ছুটি শেষে অফিসে যাচ্ছি ফের। এতগুলো দিন একসাথে কখনও অফিস থেকে দূরে থাকিনি।এমনকি অনেক অনেক ছুটি অকারণেই শেষ হয়ে গেছে এতগুলো বছর। অনেক ছুটিই নেওয়া হয়নি আমার। তাই হঠাৎ এতদিনের অনুপস্থিতির পর অফিসে ফিরে সব কিছুই অচেনা লাগছে। অফিস ডেকোরেশন চেঞ্জ হয়েছে। আমাদের ডেস্ক চেয়ার টেবিল সবই নতুন ঝকঝকে। গ্লাসডোরের ইনডোর ডেকোরেশনেও বেশ চেঞ্জ। তবুও মনে হচ্ছে অনেকদিন পর বাড়ি ফিরলাম। আমাদের বাড়ি। আমাদের অফিস বাড়ি।
আমার প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে ওয়ান ডিশ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। লাঞ্চে সবাই মিলে হই হুল্লোড় করে খানা পিনা হলো বেশ। নাসিমা আপু তো ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিলো। খুব হাসি তামাশা হলো। এই হাসি তামাশায় কেউ একটা বারও কোনো দুঃখ বা কষ্টের কথাই তুললো না। আমারও দিনটা এতই ভালো লাগলো যে আমি প্রায় ভুলেই গেলাম আমার চাপা কষ্টের অনেকখানিই। অফিসের দারোয়ান, পিওন, ড্রাইভার এমনকি ঝাড়ু দেওয়া মেয়েটাও এক গাল হাসি মুখে যখন সামনে এসে দাঁড়ালো তখন ভীষন স্বার্থপর মনে হচ্ছিলো নিজেকে।
সে যাইহোক এরই মাঝে হঠাৎ শুভ্র জানালো।ওর একটা জব হয়েছে। বেতন খুব সামান্য। ও এত ভালো রেজাল্ট করেও এই জব করা কি ওর শোভা পায়? আমি বললাম, যা হোক করো। একটু এক্সপেরিয়েন্স হোক। ও হ্যাঁ আমি হসপিটাল থেকে ফেরার পরও শুভ্র ঐ চিলেকোঠাতেই আছে। আমিও ওকে ডাকিনি। রোজই কথা হয় ওর সাথে। কিন্তু আমারও মনে হলো যতদিন ও নিজের পায়ে না দাঁড়াতে পারে এইভাবে ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরবাড়িতে বসে থাকাটা ঠিক শোভা পাচ্ছে না। তাই আমিও কিছু বলিনি।
বছর না ঘুরতেই আমার জীবন থেকে শুভ্র যেন বেশ দূরে সরে যাচ্ছিলো। যে শুভ্রের সাথে বিয়ের আগে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছি ফোনে, ম্যাসেঞ্জারে। সেই শুভ্রের এক ঘেয়েমী হতাশার কথাই আমার অসহ্য লাগতে শুরু হলো। শুভ্রকে আমি সব সময় বেশ নির্বিকার দেখেছি। যে কোনো বিপদেই সে ছিলো নো টেনশন। সেই শুভ্র হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা করার জন্য মানে নিজে কিছু উপার্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সব সময় বলছে কিছু হচ্ছে না। কি করবো? কোথায় যাবো? আমার রাগ লাগতো মনে মনে । আসলে একটা সময় আমিও ভাবছিলাম এই ছেলে এমন নির্বিকার বসে আছে কেনো? তারতো কেরিয়ার গড়ার সময়। কেনো সে এইভাবে সময় নষ্ট করছে? এমন সব ভাবনায় উদ্বেল হতাম আমি।
অথচ আমার আজ আর কোনো চিন্তা নেই। শুভ্র যদি আজীবন বসেও আমার ঘাড়েই হোক বা নিজের বাবা বা শ্বশুরের বাড়িতেও বসে খায় আমার কিছুই বলার থাকবে না। আমার কোনো মাথা ব্যাথাই নেই তাতে। ও যেভাবে যা চায় তাই করুক। এই ভাবনায় হয়ত ছিলো হতাশা, হয়তো ছিলো আমার নিজের বিষন্নতা বা হয়ত ছিলো কিছুটা বিরক্তিও। কারণ একটা সময় আমার পুরোটা জুড়েই ছিলো শুধুই শুভ্র আর শুভ্র তারপর আমার হারিয়ে যাওয়া বাবুটার কষ্ট আর আমার এক্সপেক্টেশন অনুযায়ী শুভ্রের নিজেকে না গড়ে তোলা নিয়ে আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তাই তার কথায় হু হ্যাঁ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না।
শুভ্র হঠাৎ একদিন ফের টাকা চেয়ে বসলো। আমি ভেতরে ভেতরে খুবই খেপে উঠলাম। কিন্তু বুঝতে দিলাম না। কারণ শুভ্র সব সময় সব কিছুই ডাইরেক্ট বলে। ওর স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড আচরণ খুব অবাক করা আর ভালোলাগারই ছিলো আমার। কারণ ও যা তাই বলে কিছুই লুকায় না। পিছে খুন করে এসে সামনে সাধু সাজা হাস্যকর ভন্ড নয় বলেই হয়ত ও আমার কাছে এতটা মূল্যবান ছিলো। সেই মানুষটিই যখন ইঙ্গিতে এবং ইনডাইরেক্টলী টাকা চাইলো। আমার মেজাজ চড়ে গেলো। কিন্তু আমি এতদিন ওর মত নির্লিপ্ত এবং নির্বিকার মানুষের সাথে থাকার কল্যানেই হোক বা নিজের ম্যচুরিটির জন্যই হোক আমি নির্বিকার থাকলাম। আমাদের কথোপকথনটা ছিলো কিছুটা এমন-
শুভ্র - এ চাকরীতে পোষাচ্ছে না।
আমি - হুম
- আসলে এত পড়ালেখা করে, বাবামায়ের টাকা শেষ করে যে স্যালারী পাই তাতে তোমাদের বাড়ির ড্রাইভারও থাকবে না।
- হুম
- রাখবে নাকি আমাকে ড্রাইভার?
- না
- হা হা জানতাম
- কি জানতে?
- আমাকে তোমার আর সহ্য হচ্ছে না।
আমি- নিরুত্তর
শুভ্র- আসলে আমি মাঝে মাঝে ভাবি, তুমি কি করে আমাকে সহ্য করেছিলে? কি করে সহ্য করো এখনও। একটা জিনিস কি জানো? আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। বিধাতা তোমাকে আমার মত একজন মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
আমি- নিরুত্তর
শুভ্র- আমি কোনদিক থেকেই তোমার যোগ্য নই। কোনোভাবেই মানায় না আমাকে তোমার পাশে।
আমি- নিরুত্তর
আমার এসব পেন পেন কথা বার্তা একদম ভালো লাগে না আজকাল। কিন্তু নিরুত্তর রইলাম।
শুভ্র বললো এসব চাকরী টাকরী পোষাবে না তার। তাকে আরও উচ্চশিক্ষায় যেতে হবে। সে অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকা পড়তে যেতে চায়।কথা সত্যি সে পড়ালেখা করলে ভালো রেজাল্ট করবে। উচ্চশিক্ষা তারই করা উচিৎ। কিন্তু এরপরই সে বললো, পড়তে যেতে টাকা লাগবে। ৪০ লাখের মত। কোথায় পাবে সে?
আমার মেজাজ আকাশে চড়ে গেলো তবুও আমি কিছুই বললাম না। শুভ্র বলেই চললো। এই উচ্চশিক্ষাটা হলেই তার হাতের মুঠোর আলাদীনের চেরাগ পাওয়া হত তখন জব পাওয়াটাও হত পানির মত গলগলে আরও কি সব বড় বড় কথা। আমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিলো। কত কি যে আজে বাজেই না ভেবেছি সে সব কথা শুনে। ভালোবাসার মানুষকে তা মরে গেলেও বলা যায় না। তাই বলিওনি কিছু কিন্তু শুভ্র ছোট হয়ে গেলো। আমার চোখে এটাই মনে হয় ছোট হবার শেষ ছিলো ওর। ও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছিলো। আমি ভাবছিলাম খুব ভুল হয়ে গেছে। ওকে যে উচ্চ আসনে আমি বসিয়েছিলাম, সে এই উচ্চাসনের যোগ্য ছিলো না কোনোকালেই। বড় মাছটা শিকার করাটাই ওর আসল উদ্দেশ্য ছিলো আসলে। আজীবন নিশ্চিন্ত বসবাস। পায়ের উপর পা তুলে খাওয়া। আলসে মানুষেরা যা করে। আর সে কি আর শুধুই আলসে সে তো এক মহা ধড়িবাজ! দিনের পর দিন নিশ্চিন্তে কাটালো। কিছুদিন আগেই এতগুলো টাকা নষ্ট করলো। আমি তো কিচ্ছু বলিনি। কিচ্ছু ভাবিওনি। আর সেই রেশ কাটতে না কাটতেই আবার চাইছে তার ১০ গুন! আমি নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলাম।
- যোগাড় করো।
শুভ্র খানিক চুপ থেকে হো হো করে হাসতে লাগলো। আমি তবুও জানতে চাইলাম না তার হাসির কারণ। নির্লিপ্ত রইলাম।
শুভ্র বললো- আমি আজ খুব খুশি। কারণ আমি ঠিক যেমনটা তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম তুমি সেটাই হয়েছো। তোমার সাথে পরিচয়ের প্রথম দিকে তুমি ছিলে তুলতুলে এক বিড়ালছানার মত কোমল। আসলে আমাদের দেশের বেশিভাগ মেয়েরাই এমন। নিজেরাই অন্যায় মেনে নেয়। লজ্জা পায়। বড় ভয় পায়। দোষের ভয়। অপবাদের ভয়। ন্যায় অন্যায়ের ভয়। আমি তোমার সেই ভয়টাই কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আর তাই তুমি সাহস করেছিলে আমাকে বিয়ে করবার। আমাদের দেশের নিয়ম নীতি ছেলে বড় হতে হবে, বউকে পালতে হবে বা ধর্ম জাত মানতে হবে এইসব ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে আমি তোমাকে সাহস জুগিয়েছিলাম। আমি জানি আমি যা পারি না বা পারবো না তুমি তা পারবে। তোমার জন্মই হয়েছে সব কিছু জয় করবার জন্য। যেখানে তোমার জন্ম সেখানে তোমাকে আমার মত আমাদের মত লড়াই করতে হয় না। তবে তারপরও এই দেশের মেয়েদের শ্বাসত ভয় ভীতি অক্ষমতার মনোভাব তোমার ভেতরে ছিলো। সেটাই জয় করতে আমি তোমাকে খুব সাবধানে এগিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি আজ জয়ী। তাই আমিও জয়ী। তোমার সকল বিজয়ে আমার বড় আনন্দ ছিলো। তুমি খুব ইমোশোনাল ছিলে, খুব অস্তিরতা কাজ করতো তোমার মাঝে। আজ তুমি নির্লিপ্ত থাকা শিখে গেছো। আবেগের কাছে তুমি আর পরাজিত হবে না। আমি তোমাকে এমনই দেখতে চেয়েছিলাম।
আমি জানি তুমি আর আমাকে ভালোবাসতে পারছো না। আমাকে সহ্য করে যাচ্ছো। এবং এটাই স্বাভাবিক। আমি আর তোমার ভালোবাসা পাবারও যোগ্য নই। আসলে কখনই ছিলাম না। তেল আর জলে মিশ খায়না। এটা শ্বাসত সত্য। যার থেকে বের হওয়া যায় না। তারপরও তুমি যদি চাইতে আমি থাকতাম। কিন্তু তুমি আর আমাকে চাও না। আমি চলে যাচ্ছি। তোমার বাঁধন আমি কেটে দেবো খুব শিঘ্রী। তবে হ্যাঁ তারপর আমি মুক্ত। আমার যে কমিটমেন্ট ছিলো তোমার কাছে। সে সকল বন্ধন সকল কমিটমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাবো আমি।আমার মাথা কাজ করছিলো না। কি বলছে শুভ্র এসব! নিজেকে অপমানিত লাগছিলো। যদিও শুভ্র যা বলছে সবই সত্য এবং সঠিক।
সে বিকেলটা আমার মনে পড়ে। আমাদের সুসজ্জিত বেডরুমের ভেতরে ছায়াশীতল পড়ন্ত বিকেল তখন। বাইরে সূর্য্য ঝিমিয়ে পড়েছে। এসির ধাতব শব্দ ছাড়া ভেতরে তখন পিনপতন নীরবতা। শুভ্র আর আমি মুখোমুখি বসে ছিলাম। আমি কর্নার সোফার আর শুভ্র বেডের উপর। ওর শেষ কথা শুনে আমি কিছুই বললাম না। উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে চলে যেতে দেখে শুভ্র আমার হাত ধরে ফেললো। উঠে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আলতো করে আমার কাঁধের চুল সরিয়ে দিয়ে আমাকে বুকে টেনে নিলো। আমি বাঁধা দিলাম না।
বেশ খানিক পর শুভ্র বললো- ইট ওয়াজ আ নাইস জার্নী উইথ ইউ মাই লাভ এন্ড ইট ওয়াজ দ্যা লাস্ট কিস। মানে ঐ যে বলে না বিদায়ী চুম্বন। আবার তার স্বভাবসুলভ সেই নির্বিকার হাসি। আমার একটা প্রবাদ মনে পড়লো, হাসতে হাসতে মানুষ খুন করা। কিন্তু আমি নিরুত্তর রইলাম। শুভ্র বলছিলো তুমি আমাকে যা দিয়েছো তার অবদান অনেক এবং আমি তা কখনই ভুলবো না। এই জীবনে যদি কখনও দরকার হয় আমার মত কোনো অপদার্থকে তোমার। আমাকে ডেকো। নির্দ্বিধায় ডেকো। আমি আসবো। হেজিটেড করোনা কখনও। বিদায়ী এবং শেষ চুম্বন বলার পরও শুভ্র আমার কপালে চুমু খেলো। তারপর খুব দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
আমার চোখ ফেটে জল আসছিলো। ও বেরিয়ে যেতেই আমি হাউমাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসছিলো। পায়ের তলায় যেন কোনো মাটি নেই.............
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ৯:২২