আমি সেই ফোন কল পেয়ে স্থবির বসে রইলাম। কি করবো আমি এখন? এই শোকের মাঝে তো বলাও যাবেনা যে শুভ্রের সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। একই সাথে চোখে ভাসছিলো শ্বাশুড়িমার মুখখানি। সেই প্রথম দিন, আমাকে দেখে চমকে ওঠা, ছেলের চাইতেও বয়সে বড় এক মেয়েকে বিয়ে করে আনা বউকে মন থেকে মেনে নিতে না পারা। আবার সেই শ্বাশুড়ির বুকেই কান পেতে শুনেছিলাম আমি তার এক বুক ভরা মায়াময় স্নেহময় ভালোবাসার গান।
আমি শুভ্রকে ফোন দিলাম। ফোনে পাওয়া গেলোনা ওকে। আমি ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। অফিস থেকে ফোন কলে ছুটি নিয়ে পরদিন ভোরেই রওয়ানা দিলাম একাই ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। আর যার কারণেই এই সম্পর্কের বন্ধন ছিলো সেই নেই আমার জীবনে এ কথা আমার মনে হলো না। আমি শুধু জানতাম আমাকে যেতে হবে । এটা আমার পরম দায়িত্ব। আমার চোখে ভাসছিলো মৃত শ্বাশুড়ির জীবন্ত মুখখানি। উনার আত্মা আমাকে দেখে শান্তি পাবেন নিশ্চয়। আমি উনার শান্তির জন্য যাবো। ওখানে গিয়ে শুভ্র কেনো আসেনি বা কেনো আসলোনা এই প্রশ্নের জবাব কি দেবো জানিনা আমি। সে সময় ভাবিওনি। কিন্তু পৌছুবার পর ঐ প্রশ্নে আমাকে বার বার থমকাতে হয়েছিলো। আর তারপর কোনোরকমে বানিয়ে টানিয়ে বলেছিলাম শুভ্র তার অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। তার ফোনে কেনো যেন যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। অফিসের কলিগদেরকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা তাকে পেলেই জানিয়ে দেবে।
সারাদিন কাটলো ঐ শোকের বাড়িতে। মৃত শ্বাশুড়ির পাথর মুখে চেয়ে আমার অবাক লাগছিলো। এই কর্মমুখর রাশভারী মানুষটি আজ ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে। হাজার কোলাহলেও আজ আর তার ঘুম কেউ ভাঙ্গাতে পারবেনা। এই যে এত আত্মীয় স্বজন এত হই চই কিন্তু আজ আর তার কোনো তাড়া নেই। কোনো কাজ নেই। তিনি আজ সকলের মধ্যমনি কিন্তু প্রানহীন নিস্পলক। আমার শ্বশুর ভেঙ্গে পড়েছেন খুব। এত কর্মচঞ্চল সদাই হরিষ মানুষটির মুখে এক ফোটা হাসিও নেই আজ। উনি চুপচাপ বসে আছেন ঘরের এক কোনে। ওদের এক মামা আরও কিছু আত্মীয় স্বজনেরাই সব ব্যবস্থা করেছেন।মৃত বাড়ি আমি কখনও যাই না পারতপক্ষে কারন এই শোক দেখবার সাহস আমার বরাবর খুব কম ছিলো এবং এখনও কমই আছে।
দাফন কাফনের পর শৈলী খুব কাঁদছিলো। আমরা একসাথেই শুয়েছিলাম রাতে। শৈলী কেঁদে কেঁদে বলছিলো আমার শ্বাশুড়ির কত ইচ্ছে ছিলো আমরা আবারও একবার হলেও যেন বেড়াতে আসি। কিন্তু আমরা উনি বেঁচে থাকতে একবারও এলাম না। এমন কি মৃত্যুর পরও ছেলের দেখা পেলেন বা উনার বিদেহী আত্মা। চুপচাপ শোনা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না আমার। আমার খুব খারাপ লাগছিলো কিন্তু সান্তনার কোনো ভাষা জানা ছিলো না আমার। শৈলী বলছিলো তার বিয়েও নাকি প্রায় পাঁকাপাঁকি হয়ে আছে। কিন্তু সে চলে গেলে বাবাকে দেখবে কে? হঠাৎ শৈলী ধড়মড় করে উঠে বসে বললো, ভাবী বাবা তোমাকে ভীষন পছন্দ করে। তুমি বাবাকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাও। প্লিজ ভাবী প্লিজ। তোমার কাছে থাকলে আমি শান্তি পাবো নইলে আমার ঘুমই হবে না বাবার দুশ্চিন্তায়। আমি কি জবাব দেবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শৈলী আমাকে নিরুত্তর দেখে কি ভাবলো কে জানে। ফের চুপচাপ শুয়ে পড়লো।
খুব ভোরে শুভ্র এলো। লাল টকটকে চোখ, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। ওকে দেখেই বুঝলাম কোথায় বুঁদ হয়ে ছিলো সে আর কেনোই বা তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুভ্র আমাকে দেখে মোটেও অবাক হলো না। যেন এমনই হবার কথা ছিলো। আমার আসাটাও খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। শৈলী ভাইকে জড়িয়ে খুব কাঁদছিলো। আমি ওকে সরিয়ে নিলাম। শুভ্রকে তোয়ালে এনে দিয়ে বললাম গোসল সেরে এসে নাস্তা খাবে এসো। আমি চাচ্ছিলাম গোসল করে অন্তত একটু সুস্থ্য দেখাক ওকে। এই শোকের বাড়িতে সকল আত্মীয় স্বজন জেগে উঠবার আগেই ও একটু ভদ্রস্থ হোক। শুভ্র আমার কথা শুনলো। যদিও সে জাঁতে মাতাল তালে ঠিক এবং সে বুঝলোও আমি যা বলছি তাই তার করা উচিৎ।
ভেবেছিলাম পরদিনই ফিরে যাবো। কিন্তু শুভ্র চলে আসায় সেটা আর করা হলো না। আরও দুদিন বেশি থাকতে হলো। ওদের বাড়িতে কেউ জানে না আমাদের এই ডিভোর্সের কথা। কাজেই শুভ্রকে ফেলে আমার চলে যাওয়াটা খুব একটা শোভনীয় দেখায় না। সমস্যা হলো রাতে। শৈলী আমাদের জন্য একই রুমে থাকার ব্যবস্থা করলো। আমি বললাম শৈলী এখানে তোমার ভাইয়া থাকুক। আমি এ দুদিন তোমার সাথেই থাকতে চাই। তোমার সাথে কতদিন পর দেখা হলো। আবার কবে না কবে হবে কে জানে? শৈলী বললো ভাবী আমার বিয়েতে আসবে না নাকি? ইশ আমার বিয়ে নিয়ে মা কত ভাবতো। কত স্বপ্ন ছিলো মায়ের। কিছুই দেখে যেতে পারলো না। শৈলী আবার ডুকরে উঠলো। আমার বুকে মুখ গুঁজলো। বহু রাত পর্যন্ত আমরা দুজন বসে রইলাম দু'দুজন দুজনের ব্যাথার সাথী হয়ে। শুধুমাত্র রাত তার সাক্ষী হয়ে রইলো। প্রায় সারারাতই ঘুম ছিলো না আমাদের চোখে।
ভোরবেলা শৈলী ঘুমালে আমি বেরিয়ে আসলাম দরজা খুলে। সেই উঠান যে উঠানে একদিন বড় বড় মাছের হাড়িতে মাছ কিনতে বসেছিলেন আমার শ্বশুরমশাই। ঐ সেই শিউলী ফুলের গাছটা। সেদিন ফুলে ফুলে ভরে ছিলো তলাটা। আজ সেটা ফুলশূন্য। বউ কথা কও পাখিটাও নেই কোথাও। সেদিনের সব পূর্ণতা ফুরিয়ে গেছে। সবখানেই আজ শূন্যতা। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের সামনেই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম সেই দিনের দৃশ্যকল্পটি। হঠাৎ ঘাড়ের পিছে নিশ্বাস পেলাম। পরিচিত গন্ধ। পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম শুভ্র এসে দাঁড়িয়েছে। এত ভোরে তো ওঠার কথা না ওর। তাহলে কি ও ঘুমায়নি?
শুভ্রের দিকে ফিরলাম। রাতে ঘুমাওনি? আমার আগেই শুভ্র জানতে চাইলো অস্ফুটে। আমি ঘাড় নেড়ে বললাম না, ঘুম আসছিলো না। শুভ্র বললো চলো পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি। আমরা পুকুরের সেই সিমেন্টের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম ফের আবার। আমি এক দিকে আর শুভ্র আরেকদিকের বেঞ্চে। সেদিন ছিলাম খুব কাছাকাছি দুজনকে জড়িয়ে আর আজ দু'জনের মাঝে অভেদ্য অদৃশ্য দেয়াল। যা আমরা ডিঙিয়ে যেতে পারছি না। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। শুভ্র সিগারেট ধরালো। আমি জানতে চাইলাম। আবার স্মোক শুরু করেছো?
শুভ্র হেসে উত্তর দিলো হ্যাঁ। আমি বললাম তুমি প্রমিজ করেছিলে।
শুভ্র হেসে উঠল, প্রমিজটা কি মনে আছে ম্যাডাম?
আমি হাসতে পারলাম না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। শুভ্র বললো, প্রমিজটা ছিলো যে ঠোঁটে তোমাকে ছোঁবো সে ঠোঁটে আর কখনও সিগারেট ছোঁবোনা কিন্তু....... বলতে গিয়ে থমকে তাকালো শুভ্র.......
আমার ইচ্ছে করছিলো চিলেকোঠার ঠিক সেদিনটার মত ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে ওকে শেষ করে দিতে। কিন্ত ওর দিকে চেয়ে স্থির চোখে বসে রইলাম আমি। শুভ্র ঠিকই হাসছিলো। এত ঝড় ঝাপটা দুঃখ বেদনা ওর উপর দিয়ে বয়ে যাবার পরেও ও কেমন করে হাসে অবিকল ওমনি আমি বুঝতে পারিনা। কিন্তু আমি মনে হচ্ছে আজকাল হাসতেই ভুলে যাচ্ছি।
পরদিন আমরা একই সাথে রওয়ানা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। যাবার সময় শৈলী দৌড়ে একটা বড় সড় প্যাকেট নিয়ে এলো। আর সাথে ছোট একটা অর্নামেন্ট বক্স। বললো ভাবী এটা মায়ের উপহার। মা তোমাকে দিয়ে যেতে পারেননি। বাবার বাড়ির নিজের টাকা জমিয়ে
তোমার জন্য এই বালা দুটো গড়িয়েছিলেন। তোমাকে কখনও তো কিছু দিতে পারেননি। তাই ভেবেছিলেন নাতি হলে একই সাথে নাতি আর বউকে বরণ করবেন। দেখো ভাগ্যের কি পরিহাস আজ মাও নেই নাতীও নেই। তুমি তো আছো। প্লিজ মায়ের বালা দুটো পরো তুমি সবসময়। আমি ঢোঁক গিললাম। কি করে বলি ওকে আমিও নেই শৈলী । এই বালায় আর আমার কোনো অধিকার নেই আজ। এই বালা আমার প্রাপ্য নয়। হয়তো কখনও কারো প্রাপ্য হবে তবে নিশ্চিৎভাবেই আমি সে নই।
শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আর বলা হলো না। শুভ্রের চোখেও দেখতে পেলাম কাতর মিনতী। ও চাচ্ছিলো না আমি শৈলীকে কষ্ট দেই, না বলে ফেলি। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার সকলের অগোচরে। আজও আমি শুভ্রের চোখের ভাষা পড়তে পারি। হাত পেতে নিলাম আমার শ্বাশুড়ি মায়ের সেই পরম অর্ঘ্য। ্তারপর বুকে চেপে ধরলাম আমার হারিয়ে যাওয়া বাবুর জন্য পরম মমতায় নিজ হাতে গড়ে তোলা তার প্রয়াত দাদীর উপহার। পৃথিবীটা কি আশ্চর্য্য এক নাট্যশালা। দুজন অদেখা এবং সকল চাওয়া পাওয়ার উর্ধে চলে যাওয়া একজন বৃ্দ্ধ মানুষ এবং একজন ফুটে ওঠার আগেই ঝরে যাওয়া ফুল এই পুটুলীটার মধ্যে জেগে রইলো পরম ভালোবাসায়.....
গাড়িতে আমরা নিশ্চুপ বসে রইলাম। শুভ্র যথারীতি একটা ইংলিশ খটোমটো বই নিয়ে আর আমি জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে। আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে বসে রইলো আমার বড়ষড় ভ্যানিটি ব্যাগটা। পথে আমরা চা খেতে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। এতক্ষন ড্রাইভারের সামনে কোনো কথাই বলিনি আমি। এখন সুযোগ পেয়ে ব্যাগ থেকে বের করলাম বাক্সটা। শুভ্রের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, শুভ্র এই বালা দুটিতে আসলে আমার আর কোনো অধিকার নেই। যার অধিকার হবে তাকে দিয়ে দিও একদিন।
শুভ্র হাসলো। সেই ভূবন ভোলানো হাসি। তারপর দুহাতে আমার হাতের মুঠি চেপে ধরে বললো, এই বালাজোড়া আমার মা শুধু তোমার জন্য বানিয়েছিলেন। তুমি ছাড়া আর কারো অধিকার নেই এতে। চা না আসা পর্যন্ত ওভাবেই হাত ধরে রাখলো শুভ্র। চা আসলে হাত সরিয়ে নির্বিকারভাবেই চা খেতে শুরু করলো। মনে পড়লো আমরা দু'জন ঠিক এভাবেই আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে বসে থেকেছি কত রাত, কত দিন.......
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৩৬