হঠাৎ জীবনে যেন এক বিশাল শূন্যতা নেমে এলো। কোনো বিষম কোলাহলের শহর থেকে যেন আমি চলে এসেছি কোনো নিশ্ছিদ্র নিরুত্তাপ নীরজন বনে। এখানে কোনো মানুষ নেই, জন নেই, পশু নেই পাখি নেই কিচ্ছু নেই। এখানে শুধুই আমি একা। মাঝে মাঝে মাথার মধ্যে কথা বলে যায় কারা যেন। কিন্তু পরক্ষনেই ভুলে যাই আমি। কি বলে গেলো বা কে বলে গেলো। এক পৃথিবীর আলো না দেখতে পাওয়া অদেখা ছোট্ট শিশুও যে আমাকে এইভাবে নিঃস্ব করে দিয়ে যেতে পারে ভাবিনি আমি কখনও আগে।
সাত সাতটা মাস আমার ভেতরে লালিত সেই সত্তাটির বিচ্ছেদে নিঃশেষ হয়ে পড়ি আমি। আমার কাউকে ভালো লাগে না। সবাইকেই বিরক্ত লাগে। মা কত কথা বলে যায়। শুভ্র এসে চুপচাপ বসে থাকে। বাকীটা সময় ঘুম পাড়িয়েই রাখে ওরা আমাকে। তবুও যতক্ষন জেগে থাকি। বুক ভেঙ্গে যায় কষ্টে আমার। আমার অনাগত সন্তান আমার স্বপ্নে আসে। আমাকে মা মা বলে ডাকে। আমি ওর সাথে খেলি। কখনও পুতুল নিয়ে, কখনও বা গাড়ি। কখনও পার্কে ওর হাত ধরে ঘুরি আমি। ও দেখতে যে কি সুন্দর হয়েছে। একদম পরী বাচ্চা। স্বর্গ থেকে নেমে আসা যেন এক দেবদূত।
হসপিটাল থেকেই জানতে পারি শুভ্র আমাদের সেই পুরোনো চিলেকোঠায় আবার ফিরে গেছে। ইদানিং নাকি খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে একটা চাকুরী খোঁজার। মনে হয় আমার এ অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করছে বেচারা। অথবা হয়ত আমাকে ছাড়া ও বাড়িতে থাকাটাই ওর অসহ্য হয়েছে। থাক ও বাড়ি ফিরুক বা জব খুঁজুক। ওর যা মনে চায় করুক। আমি আর ওর মত করে চলায় বাদ সাধবো না। ও তো ওর মত করেই ওর জীবন চালাতে চেয়েছিলো। চালাক। আমি আর ওর কোনো কিছুতেই বাঁধা দেবোনা। কি হয় বাঁধা দিয়ে? কি হয় এসব করে? যা হবার তাই হয়। শত চেষ্টাতেও কোনো কোনো ভবিতব্য কখনও ঠেকানো যায় না।
আমার আজকাল খুব নিজের ছোটবেলা মনে পড়ে। মা দুই বেনী বেঁধে দিতেন। স্কুলের লাল চেক স্কার্ট আর সাদা শার্ট। খুব ছোট বেলার প্রথম বন্ধু রুনি। কি পাঁজী ছিলো মেয়েটা। আবার দারুন বুদ্ধিমতীও। কোথায় আছে সে? কোথায় হারিয়ে যায় মানুষ এইভাবে? মনে পড়ে পাতলা জিলজিলে কাগজে জড়ানো অভূত স্বাদের কুল-বরই এর আচার, মনে পড়ে হাওয়াই মিঠার অদ্ভুৎ রঙ, মনে পড়ে শোন পাপড়ির আশ্চর্য্য স্বাদ। দাদীকে মনে পড়ে। দাদীর বানানো আমসত্ব, ছোট্ট বেলার সবুজ বন-জঙ্গল আঁকা কাঁঠপেন্সিলটার ছবি চোখে ভাসে, নাকে ভাসে গন্ধওয়ালা গোলাপী রাবারের সুঘ্রান। একবার নানু বাড়িতে ঝড়ের পরে আম কুড়িয়ে স্তুপ করে রাখা ছিলো বারান্দায়......... কত কিছুই ভাবি আমি। এক পৃথিবী ভাবনায় ভেসে ভেসে যাই.......
২ মাস ১১ দিন পর বাসায় ফিরি আমি। বাড়িটাকে অচেনা লাগে।আসলে আমার জীবনটাই বদলে গেলো যেন হঠাৎ। নিজেকেই অচেনা লাগে আজকাল আয়নায় দাঁড়ালে। শুভ্র প্রায়ই ফোন দেন। আমার এ অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করে সে। আমার হাসি পায়। ভীষন হাসি পায়।অট্হাস্য হাসতে ইচ্ছা করে আমার। কিন্তু আমি কিছুই বলি না, একটা কথাও না। অনেকেই ভাবে আমি বোবা হয়ে গেছি। ভাবলে ভাবুক আমার কি?আমার কথা বলতে ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমিও শুভ্রের এই দূর্গতীর জন্য দায়ী।ওমন হুট করে বিয়ে করাটাও আমার উচিৎ হয়নি। ওর যে বয়সে স্বামী হবার কথা ছিলো না, বাবা হবার মানসিকতা গড়ে উঠেনি সেখানেই টেনে ফেলে দেওয়া হয়েছে ওকে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয় সেই সিচুয়েশনটার জন্য তো আমি দায়ী ছিলাম না শুধু একা। শুভ্র আমাকে ভাবিয়েছিলো। বদলে দিয়েছিলো চিরায়ত আমার ধ্যান ধারণা, ভাবনা চিন্তা।
নাসিমা আপা ফোন দেয়। ফোন দেয় সুরুচী। হসপিটালেও দেখতে গিয়েছিলো তারা আমাকে। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি ৩ মাসের।পরের মাসে জয়েন করবো। ডক্টরও বলেছে আমার এই মানসিক শকটা কাটাতে ব্যাস্ততাই সব চাইতে বড় ঔষধ। যত তাড়াতাড়ি কাজে ডুবে যেতে পারি সেটাই আমার মঙ্গল। আমি ইদানিং আবার ছবি আঁকতে শুরু করেছি। চুপচাপ একা একা ছবি এঁকে চলতে আমার এখন শুধু ভালো লাগে। কারো সাথে কথা বলতে হয় না। কোনো কাজের প্রেশার নেই শুধু নিজের মনে ভাবতে পারা যায়। আমার ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। কিন্তু ডক্টর বলে আমাকে নাকি এই ছবি আঁকা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। কারণ এইভাবে ছবি নিয়ে পড়ে থাকলে আমার এই বিষন্নতা আরও প্রগাঢ় হবে। আমি স্বাভাবিক জীবনে হয়ত আর কখনও ফিরতেই পারবোনা।
ডক্টর কেনো এই কথা বলে আমি জানি। কারণ আমি শুধু দিনের পর দিন আমার অনাগত সেই সন্তানের মুখটাই আঁকি। আর কিছুই আমার আঁকতে ভালো লাগেনা আজকাল। আর কি যে এক আশ্চর্য্য ব্যপার! আমি দিনের পর দিন ওকে আঁকতে আঁকতে এখন সত্যিকারেই ওর মুখটা দেখতে পাই। ও কখনও হাসে। কখনও কাঁদে। কখনও বা অভিমানে ঠোঁট ফুলায়। হা হা বিধাতা আমাকে ওর হাসি কান্না দেখতে দেয়নি বটে। কিন্তু বিধাতা প্রদত্ত আমার এই দুই হাতে আমার জগতে আমি ঠিকই সৃষ্টি করেছি সেই অদেখা শিশুটির হাসি কান্না। আমার সন্তানের হাসি, আমার সন্তানের অভিমান, ওর ঘুমিয়ে থাকা মুখ সবই আমি সৃষ্টি করে চলি দিনের পর দিন।
আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর শৈলী এসেছিলো হসপিটালে। আমার শ্বাশুড়ি তার বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন আমাকে অনেকক্ষন। উনার চোখে ছিলো বিষন্ন ক্ষ্ট কিন্তু উনার বুকে মাথা রেখে বুঝেছিলাম আমি কত মায়া জমে আছে সেখানে। আমার জন্য , শুভ্রের জন্য, তার স্বামী সন্তান এবং সেই অনাগত নাতিটির জন্যও। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এত এত তার পুরোনো নতুন শাড়ি কেটে ফেলে তার নাতির জন্য বানানো কাঁথা কাপড় জামাগুলি কি করেছেন তিনি? আমার খুব ইচ্ছে করে সে সব ছুঁয়ে দেখতে। বুকে নিয়ে বসে থাকতে। সে সব কাঁথা কাপড় জামা নাই বা হলো সেই শিশুর ব্যবহারের জন্য তবুও সেসবে মিশে আছে আমার সেই নিস্পাপ অদেখা শিশুটি। কিন্তু কিছুই বলা হয় না আমার। এক রাশ কষ্টে গলা চেপে আসে। আমি চুপ থাকি।
আমার শ্বশুর। যাকে দেখে প্রথম দিনটিতেই সদাই হরিষ উপাধীটি মনে পড়েছিলো আমার। সেই হাসি মুখে প্রথম দেখি বিষন্ন সন্ধ্যা! চুপচাপ বসেছিলেন তিনি। বিদায় নেবার সময় ছোট্ট শিশুর মত হাউ মাউ কেঁদে উঠলেন। আমি নির্বাক তাকিয়ে থাকি। উনি হাউমাউ করে বলছিলেন, মা নাতি হারানোর দুঃখে কাঁদছি এ কথা ভেবোনা তুমি। আমি তোমার এ অবস্থা সহ্য করতে পারছি না। তুমি কেনো এমন হয়ে গেলে? কি হয়েছে তোমার আমাকে বলো? কেনো তুমি কথা বলো না? কেনো তুমি হাসো না? মানুষের কি এমন হয় না বলো? ধরে নাও এটা একটা এক্সিডেন্ট। তুমি আবারও মা হবে। তোমার কোল আলো করে জন্মে নেবে এই শিশুটিই আবারও খুব শিঘ্রী। কেনো এইভাবে ভেঙ্গে পড়ছো? কেনো নিজের জীবনটা নষ্ট করছো।
আমি মনে মনে হাসছিলাম। হায়রে জীবন। যে মানুষটির এতটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারবোনা ভেবে, আমার বাড়িতে এলে তার সাদর সম্ভাষনে এতটুকু ত্রুটি হতে পারে ভেবে আমি কখনও চাইনি উনি আসুক। সেই মানুষটিকেই আজ আসতে হলো আর দুঃখ পেতে হলো আমারই কারণে। আসলেই পৃথিবীতে যা হবার তাই হয়। সৃষ্টিকর্তা তার উপন্যাসে আগেই লিখে রেখেছেন সব ঘটনাগুলিই। মানুষ শুধু সেই রোলগুলিই প্লে করে যায় তার সাজানো সব ঘটনার মাঝ দিয়েই। তবুও মানুষ কত আপ্রাণ চেষ্টাই না করে। সুখে থাকার....... ভালো থাকার......
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৯