আমাকে দেখে আরও শোরগোল করে উঠলেন উনি। বললেন, দেখোতো বৌমা, বলা নেই কওয়া নেই এমন করে কেউ বউ এনে তোলে? আমাদের একটা সন্মান আছে না? তোমাকে কি খাওয়াবো? কোথায় বসাবো? কোনো কিছুর ঠিক নেই। কাল রাতেই কেষ্ট ময়রার দোকানে গরম গরম রসগোল্লা অর্ডার করে দিয়েছি। আর বিকালে সে দিয়ে যাবে কচুরী। হিং এর কচুরী। কই একখানা পেয়ালা দাও দেখি। খাও মা খাও গরম গরম রসগোল্লা। অমৃত বুঝলে অমৃত। ছোটকাল থেকেই খাচ্ছি। এখনও আঁশ মেটে না। এই রসগোল্লা যে না খেয়েছে তার জীবনই বৃথা। একখানা শালপাতা জড়ানো গরম রসগোল্লা উনি শালপাতা শুদ্ধু তুলে দিলেন আমার হাতে। আর একটু হলেই রস গড়িয়েপড়ছিলো। আমি হাতে নিয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। এইভাবে খাবো কি করে! ভাবছিলাম বোকা হয়ে তার আগেই উনি তাড়া লাগালেন। খাও খাও । শালপাতা। খারাপ কিছু না। আরে খাও তো। আমি তোমার তেমন শ্বশুর না। আমাকে বন্ধুও ভাবতে পারো।
কিছু দূরেই মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার শ্বাশুড়ি মা। তাকে উদ্দেশ্য করে উনি বলে উঠলেন, দাঁড়িয়ে থেকো না। তোড় জোড় শুরু করো। রান্নার লোক আসবে, মাছ আসবে, খাসী জবাই হবে। আত্মীয় স্বজন কম করে হলেও নেমন্তন্ন করে ফেলেছজন পঞ্চাশেক। শ্বাশুড়ি মা রাগ চেপে রাখতে পারলেন না। বিষম ক্রোধে চিবিয়ে বললেন, রোজগার নেই, পাতি নেই, বাবা মাকে বলা পর্যন্ত নেই অথচ সেই বিয়ে নিয়ে আত্মীয় স্বজন নিমন্ত্রন করে বসলে? লোকে জিগাসা করলে বলবে কি? লাজ লজ্জা মান সন্মানের কি মাথা খেয়েছো!
শ্বশুরমশাই বললেন, লোকের ধার ধারি আমি? কারো খাই না পরি? আহা রোজগার পাতি নেই তো কি হয়েছে? হবে? আর হুট করে করে যখন ফেলেছে সেটা তো অস্মীকার করার যেমন উপায় নেই তেমনই সেটা নিয়ে মন ভার করে থেকে জীবনের সুন্দর মূহুর্তটুকুও নষ্ট করে লাভ নেই। আনন্দ করো শুভ্রের মা, আনন্দ করো। আর তাছাড়া তুমি এমন করে থাকলে ওদের সুন্দর সময়গুলোও যে নষ্ট হয়। বুঝোনা কেনো? শুভ্রের মা আমার শ্বাশুড়ি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমার শ্বশুর আবার বিরাট উৎসাহে মাছওয়ালার সাথে দামাদামি শুরু করলেন।
আমি ফিরে যেতে চাইলাম ঘরে। অমনি উনি আমাকে ডেকে পাশে বসালেন। বললেন, জানি তোমার মন খারাপ হয়েছে। কেনো হয়েছে সেটাও জানি। কিন্তু তোমাকে একটা উপদেশ দেবো। এই জীবনে কখনও কারো কথা শুনে মন খারাপ করবে না, বসে থাকবে না। নিজের কাজে এগিয়ে যাবে, নিজের আনন্দ নিজে লাভ করবে। জীবনের মূল ব্যপারই এটা। নিজের কাজে এগিয়ে যাওয়া। সব সময় যে লক্ষ্য অর্জন করতে চাও তাতে অটুট থাকবে। আমি খুব পছন্দ করেছি তোমাকে। আমার ধারণা তুমি খুবই স্বাবলম্বী মেয়ে। যদি কোনো ঝামেলায় পড়ো তো ঐ কুম্ভকর্নকে নিয়েই পড়বে। ছোট থেকেই শুভ্র খুব বি্র্লিয়ান্ট বটে কিন্তু ও নিজের মেরিট নষ্ট করে ফেলে। ও জীবন নিয়ে উদাস। তোমাকে এটা বুঝতে হবে। ওকে কাজে লাগাতে হবে । আমার ধারনা তুমি সেটা পারবে।
আমি অবাক চোখে দেখছিলাম উঠানের কোনায় শিউলী গাছটার তলাটা শুভ্র সুন্দর ফুলে ভরে আছে। শিউলী ফুলের কোমল শুভ্র পেলবতা মনে গেঁথে রইলো আমার এই আসন্ন শরতের প্রভাতে। একটা হলুদ বরণ অপূর্ব সুন্দর পাখি ওদের নিম গাছটার ডালে বসে ডাকছিলো। বউ কথা কও, বউ কথা কও। আমার শ্বশুর সেদিকে চেয়ে বললেন, দেখেছো পাখিটা তোমার সাথে কথা বলতে চায়। বলে উনি হো হো করে হাসতে লাগলেন। আমার লজ্জাই লাগছিলো। আমি নির্বাক ছিলাম। আমি উনাকে যতই দেখছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম। পৃথিবীতে ভালো মানুষ বলে যদি কিছু সত্যি থাকে তো উনি তার এক নম্বর উদাহরণ হবে।
হঠাৎ শৈলীর ঘর থেকে ভেসে এলো সুমিষ্ট স্বরের রেওয়াজ বন্দিজ -
উঠো তুম জাগো রায়নু সাবেরা
বোলাতা পানসি সুন আযান পুকারা ......
সেই দিকে তাকিয়ে আমার শ্বশুর বললেন, শেৈলী। শৈলীটা যখন রেওয়াজ করে আমার দুনিয়া তখন চারিদিকে আলো হয়ে যায়। উনি হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। আমিও চুপচাপ এসে শৈলীর ঘরের সামনে দাঁড়ালাম। জানালা দিয়ে এক টুকরো সূর্য্যের নরম আলো ভেতরে এসে পড়েছে শৈলীর ফুলফুল বিছানায়। শৈলী গাইছে
আল্লাহু আকবার তাকবীর সুনো তাম
আসালা আতু খায়রুম মিনানাম .......
যদিও তখন সূর্য্য উঠে গেছে। মুসুল্লীদের এবাদতের সময়ও পেরিয়েছে। তবুও শৈলীর গানটা সে সকালটাকে অপার্থীব করে তুললো। আমার নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়লো। মা ডেকে দিতেন। ভোরবেলা গলা সাধতেই হবে। আমার ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গতেই চাইতো না। মা বলতেন ভোরবেলা গলা না সাধলে তার গান হয় না। মা কি ভীষন নিয়ম মানা একজন মানুষ ছিলেন। কোনো নিয়মের বাইরে কখনও এক বিন্দু পা বাড়াতেন না। বাবা একেবারেই উল্টো যেন। আর আমি মায়ের মত তো হইনিই বাবার মতনও হয়েছে কিনা জানিনা। হঠাৎ মায়ের জন্য মন কেমনে করে উঠলো আমার। কেমন আছে আমার দুখিনী মা? একরাশ সুখ সাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থেকেও কাউকে কাউকে বড় দুখী লাগে। আমার মাও যে তেমনই একজন। সারাজীবন ভালো মেয়ে, ভালো বউ, ভালো মায়ের দায়িত্ব পালন করে গেলেন নিজের সকল কিছু বিসর্জন দিয়ে।
মনে পড়ে মাই শিখিয়েছিলেন আমাকে ভোরের রাগ ভৈরবী, বিলাবল বিভাস, টোড়ি কাফি ইমনকল্যান দিনের বিভিন্ন ভাগের বিভিন্ন রাগ। নানা রকম রাগ সঙ্গীত গাইতেন মা তানপুরা নিয়ে। তার গলার কারুকাজে মিশে থাকতো সব সময় এক অপার্থীব বেদনা। বাবার জন্যও মন কেমন করে আমার আজকের এই বিমূর্ত সকালে। এস এস সিতে ভালো রেজাল্ট করবার পর বাবা ভীষন খুশি হয়ে কিনে দিয়েছিলেন গ্রান্ড পিয়ানো। সে সময় ধানমন্ডির মেলোডী মিউজিক শপের লোকটা বলছিলো মা এমন কপাল কয়জনের হয় বলো? এই গ্রান্ড পিয়ানো ঢাকা শহরের কজনার ভাগ্যে জোটে? আল্লাহ মালিক তোমাকে এমন একজন পিতা দিয়েছেন। অনেক বড় হও। গুণী হও।
বাবার জন্য মন কেমন করে আমার। বড় অভিমানী আর আতম্ভরী বলেই আমি চলে আসার পরে একটা খোঁজও নেননি। নাহ এবার ঢাকা ফিরেই বাবার কাছে যাবো। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করি শুভ্রের সাথে বিয়ের প্রায় পাঁচ মাস পেরুতে চললো এমন করে কখনও বাবা মা বাড়ির জন্য প্রাণ কাঁদেনি আমার। আমি মেতে ছিলাম নতুন এডভেঞ্চারে, নতুন জীবন নিয়ে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা আর শুভ্রকে নিয়ে।
হঠাৎ শুভ্রদের বাড়ির মমতাময় টিপিকাল বাঙ্গালী পরিবারের ভালোবাসা, রাগ দুঃখ, আবেগ অভিমান আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো আমার নিজের বাড়িতেই। আমি আমার বাবা মা বাড়িটাকে হঠাৎ মিস করছি।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি এই সাত পাঁচ ভাবনার মাঝে কখন শুভ্র উঠে এসে অপলক তাকিয়ে আছে আমার মুখে। বললো, এখনও মন ভালো হয়নি? তোমাকে খুব শক্ত মেয়ে ভেবেছি আমি। এমন করে কেউ ভেঙ্গে পড়ে! এমন করে কষ্ট পায়! আমি আছি না? আমি ওর বুকে মুখ লুকাই। শুভ্রের হৃদপিন্ডের শব্দ। আমি বললাম মা বাবার জন্য মন খারাপ লাগছে। শুভ্র আমাকে জড়িয়ে রইলো। বললো এবার ঢাকা ফিরে আমরা যাবো। উনাদের সাথে দেখা করতে।
আমি বললাম জানো? আজ শৈলীর গান শুনে আমার মনে পড়ে গেলো মায়ের তানপুরা নিয়ে ভোরবেলা রেওয়াজ করার দৃশ্য। মনে পড়ে গেলো বাবা আমাকে একদিন ভীষন আনন্দিত হয়ে উপহার দিয়েছিলেন একটি গ্রান্ড পিয়ানো। আমার সেই বাঁজনা বাসায় যেই আসতো বাবা ধরে ধরে শুনাতেন সবাইকে।
শুভ্র বললো, মন খারাপ করো না। আমিও তোমাকে একটা পিয়ানো কিনে দেবো।
আমি বললাম কবে?
শুভ্র বললো, একদিন
আমি বললাম, কোনদিন?
শুভ্র বললো, একদিন, স্বপ্নের দিন ......
আমরা দু'জনে হেসে উঠলাম......
আগের পর্বগুলি
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১১:৩৬