রেড সিরামিকের ডুপ্লেক্স বাড়িটার সামনে বোগেনভেলিয়া আর বিশাল কুলোর মত পাতা নিয়ে প্রায় আমার সমান বয়সী মানিপ্লান্ট শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বোটল ব্রাশ হাসনা হেনা আর গন্ধরাজের চকচকে পাতাগুলো দুলছে সাদর অভ্যর্থনায়। তবুও যেন বিষন্ন মলিন মুখের সেই অস্ফুট সম্ভাষন শুনতে পেলাম আমি। বলছে ওরা, এমন করে চলে যেতে হয় খুকী? আমার ভীষন কান্না পেলো। আমি সেদিন ওদের কথা ভাবিনি। চলে যাবার সময় একটাবার ফিরেও তাকাইনি ওদের দিকে। অথচ জড় ও মুক এই জীবিত গাছ পালা তরুলতারা আমাকে ভুলতে পেরেছে? নিশ্চয়ই না। আমার আগমনে আমার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির কষ্টটাই যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ওরা বিষন্ন মুখে।
মা বারান্দায় বসেছিলেন। আমাদের দেখে উঠে এলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। মনে পড়লো যেদিন চলে যাই সেদিন শুধু বিস্ফারিত নেত্রেই তাকিয়ে ছিলেন মা। একটা কথাও বলেননি। একটাবারও জানতে চায়নি কোথায় যাচ্ছি। আজ তার মনের মধ্যে কোন অজানা লুক্কায়িত অভিমানে কেঁদে উঠলেন তিনি জানা নেই আমার। আমাদের আগমনে বাড়ির পুরোনো ঝি সখিনা, নতুন ক্লিনার মালেকা, আরও আমার অজানা দুটি ছেলে মেয়ে আমাদের আশে পাশে এসে দাঁড়ালো। সবার মুখেই বিষন্নতা ছিলো শুধু নতুন ছেলে মেয়েদুটির চোখে মুখে ঝিলিক দিচ্ছিলো অজানা কৌতুক। যেন সার্কাস দেখছে। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিলো। আজই প্রথম মনে হলো মানুষ একাই জন্মে একাই মৃত্যুবরণ করে কিন্তু মাঝের এই সময়টা মোটেও স্বার্থপর হওয়া উচিৎ নয়। নিজের জন্মস্থান, নিজের মানুষগুলোর কিছু দাবী থেকেই যায়। যার একটু হের ফেরেই অজ্ঞাত অভিমানে ভোগে তারা।
যাইহোক বহুদিন পর নিজের রুমে এলাম। আমার ব্যবহৃত সকল আসবাবপত্র, দেওয়ালের ছবি, চিরুনী, ফুলদানী, ল্যাম্প অবিকল একই ভাবে রয়েছে। আলমারীতে রাখা কাপড়গুলোও হয়ত সাজানোই আছে থরে থরে গোছানো পরিপাটি। মনে হচ্ছে গতকালই এই রুম থেকে গিয়েছিলাম আমি। আজ ফিরেছি। হঠাৎ চোখে পড়লো দেওয়াল ঘড়িটাতে। বন্ধ হয়ে আছে। সাথে সাথে ঘড়িটাতে চোখ পড়লো মায়েরও। বললো এই যা ঘড়িটার ব্যাটারি বদলাতে হবে জরীপ যা ব্যাটারী নিয়ে আয় শিঘরী। সব অবিকল রুমে শুধু ঘড়িটাই প্রানহীন পড়ে ছিলো। কেউ খেয়াল করেনি সেটা। হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস পড়লো আমার। অকারণ মন খারাপ হয়ে আসলো। আমি দূর্বল হয়ে যাচ্ছি। এতদিন বাড়ি ঘর মা বাবা ছেড়ে আমি শুভ্রের সাথে ঐ এক চিলতে চিলেকোঠায় বা ভাড়া বাসায় নতুন আনন্দে মেতে ছিলাম। একটা বারের জন্যও মনে পড়েনি আমার এই আজন্ম লালিত বাসস্থানটিকে। অথচ এতগুলো দিন পরে ফিরে এসে কি এক অজ্ঞাত অভিমান বাসা বাঁধছে আমার বুকের মাঝে? কেনো বা কার উপরেই এই অভিমান জানিনা আমি।
মা তাড়া লাগালেন। তাড়াতাড়ি গোসল টোসল সেরে যেন আমরা খেতে বসি। প্রায় দুপুর হতে চলেছে। একেবারেই লাঞ্চ সেরে ফেলা উচিৎ। বাবাও ফিরছেন। আমাদের সাথে খাবেন। এরই মাঝে নতুন ছেলেটা ওর নাম জানা হয়নি এখনও সে রুপোর গ্লাসে করে সরবৎ নিয়ে এলো। রুপোর গ্লাসে চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেলো আমার। এই একজোড়া গ্লাস আর সোনার একটা কারুকার্য্যময় চামচ সেই ছেলেবেলা থেকেই মায়ের আলমারীর তালাবদ্ধ একটি ড্রয়ারে রাখা থাকে দেখে আসছি আমি। এটা নাকি নানুর উপহার। নানুকে মনে পড়ে না আমার। আমার খুব ছোটবেলায় ইন্তেকাল করেছেন তিনি। কিন্তু শুনেছি মাকে এই দুটি জিনিস দিয়ে গেছেন নানু। তার নাতনীকে আর তার অদেখা নাত জামাইটিকে বরন করবার জন্য এই এক জোড়া রুপোর গ্লাস আর তাদের প্রথম সন্তানটির জন্য সোনার চামচটি। মা সে কথা ভোলেননি। জাক-জমক করে বিয়ে দিতে না পারলেও তার জামাই বরণের প্রথম দিনটিতে সেই রুপোর গ্লাসে করেই শরবৎ নিয়ে এসেছেন।
যদিও মা বলছিলেন তাড়াতাড়ি দুপুরের খানা খেতে বসতে তবুও শরবতের পিছে নানা রকম মিষ্টির বাহার দেখে তো আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেলো। একে একে ট্রে করে আসতে লাগলো ছানার জিলাপী, সন্দেশ, রাজভোগ,রসগোল্লা, মালাই চাপ, রসমালাই মনে হয় প্রিমিয়াম স্যুইটসের পুরো দোকানই খালি করে নিয়ে এসেছেন আজ মা। মা বললেন এসব নাকি বাবা এনেছেন। মা সব মিষ্টি রেখে নিজে হাতে বানানো খীরের বাটি থেকে চামচে করে শুভ্রকে খাইয়ে দিলেন। শুভ্র এহেন বাড়াবাড়ি মনে হয় জীবনে দেখেনি। সে খুবই লজ্জিত হয়ে বললো। আমি তো নিজে হাতেই খেতে পারি। শুভ্রের কান্ড দেখে আমার হাসিও লাগলো রাগও লাগলো। সব কিছু চেপেই বললাম আরে বাবা নিজে হাতে তো খেতে পারবেই এত বুড়া ধাড়ী ছেলে। কিন্তু মা দিচ্ছেন এখন মায়ের হাতেই দু চামচ খাও। এটাই নিয়ম। শুভ্র কাচুমাচু মুখে আর একটু হলে মুখ থেকে ফেলতে ফেলতেই কোনো মতে দু'চামচ খেলো।
দুপুরে খাবার টেবিলে দেখা হলো বাবার সা্থে। বাবা তার চিরায়ত গাম্ভীর্য্য বজিয়ে খাবার টেবিলে বসে ছিলেন। আজীবন বাবার খাবার স্টাইল এক দেখার মত ব্যাপার বটে। কাচকি মাছ দিয়ে ভাত খেলেও বাবাকে সাজিয়ে দেওয়া লাগে ছুরি, কাটা, ন্যাপকিন সকল আনুসাঙ্গিক কেতা। তাই বাবার চেয়ারের সামনে সব সময় ওভাবেই সাজিয়ে দেওয়া হয় সকল তৈজসপত্র। আজও তার ব্যতিক্রম ছিলো না শুধু ব্যাতিক্রম ছিলো সেই ছুরি কাটা ন্যাপকিন সবগুলো চেয়ারের সামনেই সাজানো ছিলো। শুভ্র কোনো রকম বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতা একেবারেই পছন্দ করে না। সে যে এসব দেখে কি ভাবছে এটা ভেবেই কুন্ঠিত হয়ে পড়লাম আমি। লজ্জাও লাগছিলো আমার এটা ভেবে যে শুভ্র ভাববে এই বাড়াবাড়ি রকম অপ্রয়োজনীয় আদিখ্যেতা বাড়ির মেয়ে আমি।
আমি জানি শুভ্র খুব খুব খাঁটি মানুষদের একজন। মানুষদের বলবো কি আমার তো মনে হয় সারা দুনিয়াতে শুভ্র শুধুই একজন। যে সবার থেকে আলাদা এবং আমার চোখে খুব খাঁটি আর আমার দেখা অন্যতম মানুষদের একজন। আমি আজীবন যে পরিবেশে বড় হয়েছি শুভ্রের সাথে পরিচয়ের পরে সেই পরিবেশ সেই শিক্ষা আমার অনেকটাই মিথ্যে মনে হয়েছিলো। শুভ্র বলে মানুষর মাঝে ভন্ডামী জিনিসটার কোনো মূল্যই নেই আসলে। এই যে যে যা না তাই প্রকাশ করা। এই যে যে যা পারে না তা পারি বলে বড়াই করা। খারাপ কাজ করে সেটা বলার সৎ সাহস যার নেই তার জীবনই বৃথা। শুভ্র এমনই একজন। সে মানুষ খুন করে এসেও বলতে পারে হ্যাঁ দরকার পড়েছে তাই করেছি। তার যা সঠিক মনে হয় সে সেটাই করে। বেঠিক মনে হলেও তার করতে ইচ্ছা হলে সেটাই করে সে। শুভ্রের মতে জীবন তো একটাই। আর সমাজের বেঁধে দেওয়া সব রুলই মানতে হবে ঠিক না মনে হলেও সে সেটাও মানতে রাজী না।
আর তাই সে তার থেকে বয়সে বড় বা নিজে বেকার হয়েও চাকুরীজিবী মেয়েকে বিয়ে করতে কোনোই ইগো ফেস করেনি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আসলে শুভ্র নিয়ম ভাঙ্গাদের দলে। সব নিয়মকেই নিজের মত করে ভাবে। পছন্দ না হলে মানে না বা সেটা সে মানে না বলতেও দ্বিধা করে না। মাঝে মাঝেই শুভ্রের সাথে আমার তর্ক হত। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা বিষয় নিয়ে। যদিও সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো কিছুতেই আমার কখনও মাথা ব্যাথা ছিলো না বা সমাজ ও রাষ্ট্রের উত্থান পতনে আমার কিছুই যায় আসতো না। পেঁয়াজের দাম বাড়ুক আর চালের দাম বাড়ুক তা নিয়ে ভাবার কোনো দরকারই কখনও বোধই করিনি আমি। কিন্তু শুভ্রের সারা দিন দুনিয়ার মানুষকে নিয়েই যত মাথা ব্যাথা। শুভ্রের এসব আলোচনা ও বন্ধুদের সাথে তর্ক বিতর্ক দেখে মাঝে মাঝে আমার মনে হত শুভ্রের মত মানুষ আরও কয়েকজন একই রকম চিন্তা ভাবনার মানুষ পেলে ক'জনে মিলেই পুরো বিশ্ব বদলে দেবে। পালটে দেবে বহুযুগের প্রচলিত হয়ে আসা বহু বহু নিয়ম কানুন।
যাইহোক বাবা শুভ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি কি করছো? শুভ্র খুবই সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে জবাব দিলো, আপাতত কিছুই করছিনা। বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, মানে? তার কাঁটাচামচ আর ছুরি ধরা হাত থমকে গেলো। চোখ স্থির হয়ে গেলো শুভ্রের মুখের উপর। শুভ্র হাসি হাসি মুখে জবাব দিলো, হ্যাঁ কিছুই করছি না আমি। আই বিএ শেষ হলে কিছু করার কথা ভাবতে পারি। বাবা বললেন, ভাবতে পারো? এখনও ভাবছো না? তার কথায় একটু যেন ব্যঙ্গের ছোঁয়া ছিলো। শুভ্র নির্লিপ্ত আর হাসি হাসি মুখে জবাব দিলো হ্যাঁ আপাতত ভাবছি না। বাবা ভেতরে ভেতরে ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন বুঝাই যাচ্ছিলো তবে কষ্ট করে রাগটা গিলে ফেললেন তিনি। আমার দিকে এমন করে তাকালেন আমি বুঝতেই পারলাম উনি মনে মনে ভাবছেন কি করে এত বুদ্ধিমতী হয়ে আর আমার মেয়ে হয়ে তুই এই অপদার্থের গলায় মালা দিলি!
চিলেকোঠার প্রেম- ১১
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:২৩