক ছিলো না। আমারও কি উচিৎ হয়েছিলো? সমাজ ও সংসারের কোনো রীতিনিতীর তোয়াক্কা না করে এমন সব সিদ্ধান্ত নিলে বুঝি তার ফলও এমনই হয়। বিজ্ঞ গুরুজনেরা তো আর এমনি এমনি চুল পাকায় না? তারা দেখে জানে বুঝে বলেই না এমন সব উপদেশ দিয়ে যায় যা অনুজদের জন্য মেনে চলাটাই উত্তম। আর আমি মা বাবা কারু মতামতের পরোয়া করা তো দূরের কথা ঘূর্নাক্ষরেও আামার এমন একটি সিদ্ধান্তের কথা জানাইওনি পর্যন্ত। এমন সব নানারক উচিৎ অনুচিৎ ঠিক বেঠিকের হিসাব কষি আমি।
রাত গড়িয়ে যায়। জলমোতীর চোখে আমি অবাক চেয়ে থাকি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি ওর চোখ নাক ঠোঁটের গড়ন।ছবি দেখে মনে হয় ভীষন হাসি খুশি আর ভীষন চঞ্চলা মেয়েটা । ফরশা ছিপছিপে গড়ন। বেতসলতার মত দুলছে। সব সময় হাসছে। চোখের মাঝে অকারন কৌতুক। ঠোঁটের ভাজে চেপে রাখা হাসি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। ওর গলার মালা, হাতের চুড়ি, মেহেদীর লাল কারুকাজ সব খুঁটিয়ে দেখি আমি। শৈলীর সাথে গলায় গলা মিলিয়ে ছবি। শৈলীর হাসব্যান্ডের সাথে ছবি। এমনকি সদাই হরিশ শ্বশুরমশাইকেও মুখে কেক তুলে খাইয়ে দিচ্ছে এমন ছবিও দেখি আমি। এই মেয়েটা যেন ক্রমে আঁধার হয়ে আসা কোনো এক বিষন্ন গোধুলীতে এনে দিয়েছে সকালের ঝকঝকে রোদ্দুর। পুরো পরিবার আনন্দে ঝলোমলো।
শুভ্রকেও ভীষন গোছানো লাগে আজকাল। চুল দাড়িতে সেই ভীষন ভাবুক রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ লুকটা আর নেই। সেটা বদলে শুভ্র সংসারী জেন্টেলম্যান হয়ে উঠেছে। ক্লিন শেভড ঝকঝকে চেহারা, জলমোতীর সাথে রং মিলিয়ে পোশাকও পরে আজকাল। আর অনেক অনেক যুগল ছবিও দেখি ওদের। আমার সাথে শুভ্রের ছবি প্রায় নেই বললেই চলে। আমি খুব ছবি তুলতাম। আকাশ বাতাস গাছেদের ছবি। শুভ্রের ঘুমন্ত মুখ বা ল্যাপটপে কুঁজো হয়ে বসে থাকা ছবি। হ্যা সেসব অনেক আছে আজও আমার কাছে। ওর সাথে চিলেকোঠায় কাটানোর প্রতিটি মূহুর্তের ছবি আছে আমার কিন্তু ওর সাথে যুগল ছবি বলতে গেলে নেই। কারণ আমার ছবিগুলির ফটোগ্রাফারও ছিলো সে। আর নিজের ছবি তুলতে তার ছিলো দারুন অনীহা। সেই শুভ্র যুগল ছবিতে হাসি হাসি মুখে জড়িয়ে থাকে জলমোতীকে। লম্বু শুভ্রের বুকের সাথে মাথা লেগে আছে জলমোতীর। দেখি আর ভাবি। এই বুকটাতে প্রথম স্পর্শ ছিলো আমার। আজ সেই স্পর্শের চিহ্ন ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে জলমোতী নামের ভীষন হাসিখুশি আর লক্ষীমন্ত মেয়েটা।
শুভ্রও যে এমন সংসারী হয়ে উঠবে কোনোদিন ভাবিনি আমি। সময় কত কিছুই না বদলে দেয়। তার উদাহরন শুভ্র নিজেই। আমি ওদের ছবি হতে চোখ সরিয়ে আশে পাশে আসবাবপত্র থালা প্লেট বসবার মোড়া, ল্যাপটপের টেবিল বিছানার চাঁদর সবকিছুই খুঁটিয়ে দেখি। মনের চোখ ও ছবিতে যতটুকু দেখা যায় সেই চোখে আন্দাজ করতে চেষ্টা করি ঠিক কেমন আছে শুভ্র এখন। আমার খুব ভালো লাগে শুভ্রের জীবনের এই বাঁক বদলটাকে। ওদের দেওয়ালে ঝুলানো রয়েছে জলমোতী আর শুভ্রের বড় করে বাঁধানো বিয়ের একটা ছবি।
এমনটা আমাদের চিলেকোঠার দেওয়ালেও ছিলো। শুধু পার্থক্য এইখানে বউটা লাল টুকটুকে বেনারসীতে দেবীপ্রতিমার মত মুকুট সীতাহারে সুসজ্জিতা আর সেই ছবিতে আমি ছিলাম বেলফুলের মালা খোঁপায় জড়ানো হলুদ রঙ বাসন্তী শাড়িতে। হ্যাঁ কোনো বেনারসী শাড়ি গয়নায় বিয়ে হয়নি আমাদের। আর শুভ্র একটা পাঞ্জাবী পরেছিলো তাও ঐ বন্ধুর বউ এর কল্যানে। শুভ্রের টোপর পরা ছবি কখনও দেখা হবে ভাবিনি আগে। একটা কথা মনে পড়ে, শুভ্র বলেছিলো, না বাবা সেরওয়ানী, ধোতি, পাঞ্জাবী টোপর এইসব পরে বিয়ে? সম্ভব না ম্যাডাম। এইসব পরে তো আমি আছাড় খেয়ে পড়বো নির্ঘাৎ।
সেই শুভ্র সেই সনাতনী সাজেই টোপর পরে বসে আছে জলমোতীর পাশে। আচ্ছা ওর কি মনে পড়েছিলো সেই কথা তখন? আমার মত করে এত কি কেউ ভাবে? মা মাঝে মাঝেই জিগাসা করেন এত কি ভাবিস বলতো? মা আরও অনুযোগ করেন আমি নাকি ইদানিং বড় চুপচাপ হয়ে গেছি। ছোট থেকেই নিজের মতে চলা এই আমাকে নাকি মায়ের কাছে আজকাল বড় নমনীয় আর অচেনা লাগে। আমি হাসি মায়ের কথা শুনে। মায়েরা এমন কেনো? তারা কি সন্তানের মনের সকল রহস্যের সন্ধান পেয়ে যায়? মা আর সন্তানের অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসার এক টান অনুভব করি আমি।
আমার অনাগত অদেখা সন্তানটিকে মনে পড়ে। মনে হয় সে যদি বেঁচে থাকতো আজ শুভ্রকে কি আমি দূরে চলে দিতে পারতাম আজ? নাকি সেই নিজেই যেতে পারতো? সন্তান তো দুটি আত্মার মাঝে একটু সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে। আমার সেই অদেখা অনাগত শিশুটির জন্য বুকের মধে হু হু হাহাকার করে ওঠে। কেমন হত সেই শিশুটি দেখতে? আমার মত নাকি শুভ্রের মত? কত বড় হত সে? কি কি করতো?
কল্পনায় আমি সেই শিশুটিকে দেখি। ওকে জড়িয়ে ধরি, আদর করি। সে আমাকে মা বলে ডাকে। ভাবতে ভাবতে কখনও আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারি বালিশ ভিজে গেছে চোখের জলে।
তবুও আমি খুশি। শুভ্রকে ছেড়ে এসে আমি আসলে ভালো ছিলাম না। সব সময় মনে হত শুভ্রের পাশে কারো থাকাটা বড় প্রয়োজন। তবে ঐ ক'বছরের সংসারে আমি বুঝে গিয়েছিলাম সেটা যে আমি না। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হত। এখন বুঝি এই সংসারটাই প্রয়োজন ছিলো তার। এই মেয়েটাই সেই সঠিক মানুষটি। যে তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা যোগ্য সন্মান দিয়ে ভালো রাখবে শুভ্রকে। আমার সাথে শুভ্রের যে বন্ধন গড়ে উঠতে গিয়েও ভেঙ্গে গেলো সেই বন্ধন আজীবন অটুট থাকুক ওদের মাঝে সেটাই আমার চাওয়া। আমার চোখে ভাসে বাবা শুভ্র এবং মা জলমোতীর মাঝে ছোট্ট এক রতি জীবন্ত এক পুতুল। ওদের সারাজীবনের সেতু বন্ধন বেঁধে দিক সে এসে। শুভ্রের জীবন পূর্নতা পাক হাসি আনন্দ আর গানে। আমি চাই শুভ্র আমাকে ভুলে যাক চিরতরে। সুখী হোক ও ওর নিজের মত করে। ওর নতুন জগতে। আমি শুভ্রের সাথে থেকে যেতে চাই আমার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ওর অজানায় ওর অগোচরে .......
সুখে থাকো জলমোতী ভালো থেকো শুভ্র.........
উৎসর্গ- শুভ_ঢাকা এবং মিরোরডডল...........
ঢুকিচেপাভায়ের জন্য অডিওটাই বানিয়ে ফেললাম। যাদের পড়ার ধৈর্য্য নেই তাদের শোনার ধৈর্য্য আছে নাকি সেই পরীক্ষা
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২১ রাত ৩:৫৯