খুব ভোরে বাসে করে রওয়ানা দিলাম আমরা। জার্নীর জন্য দিনটা মোটেও সুবিধার ছিলো না। একে আষাঢ় মাস তাই বাস জার্নী। কিন্তু সেসব দিনে আমাদের কাছে কোনো বাঁধাই আসলে বাঁধা ছিলো না। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার অসীম সাহস ছিলো বা কোনো ভাবনা চিন্তাই ছিলোনা এখনকার মত।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো তার মাঝেই হেলেদুলে রওয়ানা হলো আমাদের বিশাল বাসটি। এসি বাসের ভেতরে হিমেল পরিবেশ আর ঢাকা ছাড়িয়ে গ্রামের পথ পেরিয়ে সবুজ প্রান্তর। শুভ্রের কাঁধে মাথা রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম আমি। আমাদের কানে বাঁজছিলো রবীন্দ্র সঙ্গীত।
তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে
তখন ছিলেন বহুদূরে ........ কিসের অন্বেষনে!
একই মাইক্রোফোনের দু প্রান্ত আমাদের দু'জনের কানে লাগানো ছিলো। কিন্তু শুভ্র এক কার্ল মাক্সের বই খুলে নিয়ে বসেছিলো কাজেই গানের বাণী তার কানে পৌছোচ্ছিলো কিনা জানিনা। তবে আমি শুভ্রের ডান বাহু জড়িয়ে রইলাম।
লিখন তোমার বিনি সুতোর শিউলি ফুলের মালা
বাণী সে তার সোনায় ছোঁয়া অরুণ আলোয় ঢালা.......
গানের বাণীতে ডুবে ছিলাম আমি। মনে পড়ছিলো পুরো এপিসোডটাই। শুভ্রের সাথে পরিচয়ের সেই দিনগুলো। নিতান্তই তাকে সাদা মাটা একটা ছেলে ভাবা। যখনই অনলাইন হতাম তখনই মেসেঞ্জার বা ফেসবুকে এভেইলাবল সাইনে শুভ্রকে দেখে ভাবতাম এই ছেলে কি বাইরে যায় না! এর কি কোনো বন্ধু বান্ধব নেই!
অবাক হতাম এই বয়সের ছেলেরা বিকাল সন্ধ্যাটুকুও বাড়ি্তে বসে কাটায় নাকি! দিনকে দিন শুভ্রকে নিয়ে চিন্তায় পড়ছিলাম আমি। এর কাজ কি? এ কি ফেরারী আসামী? নাকি কোনো কুনোব্যাঙ? সবচেয়ে অবাক হলাম একদিন তার ঐ চিলেকোঠার রুমে তার বন্ধুদের ড্রিংক পার্টির কথা শুনে। এটা নাকি ওদের ভার্সিটির ছেলেদের কমন ব্যপার স্যাপার মাঝে মাঝেই নাকি এর ওর রুমে মদ পার্টি, গাঁজা পার্টি এসব বসে যায়। এই কথাগুলি শুভ্র যখন অবলীলায় বলছিলো আমার চক্ষু তখন তো ছানা বড়া থেকে তাল বড়া। কারণ এই মিচকে টাইপ ভোলে ভালে ছেলেটা কি না এমন পাঢ় মাতালদের মত ড্রিংক পার্টি করে! তাও আবার বলছে অবলীলায়!
আমি বললাম, শুভ্র আমি মাতাল খুব ভয় পাই। শুভ্র বললো, নো ভয় আমি জাঁতে মাতাল তালে ঠিক। কখনই মাতলামী করে তাল হারাই না। আমার এই মাতাল ভয় পাবার পিছে একটা ঘটনা ছিলো। আমার জীবনে আমি এমন একজন মানুষকে দেখেছি মাতাল হলে তার হিতাহিত লোপ পেত। তখন তার শিক্ষা ভদ্রতা বা ভালোবাসা বা সন্মান জ্ঞান কিছুই কাজ করতো না তার মাঝে। এই ব্যাপারটা আমার চোখে আমার কাছে যেমনই অশ্লীল তেমনই ঘৃনার ছিলো। তাই যেদিন শুনলাম ওর বাসায় ওর ড্রিংক পার্টি বন্ধুরা জড়ো হয়েছে আমি এক্কেবারেই তাকে নক করলাম না। পরদিন দেখলাম সে ১০০% নর্মাল। আমার দেখা মাতালের সাথে তার কোনোই মিল নেই। শুভ্রের উপর আমার প্রথম আস্থা এলো। বুঝলাম এই ছেলে মাতাল হয়েও নিজেকে সামলাতে পারে! বাহ! এ তো দেখছি বিশাল গুন! হা হা ভাবলে হাসি পায় মানুষ মাঝে মাঝে এমন বোকামী সমর্থন করে তার পছন্দের বা ভালোবাসার পাত্র বা পাত্রীর জন্য।
এরপর ধীরে ধীরে বুঝলাম যত সাদাসিদা সহজ সরল ভেবেছিলাম শুভ্রকে শুভ্র মোটেও তা নয়। শুভ্র এক গভীর জলের মাছ। তাকে ধরা এবং ছোঁয়া সাধারণ মানুষের কম্ম নয়। সব চেয়ে মজার ব্যাপারটাই হলো কখনও তাকে খুব সোজা সাপ্টা কখনও তাকে অচেনা মনে হয়। কখনও মনে হয় ভীষন জানা কখনও অজানা। ওকে আবিষ্কারের নেশায় পড়লাম আমি। আমার নিজের আসলে কাউকে আবিষ্কার করার
ইচ্ছা বা টাইম কোনোটাই ছিলো না। আমি ছিলাম আপনার মাঝে আপনি হারা। নিজেেকে নিজেই আবিষ্কার করে টাইম পেতাম না আবার অন্য মানুষ। তবে শুভ্র তার জহুরীর চোখে আমাকে যে পর্যবেক্ষনে রেখেছে। আমার প্রতিটা পদক্ষেপেই তার আছে সতর্ক দৃষ্টি তা যখন জানলাম বা বুঝলাম খুব অবাক হলাম। প্রথমেই মনে প্রশ্ন এসেছিলো কেনো? আমাকে এত জেনে শুনে কি লাভ এই পিচকাটার? যেহেতু সে দু বছরের জুনিয়র ছিলো তাকে বন্ধু মনে হলেও পিচকাই ভাবতাম আমি। আসলে শুভ্র কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুদ্ধিতে যে ৮০ বছরের বুড়ামানুষকেও ছাড়িয়ে যায় তখনও জানতাম না আমি।
শুভ্র যে কখনও আমার প্রেমে পড়তে পারে বা এই কথাটা মাথাতেও আনতে পারে তা আমার মাথাতেই আসেনি আসলে কোনোকালে। প্রেম যদিও জাত ধর্ম বিধি নিষেধ মানে না তবুও কোনোদিক থেকেই শুভ্র আমার প্রেমে পড়বার কথা যে ভাবতেও পারবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমাদের সমাজে নিজের চাই্তে বয়সে বড় মেয়ের সাথে প্রেম এতো ভাবনাতে আনাও বিরল। কিন্তু শুভ্র যেদিন বললো, সে আমার প্রেমে পড়ে গেছে আমি আকাশ পাতাল সাগরে হাবু ডুবু খেতে লাগলাম। এই আজগুবী আচমকা কথা শুনে। আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হয়নি সে আমার প্রেমে পড়তে পারে কিংবা আমি। কিন্তু আমার কাছে সে ছিলো মহামূল্যবান এক বন্ধু। তার কিছু ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং আমার নিজের কিছু সমস্যা সমাধানে তার বাতলানি বুদ্ধি এমনভাবেই কাজ করেছিলো যে আমি তার উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়ছিলাম। মনে হত আমার সারাটাজীবন শুভ্রকে লাগবে। আমার পাশে বন্ধু হিসাবে। প্রেমিক বা স্বামী হিসাবে ভাবিনি।
শুভ্র আমাকে বলতো। আজ থেকে ২০/৩০ বা ৪০ বছর পরে হলেও আমি একইভাবে তোমার বন্ধু থাকতে চাই। আমার বাড়িতে আমার বউ ছেলেমেয়ের সাথে সন্ধ্যার ইভনিং টি টেবিলে তোমাকে পেতে চাই। হা হা সেই সব কথা শুনে আমি মনের আয়নায় দেখতে পেতাম। সেই ৪০ বছর পরের শুভ্রকে। একটু সাস্থ্য মোটাসোটা হয়েছে। কোকড়া চুলগুলি ব্যাকব্রাশ করে পিছে ঠেলে দেওয়া। গালে ভাজ পড়েছে। ডাবল চিন। কাঁচাপাকা চুল। সঙ্গে অপূর্ব সুন্দরী এক ছোটখাটো বউ। শুভ্র যদিও ৬ ফুটি কিন্তু বউটাকে স্বপ্নে কেনো জানি ছোট খাটোই দেখতাম আমি। সঙ্গে দুইটা ফুটফুটে শিশু। একটা ছেলে একটা মেয়ে। গোল চায়ের টেবিলটা ঘিরে বসে থাকতাম আমরা। টি পটে চা, সামনে বিস্কিট, বাদাম, নিমকী ফলমূল এসব রাখা থাকতো। নিমকী কেনো দেখতাম? কারণ মনে হত শুভ্রের বউ খুব সহজ সরল সুন্দর একটা মেয়ে হবে যে কিনা হবে খুবই সুগৃহিনী। নিজে হাতে বানানো নিমকী বয়ামে ভরে রাখবে সে।
হা হা মানুষ ভাবে এক, স্বপ্ন দেখে এক আর হয় আরেক। সেটাই হলো আমার আর শুভ্রের জীবনে। বলা নেই কওয়া নেই শুভ্র হঠাৎ বলে বসলো। সে আমার প্রেমে পড়েছে। আমাকে ছাড়া সে কিছুই আর ভাবতে পারছে না। আমার বাক রোধ হয়ে গেলো। বলে কি এই ছেলে! পাগল হলো নাকি! আমি পালালাম! পাক্কা পাঁচদিন হাওয়া হয়ে গেলাম! আর এই পাঁচদিন আমি ভাবছিলাম শুধু ভাবছিলাম। কি বলবো এখন আমি ওকে? আমার কি হ্যাঁ বলা উচিৎ নাকি না? প্রেমে পড়া মানে কি? একটা কমিটমেন্ট। তার সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া। তার সুখ দুঃখ ও বিপদের দিনেও পাশে থেকে সাহস জুগিয়ে যাওয়া। তার ভালো মন্দ নিয়ে বাস করা! হায় হায় আমি কি করে সেটা করবো? আমি কি ঐ চিলেকোঠায় থাকতে পারবো নাকি? নাকি ওর সাথে সব মানিয়ে নিতে পারবো? না বলে দিলে যদি শুভ্র হারিয়ে যায়। আর কখনও দেখা না করে আমার সাথে? আমি কি করে থাকবো? আমার তো রোজকার দিনলিপিতে জড়িয়ে আছে সে। শুভ্র ছাড়া একটা দিনও আমি ভাবতে পারি না। কিন্তু পাশাপাশি এও সত্যি শুভ্রের লাইফস্টাইল আর আমার লাইফস্টাউলে ব্যপক ফারাক। আমি কি বদলাতে পারবো? নাকি সেই পারবে? নিজেকে নিয়েই ভয় ছিলো আমার বেশি। এত সব নানা রকম ভাবনায় কেটে গেলো কয়েকটা দিন।
পাঁচদিন পর যখন ওকে ফোন দিলাম, শুভ্র খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো, কি ম্যাডাম, এই দীর্ঘ সময় আপনার হৃদয়ের মাঝে কি ভাঙ্গচুর চললো, কি টানাপোড়েন চালালেন? আর চালিয়ে কি উত্তর পেলেন? এমন রাগ লাগলো। শয়তান বলে কি? এই কয়টা দিনে শুভ্র কিন্তু আমাকে একটাবারও কল করেনি। সে কাউকে কখনই বিরক্ত করা পছন্দ করে না। সবার মতামতের মূল্য আছে তার কাছে। শুধু নিজের ব্যাপারে নো কম্প্রোমাইজ। যদিও আমার জন্য সে অনেক কিছুই কম্প্রোমাইজ করেছিলো। শুভ্র আমাকে নিরুত্তর দেখে আবারও বললো, ভয় পেওনা। তুমি নির্দ্বিধায় নো করে দিতে পারো। আমি জানি এসি ছাড়া তুমি একরাতও ঘুমাতে পারো না আর আমার ফ্যানটাই ঠিক মত চলে না। তুমি সকালে খাও সিরিয়াল, মাখন রুটি, পাস্তা পনির আর আমি কি বান যেন নামটা বলেছিলো। ভুলে গেলাম এখন। ঐ যে একটা বান রুটির মত ভেতরে মিষ্টি দেওয়া একটা রুটি পাওয়া যায় না? ১০ টাকা দাম সেটা। সেটা প্রায় সকালেই নাস্তায় খেত সে। যাইহোক এমন নানা রকম অসামঞ্জস্যের কথা বলে চললো সে।
উফ বাঁচলাম হাফ ছেড়ে। সে সব অসামঞ্জস্য আমি বলতে পারছিলাম না চক্ষুলজ্জায় সে সব নিজেই বলে দিলো। কথা সত্যি হুট করে হ্যা বলে দেবো এসব না ভেবেই অতোটা গাধা আমি ছিলাম না। তবুও না করবো কিভাবে ভেবেই পাচ্ছিলাম না। শুভ্র এসব ভেবে বললো দেখে যেমনই অবাক হলাম তেমনি শান্তি পেলাম। যাক শুভ্রও তাহলে জানে সমস্যাগুলো। কিন্তু পরক্ষনেই শুভ্র বললো আমি সবই জানি, তাই কখনও তোমাকে বলবোনা আমাকে বিয়ে করো। কারণ আমার বাসায় কখনই স্যুট করতে পারবেনা তুমি। কিন্তু প্রেমে পড়ে গেছি এ কথাও তো সত্য তাই না বলে চুপ করে থাকা ঠিক না মনে হওয়াতেই বললাম। আর জানতে চাই তুমিও কি আমাকে ভালোবাসো?
হ্যাঁ ভালোবাসি। একশোবার ভালোবাসি আমি শুভ্রকে। কিন্তু সেটা কি প্রেমিকের মত? ভেবে দেখিনিতো। শুধুই একজন বিশস্ত বন্ধু। যাকে পরম নির্ভরতায় বিশ্বাস করা যায়।আস্থা করা যায়। ভালোওবাসা যায়। কিন্তু প্রেমিকের জায়গাটা কি দেওয়া যায় তাকে? কোনোদিক থেকেই মেলাতে পারিনা আমি। কিন্তু কি বলছে শুভ্র প্রেমে পড়েছে কিন্তু বিয়ে করতে বলবে না। মানে কি? বেটার মতলব খানা কি? আমি বলেও ফেললাম। মানে কি? প্রেমে পড়বা কিন্তু বিয়ে করতে হবে না মানে কি? শুভ্র হাসলো, বললো আসলে বিয়ে করাটা হয়ত ভুল হবে। তুমি মানাতে পারবেনা কিন্তু প্রেমে পড়া কি আমার ভুল বলো? দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘন্টা কেটেছে তোমার সাথে। আমি কি করবো?
আসলেও তো। এই দিকটাতো আমি খেয়াল করিনি। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিলো। আমি বললাম শুভ্র আমিও তোমাকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া একটা দিনও ভাবতেই পারিনা আমি। শুভ্র চুপ করে থাকলো। আমি ফোন কেটে দিলাম। একটু পর ও আমাকে একটা গান পাঠালো। গানটা মনে আছে। আসলে কিছুই ভুলিনি আমি। তিল তিল করে সবই মনে আছে আমার। গানটা ছিলো-
মোর বীণা ওঠে কোন সূরে বাজি..কোন নব চঞ্চল ছন্দে ।।
মম অন্তর কম্পিত আজি নিখিলের হৃদয় স্পন্দে!!
আসে কোন তরুণ অশান্ত, উড়ে বসনাঞ্চল প্রান্ত,
আলোকের নৃত্যে বনান্ত মুখরিত অধীর আনন্দে।
অম্বর প্রাংগন মাঝে নিঃস্বর মঞ্জীর গুঞ্জে।
অশ্রুত সেই তালে বাজে করতালি পল্লব পুঞ্জে ।।
কার পদ পরশন-আশা তৃনে তৃনে আর্পিল ভাষা ।।
সমীরণ বন্ধনহারা উন্মন কোন বনগন্ধে ।।
হা হা মনে করে হাসি পায় আমার। তবে কি শুভ্রের মনের মাঝে সেই কথা কোনো অজানা বীনার সূর বাঁজিয়েছিলো? শুভ্র রোমান্টিক কথা আমার চেনা জানা বা পড়া কবি সাহিত্যিকের মত গুছিয়ে বলতে পারতো না। তাই বুঝি ঐ গান দেওয়া। তবে যাইহোক না কেনো আমার ঐ গানের দুটি কলি আজও কানে বাজে গুন গুন-
আসে কোন তরুণ অশান্ত, উড়ে বসনাঞ্চল প্রান্ত,
আলোকের নৃত্যে বনান্ত মুখরিত অধীর আনন্দে।
আজ হঠাৎ মনে হতেই আমার হাসি পেলো আর আমি শুভ্রের বাহুতে একটা চিমটি বসিয়ে দিলাম। শুভ্র উহ করে উঠলো। অবাক হয়ে চাইলো আমার দিকে। বাসের লোকজন বেশিভাগই তখন ঘুমে ঢুলছিলো। শুভ্র বইটা বন্ধ করে সকলের অগোচরে আমার কপালে চুমু দিলো। আমি গানটা ফের বাজিয়ে দিলাম। ফিসফিস করে বললাম। মনে পড়ে এই গানটার কথা? শুভ্র হা করে তাকিয়ে রইলো। বললো তুমি শুনিয়েছিলে? আমি ফের ওর পেটে আরেকটা চিমটি দিলাম। চোখ রাঙ্গিয়ে বললাম, ভুলে গেছিস?
শুভ্র চিমটি খেয়ে ভয়ে বললো, না না ভুলিনি কি যেন মেন হেন তেন .... হা হা হা হ। আমাদের দুজনের হাসিতে বাসের লোকজন নিদ্রা ভেঙ্গে কেউ কেউ চমকে আর কেউ কেউ বিরক্তিতে তাকালো......আমি বললাম, শুভ্র সেই কবিতাটা শোনাও। শুভ্র ফের বলে কোনটা? আমি বললাম আবার আরেকটা চিমটি লাগবে? শুভ্র ভয়ে আৎকে উঠে বললো না না আরে বলোই না কোনটা? আমি বললাম ঐ যে যেটা প্রথম শুনিয়েছিলে। প্রেম নিবেদনের সময় কত কবিতা, কত গান, আর এখন মনে নাই শয়তান? ওহ শুভ্র কষ্টে সৃষ্টে মনে করতে চেষ্টা করলো। আমি আস্তে করে ওর দু আঙ্গুলে ওর গালটা ধরে বললাম, চিমটি? সে আমার হাত চেপে ধরলো। তারপর কল করলো ঠিক সেই রাতের মত। কানে কানে ফিস ফিস........
সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার -
আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে …
জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো।
তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাবে ব’লে যে-প্রেমিক
ফেলে রেখে গেছে পথে, জানি, তার মিথ্যে বাগদান
হাড়ের মালার মতো এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে।
আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?
শোনো, আমি রাত্রিচর। আমি এই সভ্যতার কাছে
এখনো গোপন ক’রে রেখেছি আমার দগ্ধ ডানা;
সমস্ত যৌবন ধ’রে ব্যধিঘোর কাটেনি আমার। আমি একা
দেখেছি ফুলের জন্ম মৃতের শয্যার পাশে বসে,
জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোস্নার ধারণা দেব ব’লে
এখনো রাত্রির এই মরুভুমি জাগিয়ে রেখেছি।
দ্যাখো, সেই মরুরাত্রি চোখ থেকে চোখে আজ পাঠালো সংকেত -
যদি বুঝে থাকো তবে একবার মুগ্ধ করো বধির কবিকে;
সে যদি সংকোচ করে, তবে লোকসমক্ষে দাঁড়িয়ে
তাকে অন্ধ করো, তার দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার…
পৃথিবী দেখুক, এই তীব্র সূর্যের সামনে তুমি
সভ্য পথচারীদের আগুনে স্তম্ভিত ক’রে রেখে
উন্মাদ কবির সঙ্গে স্নান করছো প্রকাশ্য ঝর্ণায়।
এতদিন পরেও সেই কবিতা শুনে আমি লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে উঠলাম এক গাড়ির মানুষের ভীড়েও। সেদিন ছিলো রাত দুপুর আর আজ ভরদুপুরেও একই অনুভুতি শির শির করে বয়ে গেলো আমার অজানা তন্ত্রীতে........ শুভ্র আমার অবস্থা দেখে দুষ্টুমীতে হাসছিলো। আমি এইবার তো লজ্জায় সাত রং গিরগিটি হয়ে মুখ লুকালাম ওর কাঁধে.......
চিলেকোঠার প্রেম- ১৩
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৪৮