যে আনন্দ, উচ্ছাস আর উচ্ছলতা নিয়ে এ ভ্রমনের শুরু ছিলো তার রেশটা ফুৎকারে যেন নিভে গেলো। আমি সেদিনের কথা অনেক ভেবেছি। সেই ছিলো শুরু। আমার ভেতরে অভিমান বা দুঃখবোধ, ক্ষোভ বা বেদনা যাই বলি না কেনো, হয়ত আমারই ভুল। সোজা কথায় ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক, সেই যে দ্বিধা কিংবা দ্বন্দ সেটার শুরু আমার সে রাত থেকেই।
জাহাজে পৌছে সকলে যেন অকারণ উচ্ছলতা আর আনন্দে মেতে উঠেছিলো। সকলেই হাসি ঠাট্টা আর গল্পে মশগুল হয়ে উঠেছিলো। আমিও তাদের ব্যাতিক্রম ছিলাম যে তা নয়। কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম শুভ্র যাকে আমি মুখচোরা বা খুব একটা মিশুকে না বলেই জানি সে যেন এক্কেবারে খোলস ভেঙ্গে রুপকথার বেলকুমারের মত হঠাৎ অজানা অচেনা আরেক মানুষ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। এই শুভ্র আমার একেবারেই অচেনা অজানা। পাড় আড্ডাবাজদের মত অট্টহাস্য আর গাল গল্পে মেতে উঠেছে। এত অল্প সময়ে এত অজানা অচেনা লোকের ভিড়ে এত সহজেই এইভাবে মিশে যাওয়া শুভ্রকে আমার খুবই অচেনা লাগছিলো। তার আমার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিলো না।
ওদিকটায় ছেলেদের আড্ডা জমে উঠেছিলো। আমার অফিসের মেল কলিগস আর ফিমেলদের হ্যাসব্যান্ডদেরকে নিয়েই। আর এদিকটাতে আমরা মেয়েরা। বাচ্চারাও এরই মাঝে ওদের মত জগৎ গড়ে নিয়েছে দেখলাম। জাহাজের ডেকে একদিকে নুডুলস পকোড়া, ধোঁয়া ওঠা স্যুপ, চিপস থরে থরে সাজানো ছিলো। বাচ্চারা হই হুল্লোড় করে নিয়ে নিয়ে খাচ্ছিলো ইচ্ছামত কফি, কোল্ড ড্রিংকস। আসলে এটা হয়ত খুবই সহজাত ব্যাপার ছিলো। কিন্তু আমার বুকের মধ্যে কোথায় যেন এক খটকার শুরু হলো। মনে হলো কিছু একটার অভাববোধ। আমার মন হু হু করে কেঁদে উঠল এক ঝাঁক ভীড়ের মাঝে থেকেও।
আমার কেনো হঠাৎ এমনটা মনে হয়েছিলো? আমিই ভুল ছিলাম বার বার বলেছি নিজেকেই তবুও মানুষের মন মানে নিজের মনের তলই খুঁজে পাইনি আমি। ভেবে পাইনি কোনোই দিশা। আজও পাই না। শুভ্র এমনভাবেই মেতে ছিলো যেন আমি বলে এই জাহাজে ওর কেউ নেই। ওদের সাথেই এসেছে সে। ভোস ভোস ধোঁয়া ছাড়ছিলো সিগারেটের। অথচ সে এতদিন একটা সিগারেটও স্পর্শ করেনি। আমার খুব মন খারাপ হচ্ছিলো। দূরে সন্ধ্যা নামছিলো। একটু একটু করে সরে যাচ্ছিলো তীরের ঘন সবুজ গাছ পালাগুলো। অন্ধকার গাঢ় হচ্ছিলো।
জাহাজের লাইট জ্বলে উঠার কিছু পরেই নাসিমা আপার হাসব্যান্ড চেঁচিয়ে বললো, তারা ভেতরের হলরুমে যাচ্ছে। কার্ড খেলা হবে। শুভ্র আমাকে জানিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা তাকিয়েও দেখলো না। ওদের সাথে চলে গেলো ভেতরে। আমি বিস্ময়ের উপর বিস্ময়ে ভেতরে ভেতরে কাঁঠ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এখন মনে হয় প্রেগন্যান্সীর কারণেই হয়ত ওমনটা হয়েছিলো আমার। শুভ্র বা সেদিন জাহাজের সকল ছেলেদের দল মিলে যা করেছিলো সবটাই ছিলো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ওমন নাজুক শরীরের সাথেমা বাবা বা শ্বশুর শ্বাশুড়ি এবং কলিগদের কেয়ারিং পেয়ে পেয়ে মনটাও মনে হয় আহলাদী হয়ে উঠেছিলো। জানিনা আমি। আসলেই জানিনা।
অথবা হয়ত আমার স্বপ্নে যা ছিলো শুভ্র আর আমি সাগরের ঢেউ দেখবো। ডেকে বসে ওর কাঁধে মাথা রেখে রেখে গুনবো সন্ধ্যায় একে একে জ্বলে ওঠা হীরার মত ছোট্ট সব জ্বলজ্বলে তারা। জাহাজের কোল ঘেষে বয়ে যাবে শীতল হিমেল হাওয়া। আমাদের মন জুড়াবে। সিনেমা নাটকের মত হয়তো এমন কিছুর সাথে মিললো না বলেই আমার ওমন হলো। জানিনা আমি আসলেও জানিনা। জানতে হলে সাইকিয়াটিস্টের কাছে যেতে হবে।
যাইহোক ওরা ভেতরে যাবার পরে জাহাজের ডেকে খানিকটা স্বস্তি এলো। মেয়েলী হাসাহাসি আর রিনরিনে কন্ঠ ঘিরে জাহাজের ভটভট শব্দটা মিলে মিশে যাচ্ছিলো। সেই আনন্দ পরিবেশ সবাইকে আনন্দে ভাসালেও আমাকে ভাসাচ্ছিলো এক রাশ বিষন্নতায়। আমার ইচ্ছা করছিলো শুভ্রের কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকি। চেয়ে থাকি অতল আঁধারে। মিনু আপা বললো, কিরে শরীর খারাপ করছে? একটু শুবি? যা ভেতরে গিয়ে রেস্ট নে একটু। বসে থাকতে হবে না।আমি বললাম না। আমি ভালো আছি। তখন শুরু হয়েছে গান কবিতার আসর। সুরুচী তার কিন্নর কন্ঠে কবিতা আবৃতি করছে।
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা--
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
আসলেই আশঙ্কা জাগছিলো আমার মনে। কিসের আশঙ্কা জানিনা। মনে হচ্ছিলো আর ভালো কিছু হবে না কখনও কোথাও। বুকের মধ্যে জাগছিলো অকারণ হু হু আকুলতা। সুরুচীর কবিতায় ধ্বনিত হচ্ছিলো-
কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা!
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
আমার নিজেকে নীড় হারা পাখির মতই অসহায় বোধ হচ্ছিলো হঠাৎ।
কবিতা শেষ হলো। আমাদের অফিসের সবচাইতে মজাদার আর খানিক অশ্লীল কৌতুক বলা ফারিয়া আপা সে শুরু করলো তার দুষ্টামী ভরা কৌতুক গল্প। তারপর এলো আমার পালা। আমাকে গান গাইতে হবে। যদিও আমার খুব মন খারাপ লাগছিলো। তবুও সেই বিষন্ন সন্ধ্যায় আমি গান ধরলাম-
ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সূরে কাছে দূরে জলেস্থলে বাঁজায়
বাঁজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি।
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যাথা বাঁজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখি জলে যায় ভাসি ....
সবাই চুপ হয়ে গেলো। এমনকি ছুটোছুটি করা বাচ্চারাও। জানিনা কি ছিলো সেই গানে। গান শেষ না করতেই আমার বুকের মধ্যে ডুকরে উঠলো এক ঝাঁক কান্না। আমি কেঁদে ফেললাম। নাসিমা আপা ছুট এলো । কি হয়েছে কি হয়েছে। সবাই বোকা হয়ে গেলো। চেয়ে রইলো আমার দিকে.....
রাতে ডিনারের পরেও শুভ্র কেবিনে ফিরলো না। আমি নাসিমা আপাকে জিগাসা করলাম শুভ্ররা কোথায় গেছে?। নাসিমা আপা বললো, ওরে এত শুভ্র শুভ্র করিস কেনো বলতো? ওরা তাস পেটাচ্ছে, ফূর্তি করছে/ আমরাও কি কম? চল লুডু দাবা সব সাথে আছে। লতিফা আমের কাস্মীরি আচারের বয়াম এনেছে। আমরাও কি কম যাই। চল চল সুরভী ভাবীর কেবিনে চল। ওখানে লুডু খেলা হচ্ছে। আমি বললাম তুমি যাও নাসিমা আপা। আমি একটু ঘুমোই। আমার শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। নাসিমা আপা বললেন, কি হয়েছে বলতো? আচ্ছা তোদের কি বনিবনা নেই? কেমন কেমন লাগছে। আমার ভীষন লজ্জা হলো। ছি ছি সবাই কি ভাবছে!
আমার ভীষন মেজাজ খারাপ হলো। সব রাগ গিয়ে পড়লো শুভ্রের উপর। সবকিছুর জন্য শুভ্রই দায়ী। তার আচরণই সবাইকে এমনটা ভাবাচ্ছে এমনই মনে হলো আমার। রাগে দুঃখে ক্ষোভে আর লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। খুব তাড়াতাড়ি সুনিপুন অভিনয়ে সেই অনুভূতি ঢেকে ফেলে আমি বললাম নাহ শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। আসলেই আমার বিশ্রাম দরকার। আমি কেবিনে ফিরে এলাম। কিন্তু চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। হঠাৎ জাহাজের ভেপু শুনেই বুঝি ঘুম ভেঙ্গে উঠলাম।
তখন মধ্যরাত। জাহাজ বোধ হয় মধ্য সাগরে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো থালার মত গোল চাঁদ। আমি দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সব দস্যি ছেলেমেয়েদের চোখে ঘুম নেমেছে। সন্ধ্যায় সেই কলকাকলী মুখর ডেকে শান্তির নীরবতা। শুধু জাহাজের ঘুটঘুট এক টানা শব্দ আর বাতাসের শিশ ছাড়া আর কোনো শব্দই নেই কোথাও কোনো। এক সাইডে ফ্লোরের উপর মনে হয় কয়েকজ জাহাজের খালাসীরাই হবে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিলো। আমি আরেক সাইডের রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশে পূর্নিমার বাঁধভাঙ্গা হাসি। আর পানিতে তার আলো চিকচিক মনিমুক্তো ঝলকাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো কোনো জলদেবী বুঝি হঠাৎ উঠে আসবে জলের নীচে থেকে আঁধার ফুঁড়ে। আমি গুন গুন করছিলাম নিজের অজান্তেই।
খেলিছে জল দেবী সুনীল সাগর জলে
আনন্দ উছলি ওঠে ফেনায়িত কল্লোলে ....
আমি আর ঘুমাইনি সে রাতে। কেবিনে ফিরে রফিক আজাদের কবিতা নিয়ে বসেছিলাম। ভোরের দিকে শুভ্র এলো। লাল টকটকে চোখ। মনে হয় সন্ধ্যা থেকেই মদ গিলেছে। খুব সন্তর্পণে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আমাকে দেখে একটু থমকালো। বোকার মত হাসি দিয়ে জিগাসা করলো, তুমি ঘুমাওনি? আমি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। জানতে চাইলাম ও মদ খেয়েছে কিনা? শুভ্র অবলীলায় জবাব দিলো হ্যাঁ। কেনো তুমি জানোনা আই লাইক ড্রিংক পার্টি? তবে যাই হোক আমি জাঁতে মাতাল তালে ঠিক। একটুও টলবোনা। বলে সেই বোকার মত গা জ্বলানো হে হে হাসি দিলো। শুভ্র শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়লো বোধ হয়।
আমার নিজেকে হতাশ লাগছিলো। আজ প্রথম মনে হলো অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। যার হয়ত আর প্রায়েশ্চিত্ত নেই........
আমরা ওখানে পাঁচদিন ছিলাম। পরদিন ভোর হতে শুভ্র আবার মোটামুটি স্বাভাবিক আচরণ করলো। কিন্তু আমি আর স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। তবে পাঁচদিনই সন্ধ্যায় সে অত বড় গ্রুপটার মধ্য থেকে যে কয়েকজন ড্রিংক লাভার ছিলো তাদেরকে নিয়মিত সঙ্গ দিয়ে গেলো। আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না। কিন্তু আমি খুব সহজে মানুষের সামনে নিজেকে নত করি না। তাই সুনিপুন অভিনয়ে হাসি মুখেই কাটালাম সে কটা দিন সবার সাথেই। শুভ্রের সাথে আমার খুব কম কথা হলো। তাতে শুভ্রের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।
সুন্দরবন ট্রিপের সুন্দর যে কটা দিন আমার মনে পড়ে তার মধ্যে সেই মনিমুক্তো ঝলকানো রাতের হিম হিম বাতাসে শরীর আর মন জুড়িয়ে যাওয়া সময়টুকু আর একদিন দুপুরের জাহাজের উপর দিয়ে উড়ে চলা মাছ ধরা শিকারী চিলদের ডানায় ঝলকানো রোদের অপূর্ব
সৌন্দর্যটুকু জেগে থাকে। আর একটা মজার আর সুন্দর স্মৃতি অবশ্য আছে। সেটাও ঐ হতাশাময় দুঃসময়ের এক অমূল্য সম্পদ।
যখন আমি মুগ্ধ চোখে ঐ চিলদের জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাছ ঠোঁটে করে উড়ে যাবার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। সেখানে আগে থেকেই বসেছিলো খাতা পেন্সিল হাতে এক নীল চোখের বিদেশী যুবক। সে আকাশের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে আমার দিকে এসে জানতে চাইলো সে আমার একখানা পোট্রেট আঁকতে পারে কিনা। আমি অনুমতি দিতেই সে ঝপঝপ করে এদিকে সেদিকে কয়েকরকম পেন্সিলের আঁচড়ে একে ফেললো আস্ত একখানা অবিকল মানুষের মুখ! আর সে মুখটাই আমার! আমি বিস্মিত হলাম। চরম বিস্মিত! এভাবে এত তাড়াতাড়ি কেউ কখনও অবিকল মুখ আঁকতে পারে। মানুষের মুখ! জানা ছিলো না আমার।
আঁকা শেষে ছবির নীচে তার দূর্বোধ্য সিগনেচার দিয়েই আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো আমার ছবিখানি। আমি ধন্যবাদের ভাষাও খুঁজে পেলাম না। সেই ছবিটা আমার বেডরুমের দেওয়ালে বাঁধানো আছে। প্রায়ই সেই ছবির দিকে চোখ পড়লেই আমার মনে পড়ে দেবদূতের মত আমার বিষন্ন দুপুরে হাজির হয়ে যাওয়া সেই প্রসন্ন মুখের শিল্পীকেই। সাথে সাথেই মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ সেই শুরু। সেই আনন্দ উচ্ছাসে মাখা ট্রিপটাই আমাকে ভিন্নভাবে ভাবতে আর ভাবাতে শুরু করেছিলো। একটু একটু করে দূরে নিয়ে গিয়েছিলো আমাকে আমার শুভ্রের থেকে। কাছাকাছি পাশাপাশি থেকেও আমি সরে যেতে শুরু করেছিলাম শুভ্র থেকে যোজন যোজন দূরে ......
চিলেকোঠার প্রেম - ১৪
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১০:১৪