শুভ্রকে যে এত সহজেেই বাবার বাড়িতে থাকতে রাজী করাতে পারবো সে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম শুভ্র যে পারসোনালিটির ছেলে তাতে একটা দিনও শ্বশুরবাড়িতে থাকতে রাজী হবে না। আর তাছাড়া সবে তো এক মাসও পেরুইনি আমার। এখনও দীর্ঘ কয়েকমাসের অপেক্ষা। বেবি হবার আগ পর্যন্ত মা চান আমি উনার কাছেই থাকি। এমনকি আমার শ্বাশুড়িও একা আমাকে থাকতে দিতে চান না। প্রয়োজনে জব ছেড়ে দিতে হলেও কোনো আপত্তি নেই উনাদের।
যাইহোক আমার খুব ভয় হচ্ছিলো আমি যদি এতগুলো দিন মায়ের কাছে থাকি তবে শুভ্র কি করবে? একা একা থাকবে? সেটা কেমন হবে? আমি কি করে থাকবো ওকে ছাড়া? বিয়ের পরে মেয়েরাই শ্বশুরবাড়িতে যায় কিন্তু ছেলেরা তো শ্বশুরবাড়ি থাকলে আবার ঘরজামাই অপবাদ জুটে যায়। কি করবো আমি কিছুই সাত পাঁচ ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবুও ভয়ে ভয়ে বললাম, শুভ্র তুমিও চলো আমার সাথে। তোমাকে রেখে আমার একা একা ওখানে থাকতে খুব কষ্ট হবে। একটুও শান্তি পাবোনা আমি।
ভেবেছিলাম শুভ্র না বলবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বললো। আমিও তোমার সাথে থাকবো। তোমাকে ছেড়ে তো আমিও থাকতে পারবোই না। আর তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির আদর যতন তো আর ভাগ্যে জোটেনি এই সুযোগে জুটে গেলো। আবারও শুভ্র হে হে করে হাসতে লাগলো এই রসিকতায়। আমার ভেতরে সব কিছু ওলট পালট হয়ে উঠলো। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো শুভ্রকে যেভাবে চিনি, একজন বুদ্ধিমান ও শান্ত ভদ্র এবং অসম্ভব আত্ম সন্মান জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ হিসাবে তার সাথে এই ব্যাপারগুলো ঠিক যাচ্ছে না যেন।
যদিও শুভ্রের মধ্যে কোনো ভন্ডামী নেই। সে যা করে তাই বলে, যা ভাবে তাও বলতে এতটুকু দ্বিধা করে না সে। আমার ভেতরে যেমন রাখ ঢাক করে সব কিছুই খুলে বলার প্রবনতা কম। শুধু যেটুকু ভালো এবং সবার কাছে গ্রহনযোগ্য সেটুকুই বলি বা যা বললে অন্যের কাছে ছোট হবো বা ভুল করে হলেও মানুষ ভুল বুঝতে পারে সেসব এড়িয়ে যাই। শুভ্র ঠিক উলটো রকম। সে খুন করে আসলেও সেটা সদর্পেই বলবে হ্যাঁ খুন করেছি। কখনও লুকাবে না।
আমি জানিনা শুভ্র রাইট অর রং। কিন্তু শুভ্র যা বলে, যা ভাবে বা যা সঠিক মনে করে আমি সেসব কিছুই সঠিক মনে করি আজকাল। আমি জানি শুভ্রের এই ভাবনা চিন্তা এবং তার সকল কার্য্যকলাপ দ্বারা আমি প্রভাবিত হতে শুরু করেছি। আমার মনে হয় আমি তো শুভ্রের মত করে ভাবি না। আসলে আমি কেনো আমাদের সমাজে মনে হয় ৯৯% মানুষই শুভ্রের মতাদর্শের মানুষ না। শুভ্র সবার থেকে আলাদা। ১ পার্সেন্ট মানুষের মাঝে শুধু সেই একজন। যে যা ভাবে যা বলে বা যা করে সকল কিছুই আমার মনে হয় আসলে ওমনই হওয়া উচিৎ।
আমরা সকলেই যেন কোনো ভুল মোহের পিছে ছুটছি। যদিও একটা সময় শুভ্রের অনিয়ম ও অনিয়ন্ত্রিন জীবন যাপন এবং উদ্যমহীনতা আমি পছন্দ করিনি। তবে সেটা আমার নিজের মোহাবিষ্ঠ থাকা অবস্থাতে বুঝিনি আমি। আমার মনে হত শুভ্রই সঠিক। মানুষ কেনো এত কিছুর পিছে ছোটে? কেনো এই এতটুকুন জীবনে এত মিথ্যা, এত লুকোচুরি এই বাঁধা বিপত্তি এত অহম এবং মেকি মুখোশ?
যাইহোক, বাবা গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। এই ভাড়া বাসা তালাবদ্ধ করে আমরা চললাম বাবার বাসার উদ্দেশ্যে। সালাম চাচা আমাদের পুরান ড্রাইভার। অনেকগুলো দিন পর দেখলাম উনাকে। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে জিগাসা করলেন, খুকী ভালো আছো তো? আর তারপরপরই শুভ্রের দিকে একটু বিরক্ত চোখে চাইলেন। শুভ্র রসিকতা করলো, খুকীকে দেখলেন সাথে এই খোকাটাকে দেখলেন না? সালাম চাচা কোনো কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে ধরলেন। আমরা উঠে বসলাম।
বাইরে ঝা চকচকে সকাল। প্রচন্ড গরমে আর গাড়ীর সুশীতল এয়ার কন্ডিশনে জানালার কাঁচে বিন্দু বিন্দু জলের ফোটা। শুভ্রের ডান হাতের সব কটা আঙ্গুলের ফাঁকে আমার বাম হাতের আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে বসে রইলাম আমি। এভাবে প্রায়ই বসে থাকতাম আমরা দুজন। সেসব দিনে আজকের দিনের মত ছেলেমেয়েরা হাতে হাত বা কাঁধে হাত রেখে পথ চলতো না। এমনকি স্বামী স্ত্রীরাও জনসন্মুখে মোটামুটি ভদ্রস্থ দূরত্ব বজায় রেখেই চলতো। কিন্তু এইভাবে হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে বসে থাকতাম আমরা প্রায়ই। যেমন চিলকোঠার ঐ এক চিলতে ছাঁদে পূর্নিমা বা অমাবশ্যার রাতে। মিরপুরের ফ্লাটের বারান্দায় পাশাপাশি মোড়ায়, কিংবা রিক্সায় বা এমনকি পাশাপাশি শুয়ে ঘুমের মাঝেও।
ট্রাফিক লাইটে গাড়ি থামলে একটা ছোট্ট মেয়ে গাড়ির জানালায় এসে দাঁড়ালো। এক হাতে কয়েকটা হাওয়াই মিঠা আর আরেক হাতে ছোট্ট বোনকে কোলে নিয়ে এসেছে। বোনটা ঘুমে কাঁদা। এই গরমে এই প্রচন্ড দাবদাহে উস্কোখুস্কো চুলের মায়াময় মুখের মেয়েটি আর তার কোলে ঐ ঘুমে কাঁদা হয়ে থাকা বাচ্চাটা দেখে শিউরে উঠলাম আমি। আহারে বাচ্চাটা। এই ধুলো আর ধোোয়ার শহরে কি এইভাবে বেঁচে থাকার কথা ছিলো ওর?
আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো। আমি ব্যাগ খুলে ওকে ১০০ টাকা দিলাম আর বললাম আজ আর বের হবে না। বোনকে বাড়িতে নিয়ে শুইয়ে দাও। মেয়েটা হাসলো। মিষ্টি এক স্বর্গের দেবশিশুর হাসি। টাকাটা নিয়েই সবগুলো হাওয়াই মিঠা বাড়ি্যে ধরলো আমার দিকে। আমি বললাম এতগুলো হাওয়াই মিঠা কি করবো আমি সোনা? তুমি নিয়ে যাও। দুজনে মিলেই খেও। গাড়ি চলতে শুরু করলো সে আমার কথা না শুনেই সব গুলো হাওয়াই মিঠা জানালা গলিয়ে সিটের উপর ফেলে দিলো।
শুভ্র বললো, হলোতো এখন খাও হাওয়াই মিঠা। তোমার বাচ্চা বান্ধবীর উপহার। বলে একটা হাওয়াই মিঠা পলিথিন ছিড়ে খাওয়া শুরু করলো। আরেকটা সালাম চাচার দিকে বাড়িয়ে দিলো। সালাম চাচা কিছু না বলে হাওয়াই মিঠাইটা উনার পাশের সিটে রেখে দিলেন। আমার এসব কিছুই ভালো লাগছিলো না। আমার চোখে তখন শুধু ঐ ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে থাকা শিশুটির মুখ। আহারে বাচ্চাটা। একটু আদরে যত্নে বা শান্তিতে ঘুমানোর অধিকারটুকুও কি নেই তার?
জানিনা মাতৃত্ব কাকে বলে। পিতৃত্বই বা কি।শুধু জানি হঠাৎ আমার ভেতরে একটা পরিবর্তন এসেছে। যে কোনো বাচ্চার জন্যই মনটা কেঁদে ওঠে। এ পৃথিবীর সকল শিশু যেন আমার সন্তান। সবার জন্য কষ্ট হয় আমার সবাইকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীতে শিশুর চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। আমার হৃদয় জুড়ে থাকা শুভ্রের বিশাল অস্থিত্বের একপাশে বেশ বড় সড় একটা জায়গা করে নিয়েছে আমার অনাগত অদেখা শিশুটি।
আচ্ছা আর পিতৃত্ব কি? শুভ্রের মধ্যে তো পিতৃত্বের কোনো লক্ষনই দেখছি না। সেই প্রথমদিন রিপোর্ট পাবার পরে কিছুক্ষন থমকে ছিলো। তারপর পরই স্বভাবসুলভ নিরুপদ্রক, নির্বিকার ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে হয়ে গেছেন। ওর মাঝে পিতৃত্বের কোনো লক্ষন দেখছি না বটে তবে প্রেমিকত্বের প্রমান পেয়েছিলাম। হা হা প্রেমিকত্বের প্রমান সে এক মজার গল্পও বটে।
শুভ্র ভীষন স্মোক করত। সে যখন ওর সাথে প্রথম প্রথম পরিচয় হলো তখন থেকেই দেখে আসছি। শ্বাসকষ্ট আছে, সাইনাস আছে এর মাঝেও কেউ এই রকম চেইন স্মোকার হয় ভাবাই যায় না । মনে আছে উড়নচন্ডি আর অপরিনামদর্শী শুভ্র বিয়ের আগে যখন একা থাকতো প্রায়ই বাড়ি থেকে পাঠানো সব টাকা পয়সা খরচ করে ফেলতো। তখন অল্প কিছু টাকা থাকলে না খেয়ে হলেও সিগারেট কিনতো। এটা দেখে আর জেনে খুব অবাক হয়েছিলাম আমি। শুভ্র বলেছিলো সে সব ছাড়তে পারবে। তবুও স্মোকিং না। সেই শুভ্র স্মোকিং ছেড়েছিলো।
কি শর্তে?
হা হা কি করে যে বলি মানে লিখি?
সত্যিই লজ্জা হচ্ছে।
আচ্ছা চোখ কান বুঁজে লিখেই ফেলি .......
শুভ্রের সাথে বিয়ের আগে আমার সরাসরি বার কয়েক দেখা হয়েছে মাত্র। কিন্তু আমাদের রোজ দেখা হত অনলাইনেই। তো সেকেন্ড যেদিন মুখোমুখি দেখা হয়। সেদিন ওর একটা শর্ত ছিলো-
আমাকে যেদিন সে চুমু খাবে সেদিন সে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেবে.......
আর দিয়েছিলোও ........
চিলেকোঠা- ১০
ছবি কিন্তু নেট থেকে আর কেউ বকা দিলে সাথে সাথেই মুছে দেবো। লেখাটার সাথে মিলিয়ে এত সুন্দর একটা ছবি পেলাম কিন্তু কিছুদিন আগে গায়ে সবুজ রং আর নীল জামা পরা মেয়েটার পথ নাটক বা প্রতিবাদী বিতর্কিত ছবিটার সাথে মিল লাগছে। তাই একটু ভয়ে আছি। আবার নতুন কোনো লরুর দেখা পাই নাকি বা লরুর আত্মাই পিছু ছেড়েছে কিনা জানিনা সঠিক।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:৫৮