শুভ্র আমার হাতে রিপোর্টটা ধরিয়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আমি তখন কেবল ডালে বাগাড় দিয়েছি। পাঁচফোড়নের মৌ মৌ গন্ধে চারিধার মৌমিতাল। পাঁচফোড়নের মেথী কালিজিরা আরো নানা রকম মসলার ঝাঁঝালো অসাধারণ সেই গন্ধটার সাথে মৌমিতাল শব্দটা মানায় কিনা জানিনা তবে সেদিনের সেই গন্ধের সাথে মৌমিতাল ছাড়া কোনো শব্দই যেন ঠিক যায় না। কারণটা পরে বলছি। যাইহোক শুভ্রকে ওভাবে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিপোর্টটা না খুলেই হাতে ধরেই আমি জিগাসা করলাম। কি আছে রিপোর্টে? কথা বলছো না কেনো?
শুভ্র অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, কি আবার? পজিটিভ...
আমার সারাজীবনে নাটক সিনেমায় দেখা আমি বাবা হবো? বাবা হতে চলেছি! এমনতর বলা উচ্ছসিত বা আনন্দিত বা বিস্মিত আনন্দে উদ্বেলিত কোনো নায়কের সাথেই সেই মুখের কোনো মিল নেই। একটু নির্বিকার আর একটু লজ্জা বা অপরাধী একটা ভাব বা কোনো ভাবেরই সাথেই সেই মুখের অনুভূতিটা খুঁজে পাই না আমি। কিন্তু তখন শুভ্রের মুখানুভূতি বা মনের অনুভুতি কিছুই দেখার সময় নেই আমার। আমি আপনার মাঝে আপনি হারা। আমার মনের মাঝে ততক্ষনে একশো ময়ুর নেচে চলেছে বর্ণীল পাখা মেলে। নাচ ময়ুরী নাচেরে, রুম ঝুমা ঝুম বাঁজে রে .....
আমি রিপোর্টটা খুলে বুঝবার চেষ্টা করলাম। শুভ্র বেডরুমে চলে গেলো। চারিদিকে ডাল বাগাড়ের মেথী কালিজিরা মৌরি নানারকম মসলাদার গন্ধ আর তার মাঝে আমার সাজানো গোছানো পরিপাটি কিচেনের ঠিক মধ্যিখানে রৌদ্রজ্জ্বল এক দুপুরের দিকের সময়ে সাদা হলুদ ফুলফুল কিচেন এপ্রোন পরে দাঁড়িয়ে থাকা আমি। আমার মুখে হাসি ধরে রাখতে পারছিলাম না। জানালায় একটা বোতলে মানিপ্লান্টের শিশু চারা। মনে হলো ওটাই আমার গর্ভের সেই অদেখা অজানা কিন্তু চিরচেনা শিশুটি।
আমি কোনোমতে রান্না শেষ করে বেডরুমে এলাম। শুভ্রকে খুব চিন্তিত আর বিষন্ন লাগছিলো। ও চুপচাপ চোখ বুঁজে শুয়েছিলো। আমি ওর কাছে গিয়ে বসলাম। বললাম, তোমার কি খুব চিন্তা হচ্ছে? শুভ্র বললো, না চিন্তা না ঠিক কিন্তু ভাবছি এত তাড়াতাড়ি একটা বাচ্চার দায়িত্ব নেবার সময় কি আমাদের এসেছে? আমি ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠলাম। ক্রোধ চেপে বললাম, মানে কি? কি বলতে চাচ্ছো তুমি?
জানিনা আমার গলায় কি ছিলো। শুভ্র উঠে বসলো? বললো তুমি কি রেগে যাচ্ছো? দেখো ভালো করে চিন্তা করে দেখো। আমার পড়ালেখাই এখনও শেষ হয়নি। কোনো আয় নেই, উপার্জন নেই, কিছুই নেই। এই অবস্থায় একটা বাচ্চার খরচ এবং দায়িত্ব কি আমরা বইতে পারবো? আমি মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, শুভ্র আমি বেশ ভালো একটা জব করি। বিয়ের দায়িত্বও আমি নিজের উপরে নিয়েই করেছি কাজেই বাচ্চার দায়িত্বও আমার। তোমাকে ভাবতে হবে না। ভীষন রাগে কথাগুলো বললেও এরপরই আমি কেঁদে ফেললাম।
আজ বড় হাসি পায়। যত বাহাদূরী আর লম্ফ ঝম্ফই করি না কেনো আসলে বাংলাদেশের নারীদের ছিঁচকাদুনে স্বভাবটাই শ্বাসত। তার থেকে বুঝি বের হওয়া হয় না আমাদের। শুভ্র খুব ভয় পেয়ে গেলো। সেদিন বুঝলাম নির্বিকার শুভ্রের মাঝে কিছুটা দায়িত্বভীতি আছে তো বটেই আর সে কান্নাকে ভীষন ভয়ও পায়। আমি অবশ্য আমার কান্নাটাকে কখনও অস্ত্র বানাতে চাইনি। বরং শুভ্রসহ সকল দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শুভ্রের এই আগে থেকেই পিছিয়ে পড়া মনোভাবটাকে আমার ঠিক পছন্দ হলো না।
যাইহোক বিকেলে ডক্টর চেম্বার থেকে ফেরার পথে আমরা বইমেলায় গেলাম। বিশেষ কিছু বই কেনা হলো না আমার। উল্লেখযোগ্য বই এর মাঝে হাসান আজিজুল হক আর হুমায়ুন আহমেদের গল্প সমগ্র আর মনে হয় মহাদেব সাহার কবিতা কিনেছিলাম। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে চাইনিজে গেলাম আমরা।মিরপুর ১০ নং এ সেই চাইনিজটা এখনও আছে কিনা জানিনা। তবে তখন মনে হয় ঐ একটাই ছিলো। নাম ছিলো এক বিখ্যাত সিনেমার নামে ব্লু লেগুন। এই নামের কারণ কি জানা নেই আমার।
সেই আলো আঁধারির মায়াময় পরিবেশ আর টুং টাং চামচ প্লেটের শব্দ আমি আজও কান পাতলেই যেন শুনতে পাই। কি একটা ইংলিশ গান বাঁজছিলো ঐ রেস্টুরেন্টে। খুব নরম সূর ছিলো কিন্তু গানের লাইনগুলি মনে নেই আমার। চিকেন কেশ্যুনাট সালাড, ফিসকেক আর স্যাটে খেলাম চেটে পুটে। জানিনা কেনো এত মজা লাগছিলো খেতে সবকিছু। একেবারে যেন আলাদা স্বাদ। বিধাতা কি তবে আমার জিভের স্বাদ বদলে দিয়েছিলো কিনা সে কটা দিন জানা নেই আমার। কিন্তু খানা পিনা যে এত মজাদার এত সুস্বাদু হয় কখনও জানা হত না আমার যদি না কখনও আমি ঐ পিরিয়ডটার মধ্যে দিয়ে না যেতাম। শুভ্র স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলো কিন্তু পারছিলো না। সে ভেতরে ভেতরে দারুন উদ্বিগ্নতাই ভূগছিলো। সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো।
খানা শেষে হঠাৎ শুভ্র সাদা ধপধপে টেবিল ক্লথে সাজিয়ে রাখা টেবিলটার চিকন রুপোলী ফুলদানীটা থেকে আধফোঁটা মনোরোম একটা টকটকে লাল গোলাপের কুঁড়ি তুলে আমাকে দিয়ে বললো, নাও এই আনন্দের দিনে তোমাকে লাল গোলাপের ভালোবাসা দিলাম। আমার তো আর দেবার মত কিছু নেই তাই এই লাল গোলাপের শুভেচ্ছা। বলে সে হে হে করে হাসছিলো। যেন খুব একটা রসিকতা করতে পেরেছে। আমার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। আমি জানি শুভ্রের কোনো উপহার দেবার ক্ষমতা নেই। এখন ওর কোনো দরকারী খরচ করবার জন্যও কোনো সামর্থও নেই তাই বলে এই সস্তা রসিকতাটুকু না করলেও হয়ত পারতো সে। নিজের বাগান কিংবা নিজের পয়সায় কেনা একটা মাত্র ফুলের কুঁড়ি বা নিজে হাতে কুড়িয়ে আনা কোনো ফুলের সাথেও এই রেস্টুরেন্টে সাজিয়ে রাখা বা ফ্রিতে পাওয়া বা আলগোছে পাওয়া ফুলকে আমি কিছুতেই মিলাতে পারলাম না।
আমি জানিনা আমি নিজেই ছোটলোকের মত ভাবছিলাম কিনা হয়ত এটা আমারই নীচু মনের পরিচয়। কিন্তু ভালোবাসা ফুল অবহেলায় পাওয়া হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া উপহার এসবের সাথে আমার ভেতরে পাওয়া এক পরম অর্ঘ্যের অস্তিত্বের অপেক্ষা আমাকে টাল মাটাল করে দিলো। আমি হঠাৎ হড় হড় করে সেখানেই সব বমি করে ফেললাম। শুভ্র, রেস্টুরেন্টের লোকজন, কাস্টমার সকলকেই এক বিতিকিচ্ছিরি পরিস্তিতিতে ফেলে দিলাম আমি। আমি ভীষন লজ্জা পেলেও সকলেই সেদিন আমাকে সহানুভূতির চোখেই দেখেছিলো। কিন্তু শুধু শুভ্র বা এই পৃথিবীর একটা মানুষও জানলো না কি তার কারণ ছিলো।
রাতে মা ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন রিপোর্টের খবর। ফোনটা শুভ্রই রিসিভ করেছিলো। মা বললেন কালই উনি গাড়ি পাঠাবেন আমার জন্য। আর কোনো অজুহাত শুনবেন না তিনি। আমার এখন যত্নের প্রয়োজন। আমাকে উনি এ কটাদিন নিজের কাছে রাখতে চান। শুভ্ররও তাতে বেশ সায় ছিলো। সেও বললো হ্যাঁ এমনটাই হওয়া উচিৎ। তখন আমার মাথা ঠিক ঠাক কাজ করছিলো না কিন্তু আজ আমি ভাবি শুভ্রের এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার ব্যাপারটি কি স্বভাবগত? নাকি তার অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থার অনিশ্চয়তা ছিলো? যাইহোক শুভ্রকে একা রেখে যেতে মন চাইছিলো না আমার। তাই ওকেও রাজী করালাম আমার সাথে যেতে। কিন্তু সাথে একটু ইগোও কাজ করছিলো। কই মা কিংবা বাবা একটাবারও তো বললো না শুভ্রকেও নিয়ে আসতে।
পরদিন সকালে শৈলীকে ফোন দিলাম আমি। শৈলীকে জানালাম তাদের বাড়িতে নতুন অতিথির আগমনের কথা। শৈলী শুনে ভীষন খুশি হয়ে উঠলো। চিৎকার করে আমার শ্বাশুড়িকে ডাকছিলো সে। আমি ভেবেছিলাম এই কথা শুনে উনার আবারও বুঝি বিলাপ শুরু হবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ধীর স্থির ও শান্ত গলায় বললেন তিনি। তুমি ঠিক আছো তো মা? এই অপ্রত্যাশিত কিন্তু পরম মমতাময় সম্বোধনে আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আমার গলা বন্ধ হয়ে আসলো। চোখ ফেটে জল। আমি কোনো মতে সামলে নিয়ে বললাম। আমি ভালো আছি।
উনি জানালেন পরদিনই রওয়ানা দেবেন তিনি। আমাকে নিয়ে যাবেন উনাদের কাছে। পুরোটা সময় যেন আমি সঠিক যত্নে কাটাতে পারি তাই উনাদের এই ইচ্ছা। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম আমাকে তো ছুটি নিতে হবে আর এত তাড়াতাড়ি ছুটিও পাবো না আমি। কাজেই এখন কটা দিন বরং মায়ের কাছে থাকি। আমি ফোনের ভেতরেও উনার দীর্ঘশ্বাস শুনলাম। তবে উনি খুব বাস্তববাদী এবং বুদ্ধিমতী সেই তখনই বুঝতে পারলাম আমি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এই কারনেই মেয়েদের চাকুরীর ঠিক পক্ষপাতি নই আমি। যাইহোক একটা কথা বলি। মা হওয়া অনেক কষ্টের। এত কষ্ট সামলে মা হতে হয়। এই সময়টুকুতে যত্নের প্রয়োজন। পারলে আমার কাছে বা নিজের মায়ের কাছে থাকো। সেটাই মঙ্গল।
গভীররাতে তখন প্রায় ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। আমার শ্বশুর মশায় ফোন দিলেন। উনি পরদিন ভোরেই রওয়ানা দেবেন। সাথে নিয়ে যেতে না পারুক তাদের পুত্রবঁধুকে আশীর্বাদ করে যেতে চান। উনার উচ্ছাস আমার বুকের গভীরে সারাজীবন গাঁথা রইলো। উনার কথা শুনে মনে হচ্ছিলো একটি ফুটফুটে সত্যিকারের শিশুর মুখ উনি ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছেন। শিশুটি যেন তার মুখ চেয়ে হাসছে আর সেই অপার্থীব আনন্দ তিনি কোনো ভাষাতেই প্রকাশ করতে পারছেন না। আমি দুচোখ বুঁজে একটি বয়স্ক শিশুর মুখচ্ছবির ভাঁজে খুজতে শুরু করলাম একটি অনাগত অদেখা নিস্পাপ কোমল ক্ষুদ্র শিশুর মুখ।
চিলেকোঠার প্রেম- ৯
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৫৬