somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিলেকোঠার প্রেম- ১৩

২৭ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দিন দিন শুভ্র যেন পরম নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ছে। পরীক্ষা শেষ। পড়ালেখাও নেই, চাকুরীও নেই আর চাকুরীর জন্য তাড়াও নেই তার মাঝে। যদি বলি শুভ্র কি করবে এবার? সে বলে কিছু করতেই হবে? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। বলে কি! কিছু করবেনা নাকি! আমার এই অতি উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ার কারনটাই মনে হয় বাবার বাড়িতে বসবাসটাই। আমি একা জব করে ঐ চিলেকোঠাতেও আজীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম শুভ্রকে নিয়ে যদি না এই বাড়িটাই না আসতাম। শুভ্র জব করুক বা না করুক মাথা ব্যথা ছিলো না আমার। এমন সক্রেটিস টাইপ স্বামী নিয়ে আজীবন আনন্দে হেসে খেলে কাটাতে পারতাম আমি। কিন্তু সমাজ ও সংসারের রক্তচক্ষু আমি ভেতরে ভেতরে উপেক্ষা করতে পারছিলাম না আর।

আমার পীড়াপীড়িতে এক রাতে শুভ্র বসে প্রায় একশো সিভি একসাথেই ছেড়ে দিলো। সকালে আমি চোখ মেলতেই বললো, দেখো এতগুলো সিভি দিয়েছি। এমনকি দারোয়ানের জন্য পোস্টেও এপলাই করে দিয়েছি। বলে হেহে করে হাসতে লাগলো আবারও। আগে ওর এমন সব আজগুবী রসিকতায় হাসতে হাসতে মারা যেতাম আমি। কিন্তু জীবনযুদ্ধে উদাসীন এই ছেলের এমন আজগুবী রসিকতাকে আজ বড় সস্তা মনে হলো। ভেতরে ভেতরে ভীষন বিরক্ত হলাম আমি। ভাবছিলাম কি ভাবছে শুভ্র? ওর নিজের কোনো গরজ নেই? সব কিছুতেই কি ফান করা যায়? এটা কি সিনেমা নাকি যে উনি দারোয়ানের পোস্টের জন্যও এপলাই করে দিলেন?


বাড়িতে শর্টস পরে থাকা শুভ্র এখন শ্বশুরবাড়িতেও শর্টস পরে বসে থাকতে চায়। এ ব্যাপারটা মা ঠিক পছন্দ করছেন না। কিন্তু শুভ্র এ ব্যাপারেও উদাসীন। সে বলে দেখো বাবা এত আদিখ্যেতা ভালো লাগে না আমার। এমন করলে আমি কিন্তু শান্তিতে থাকতে পারবোনা। তুমি কি চাও আমি অশান্তি নিয়ে এখানে থাকি? দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার। না চাইনা। আমি চাই শুভ্র অনেক অনেক ভালো থাকুক। অনেক আনন্দে। ঠিক ওর মত করেই ও যেমন চায়। কিন্তু এ বাড়িতে আসার পরে ওর চাওয়া পাওয়ার উপরে কিছু এ বাড়ির প্রভাব খাটানো হচ্ছে ওর অজান্তেই। ব্যাপারটা পীড়া দিচ্ছে আমাকেও।

শুভ্র অনেক মেধাবী। খুব ছোট থেকেই সে বেশ মেধার পরিচয় দিয়েছিলো তার স্কুল কলেজের রেজাল্টগুলোতে। সে কথা ওর বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাই ও বলেছেন। কিন্তু শুভ্র কেমন জানি এমবিশানলেস। এত ভালো মেধা এত ভালো রেজাল্ট নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই নেই যেন ওর। দিনরাত বই এ ডুবে থাকে। আর এ বাড়িতে আসার পর ও যেন ওর স্বর্গ হাতে পেয়েছে। বাবার সাজানো বিশাল লাইব্রেরী। বাবাকে কোনোদিন একটা বইও পড়তে দেখিনি কিন্তু বছরে বছরে দেশ বিদেশের বই দিয়ে লাইব্রেরী সাজাতে দেখেছি। সেই লাইব্রেরী সাজানো সার্থক হলো বুঝি শুভ্রের মত জামাইকে পেয়ে।

আমি একদিন বললাম শুভ্র তোমার জীবনের এইম কি ছিলো? সে অবলীলায় বললো, লেখক হওয়া। আমি শুধু লেখক হতে চেয়েছিলাম।
ট্রাভেলিংও আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু কখনও দেশের বাইরেই যাওয়া হলো না আমার। কিন্তু বান্দরবান, নাফাখুম খুব এনজয় করেছি আমি বন্ধুদের সাথে। আমি যদি পারতাম একটা পাহাড় কিনতাম। সেখানে বাড়ি করতাম। খুব ছোট্ট একটা কুড়েঘর। আমি জানতে চাইলাম তুমি কি সন্যাসী হতে চাও? সে বললো। নাতো কখনও সন্যাসী হতে চাইনি আমি। কিন্তু আমার খুব বন্য বাঁধনহীন জীবন পছন্দের।

আমি বললাম, শুভ্র পাহাড়ে তো জংলী জানোয়ার আছে। কুঁড়েঘরে তো বাঘ ভালুক ঢুকে যাবে। তার চেয়ে চলো আমরা পাহাড়ে বড় একটা গাছের উপর ট্রি হাউজ বানিয়ে বাস করা শুরু করি। সবুজ লতাপাতা আর ফুলফলে রোজ সাজাবো আমাদের ঘরবাড়ি আর সামনে থাকবে স্বচ্ছ জলের ঝর্ণা। আমরা সেখান থেকে হাতে করে আজলা ভরে পানি খাবো। ঝর্ণার কলকল জলধারায় গোসল করবো। বনের ফল মূল খেয়ে আনন্দে বাঁচবো টারজানের মত ছাল বাকল পরবে তুমি আর গাছের শিকড় ঝুলে ঝুলে ঘুরে বেড়াবো আমরা। হা হা হা হা । শুভ্র বললো, আমি ছাল বাকল পরবো আর তুমি তুমি বুঝি শাড়ী পরবা!! না!! তোমাকে তোমাকে ....... আমাকে কাতুকুতু দিতে দিতে মেরেই ফেললো প্রায় শুভ্র। হাসতে হাসতে মারা যাচ্ছিলাম আমরা।

মর্নি সিকনেস কমে আসছিলো আমার। মায়ের আদরে যতনে খুব অনায়াসেই অফিস করেও কোনো ক্লান্তিই যেন বোধ করছিলাম না আমি। জ্যুস থেকে শুরু করে সকল রকম খানা পিনা ঔষধ পত্রের যোগান ঠিক ঠাক চলছিলো ঘরে ও বাইরে। রাক্ষসের মত খিধা লাগে আমার আজকাল। ওজনও বেড়েছে কিছুটা। মা দুনিয়ার সব প্রাগন্যান্সি ড্রেস থেকে শুরু করে যত রকম গর্ভবতীর যত্নের বই খাতায় তার বেড রুম ভরে ফেলেছেন। আমার চাইতে মায়ের চিন্তা বেশি আমার বেবিকে নিয়ে। কি খেতে হবে কি পরতে হবে, কতক্ষন ঘুমাবো কতক্ষণ হাঁটবো। এসব অত্যাচারে বিরক্ত লাগে মাঝে মাঝে তবে আনন্দে আর পরম নির্ভরতায় ডুবে থাকি। আমার যেন কোনোই চিন্তা নেই। সকল দায়িত্ব মায়ের।

শ্বশুরমশাই রোজ ফোন দেন। খোঁজ নেন কেমন আছি আমি। একগাদা উপদেশ দেন। আক্ষেপ করেন এমন সময় তিনি আমার জন্য কিছু করতে পারছেন না। অথচ বংশের প্রথম সন্তান আসছে। শ্বাশুড়িও মাঝে মাঝে ফোন করে। উনি দারুণ মজার আমসত্ব আর কুল বরই তেঁতুলের আচার পাঠিয়েছেন। আর রসে ডোবানো রসগোল্ল্লার মত তেলে ডুবানো আমের মিষ্টি আঁচার। একটা মুখে দিয়ে মনে হয়েছিলো অমৃত বুঝি একেই বলে। হরলিকসের কাঁচের বয়ামে ছোট্ট ছোট্ট কালচে রসগোল্লার মত সেই আচার। ঐ আচার আমি পরে নিজেও বানিয়েছিলাম ওমন স্বাদ আর পাইনি। যাইহোক ভেবেছিলাম কয়েকদিন ধরে একটু একটু করে খাবো। এত মজার জিনিস ফুরিয়ে গেলে কোথায় পাবো?

তাতে কি! ওমা পরদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি এক বোতল আচার শুভ্র একাই সাবাড় করে বসে আছেন। এমন রাগ হলো? বললাম ঐ এই আচার কি তোর মা তোর জন্য পাঠাইসে? সব খেয়ে ফেললি কেনো বল বল বল? বালিশ দিয়ে ওকে মারতে মারতে আমি প্রায় খাট থেকে নিজেই পড়ে যাচ্ছিলাম। শুভ্র তাড়াতাড়ি আমাকে ধরে ফেললো। ও আমার কান্ড দেখে হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছিলো। বললো আরে আচার খাওয়ার জন্য কোনো বউ তার হাসব্যান্ডকে মারে জীবনে শুনেছো? আমি বললাম ঐ আচার খাওয়ার জন্য আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে আর তুমি কিনা...... শুভ্র বললো, কালই মাকে বলবে ১০ বোতল পাঠাতে কিন্তু ৫টা আমার আর ৫টা ওর। আমি আবার ওকে ফেলে রাখা বালিশ দিয়েই পেটাতে শুরু করলাম আর ও হাসতে হাসতে মরে প্রায়....

মাকে প্রায়ই আমি প্রশ্ন করি মা আমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে? কি মনে হয় তোমার? আমি কিন্তু ছেলে চাই। জানো শুভ্রের ইচ্ছা একটা মেয়ে হোক। তুমি বলো মা ছেলে বেশি ভালো না? মা বকা দেন, চুপ কর, ছেলে হোক মেয়ে হোক একটা সুস্থ্য বাচ্চাই হোক সকলের চাওয়া। মায়ের কাছে ছেলে মেয়ের কোনো ভেদাভেদ নেই। মা শুধু অপেক্ষা করছেন একটি ফুটফুটে নাতীর মুখ দেখবার জন্য। আর আমি ভাবতে বসি। সেই অদেখা শিশুটির মুখ। ছোট্ট ছোট্ট হাত পা। নীল তোয়ালে জড়ানো ফুটফুটে একটা মুখ। নীল তোয়ালেই কেনো দেখি তা আমি জানিনা। চোখ বুজে কল্পনায় দেখি বেবি ওয়ার্ড্রবে ছোট্ট ছোট্ট জামা কাপড় থরে থরে সাজানো আছে। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো আছে রোদে দেওয়া ভিজা কাপড়গুলি... কত কিছু দেখি আমি। কল্পনায় বাচ্চাটা মাঝে মাঝে বড় হয়ে যায়। মা মা বলে আমাকে ডাকে। আমি আর শুভ্র দুজন ওর দুহাত ধরে হাঁটতে শেখাই.....

অফিস থেকে লম্বা পাঁচ দিনের ছুটিতে কলিগেরা সুন্দরবন যাবে ঠিক করলো। আমি বললাম আমিও যাবো। কলিগেরা দু একজন ইতস্থত করছিলো আমাকে নিতে। কিন্তু সকলের সাহসে তাদের উসখুস থেমে গেলো। মা এ কথা শুনে একদমই এলাউ করছিলেন না । কিন্তু আমার শখ আর ইচ্ছা দেখে বাবাকেও রাজী করিয়ে ফেললেন তিনি। শুধু তো পাঁচটা দিনই। শর্ত শুধু আমাকে নিজের যত্ন ঠিক ঠাক নিতে হবে। শুভ্রকেও পই পই করে বলে দিলেন আমার দিকে ঠিক ঠাক খেয়াল রাখতে। ঠিক সময়মত ওষুধ ও খানা খাই যেন খেয়াল রাখতে।
আর হাঁটাচলায় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের ব্যাপারটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝিয়ে দিলেন শুভ্রকেও। শুভ্র হু হা করে মাথা নাড়ছিলো। আমার ভীষন হাসি পাচ্ছিলো বাধ্য ছেলের মত শুভ্রের হু হা দেখে। আমি নিশ্চিৎ করে বলতে পারি মায়ের এ সকল উপদেশ তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কানে বের হয়ে গেলো।

আগের পর্বের লিঙ্ক
যাদের সেই গোল্লা আচারের রেসিপি লাগবে তাদের জন্য


সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:২৭
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×