শুভ্র এগিয়ে গিয়ে উনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। শুভ্রকে দেখে আমিও পা ছুঁয়ে সালাম করলাম উনাকে। শুভ্র বললো, মা আমরা বিয়ে করেছি। উনি নির্লিপ্ত মুখে বললেন, ভিতরে যাও। তারপর নিজেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। শুভ্র ফিসফিস করে কিন্তু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো, শি ইজ শকড। নো প্রবলেম। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভিতরে চলো। শৈলী এতখন হতচকিত মুখে দাঁড়ি্যে ছিলো। হঠাৎ সে ভাবী ঈঈঈ বলে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ফিস ফিস করে বললো, ভাবী তুমি আমার?? কি যে সুন্দর তুমি!! আমার কি যে ভালো লাগছে!!! আমি তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবো! ওর খুশি বা উচ্ছাস চাপা রইলো না কিন্তু সবকিছুই সে বলছিলো ফিসফিস করে কারণ বুঝাই যাচ্ছিলো এই উচ্ছাস তার মা জানতে পেলে তার খবরই আছে। মনে হচ্ছে এই বাড়িতে তার রাশভারী মায়ের ভালোই একটা প্রভাব আছে। সে যাক। পরে এসবের খবর করা যাবে। এখন জীবন নামক নাট্যের পরের দৃশ্যে বরং অবর্তীণ হই এবং এর মজা বা কৌতুক বা আনন্দ যাই হোক না কেনো তা পুরোটাই আস্বাদন করি।
শুভ্র আর শৈলীর সাথে সাথে আমি শুভ্রের ঘরে এসে ঢুকলাম। ছিমছাম পরিপাটি করে সাজানো ঘর। খুব সামান্য আসবাবপত্র। কিন্ত চারিদিক ঘিরে সুচারুরূপ আর মমতায় ছোঁয়া। বিছানা, বালিশের কাভারে আশ্চর্য্য সুন্দর সব সূচীকার্য্য। টেবিলক্লথটা তো আরও দারুন কুরশিকাটার নক্সায় বোনা। আমি অবাক হয়ে চারদিকে দেখছিলাম। এই প্রায় দুপুরের ছায়া ছায়া সুশীতল ঘরের মাঝে কি এক অজানা মায়া! পায়ের তলায় সিমেন্টের মেঝে। কিন্তু রোজ তাতে মুছে মুছে কি অদ্ভুত তেলতেলে মসৃণ! মাধবীলতার একটা গোলাপী সাদা ফুলে ভরা ডাল ছুঁয়ে আছে জানালার শিকে। জানালার তাকে দুইটা চঁড়ুই ইড়িক চিড়িক করে ডেকে চলেছে। এমন করে তো অনেক কিছুই দেখা হয়নি আমার আগে! শৈলী সেই ঝকঝকে তকতকে করে পাতা ফুলতোলা নক্সাদার বিছানাটাই ফের ঝাড়ু দিয়ে ঝুপঝাপ ঝাড়তে লাগলো। আমাকে টেনে বসায়। এটা সরায়, ওটা সরায়। মনে হচ্ছিলো আমাকে পেয়ে ছোট্ট মেয়েটা এক আশ্চর্য্য মোহের ঘোরে ঢুকে পড়েছে।
ওর কান্ড দেখে হাসি পাচ্ছিলো। আমি ওকে টেনে বসালাম। বললাম শৈলীমনি তোমাকে এত ব্যতিব্যাস্ত হতে হবে না। সব ঠিক আছে। এখন এইখানে চুপ করে বসো। দেখো আমি তোমার জন্য কি এনেছি। ওর জন্য আনা সালোয়ার কামিজ, ওরনামেন্টস সবকিছু বের করে দিলাম আমি।আনন্দে ওর চোখ চিকচিক করে উঠলো। শুভ্রের কাছে শুনেছিলাম এই বোনটা ওর অনেক আদরের। আর শুভ্রর কাছে যা আদরের তা তো আমারও আদরের হতেই হবে। দরজায় উঁকি দিচ্ছিলো আরও একটি মধ্যবয়স্ক নারীর মুখ। শৈলী তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো ঘরের মধ্যে। বললো, দেখো দেখো ময়নার মা। এটা আমাদের ভাবী। কত সুন্দর না বলো? ময়নার মা মুখে কাপড় গুঁজে হেসে উঠলো,এতদিনে ভাইজান একখান কামের কাম করছে। তয় বলন নাই কওন নাই হডাৎ এমুন বিয়া। নাহ এইডা ঠিক অয় নাই। বিয়া হইলো মুরুব্বীগোর দোয়া। বাড়ির হগলতের আমোদ সামোদের ব্যপার স্যাপার। মুরুব্বীগো আশীর্বাদ ছাড়া কি বিয়া অয়! নাহ ইডা ঠিক অইল না। বিজ্ঞের মত মাথা নাড়তে লাগলো সে। তার কান্ড দেখে আমার বড় হাসি পাচ্ছিলো। শৈলীর অবশ্য এসব শোনার সময় নেই। আজ সে বড়ই আনন্দে আছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম শুভ্র আশেপাশে কোথাও নেই। হাওয়া হয়ে গেছে।
হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে চমকালাম। তারপর পরই মা শৈলী, কই তুই, কোথায় রে? হাক ডাকে পুরো বাড়ি জেগে উঠলো যেন। শৈলী বললো বাবা এসেছে। বলেই দৌড়ে গেলো। কিছুপরেই মোটাসোটা, হাসিখুশি চেহারার, সদাই হরিশ একজন মানুষকে প্রায় টেনে টুনেই নিয়ে এলো শৈলী। বললো, বাবা এটা ভাবী আর ভাবী বাবাকে সালাম করো। আমাকে কেউ বলে দেয়নি। তবু আমি এক গলা ঘোমটা টেনে উনাকে সালাম করলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় উনি প্রথমে হকচকিয়ে গেছিলেন মনে হয়। তারপর আমার দিকে একবার, শৈলীর দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ভাবী মানে ? তোর ভাবী? মানে আমাদের শুভ্রের বউ! তারপর হো হো করে বেষম জোরে হাসতে শুরু করলেন। তাই বল, এটা শুভ্রের বউ। মানে বেটা নিজে নিজেই কাজ সেরে ফেলেছে। মনে হলো ছেলের এই অপ্রত্যাশিত বিয়েতে উনার মত কৌতুক আর আনন্দ কেউ কখনও পায়নি আর পাবেও না কোনোদিন।
হঠাৎ কি মনে পড়ে যাওয়ায় উনি হন্ত দন্ত হয়ে ভেতরের দিকে ছুটলেন। আরে এই শুভ দিনে তো মিষ্টি আনতে হবে। সবাইকে খবর দিতে হবে। সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে হবে। শুধু মুখে কি ....
পুরো বাড়ি যেন উৎসব মুখর করে তুললেন উনি একাই। আমার চারিদিকে তখন এক অচেনা জগৎ। যে জগৎটার সাথে আমার পরিচয় নেই। একটা নতুন বাড়ি। নতুন বাড়ির মানুষগুলো। দড়জা জানালা, খাট পালং। এই কিছু সময়ের মাঝেই তাদের নানা রকমের আচরণ, মুখভঙ্গি, আনন্দ বেদনা রাগ দুঃখ আপন করে নেওয়া আমাকে ঘিরে ফেললো। আমার মনে হচ্ছিলো এ জীবনটাও খারাপ না। বরং বেশ আনন্দের। কোনো এক পারিবারিক নাটকের বাস্তব মঞ্চ যেন।
দুপুরের খাবারের পর শুভ্রর মা মানে আমার শ্বাশুড়িমা আমাকে উনার ঘরে ডেকে নিলেন। এইটুকু সময়ে দেখা এই বাড়িটার সবচেয়ে দূর্বোধ্য মানুষটিই তিনি। এ বাড়ির সকল মানুষকেই খুব সহজবোধ্য ও আন্তরিক মনে হয়েছে। শুধু ইনিই কেমন যেন অনেক দূরের মানুষ। সেই সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া এবং এই পর্যন্ত সারাটা সময় একটি কথাও বলেননি উনি। গম্ভীর মুখে সকলকে খাইয়েছেন। তবে দুপুরের খাবার সময় মাছের মুড়োটা সবার আগে উনি আমার পাতে তুলে দিলেন যখন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম আমি। একে তো আমি মাছের মুড়ো খাইনা তার উপর আজীবন শুনেছি এসব খাবার মানুষ জামাই আদর করতে জামাইকে বা বাড়ির কর্তাকে খাওয়ায়। মানে পুরুষের খাদ্য। কিন্তু আমি তো জামাই না। বরং তাদের এক টুকরো সোনার ছেলেটার অপ্রত্যাশিতভাবে বিয়ে করা অবাঞ্ছিত ও রবাহত পুত্রবঁধু।
কিন্তু এই উনিই যখন দুপুরের পর বিকেলের দিকে উনার ঘরে আমাকে ডেকে নিলেন। জানিনা কেনো অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিলাম আমি। উনি বড় অবসন্নভাবে বিছানার উপর বসে ছিলেন। আমাকে দেখে ইশারায় সামনে বসতে বললেন। আমি বসতেই কিছু সময় পরে বলে উঠলেন, আচ্ছা তুমি তো পড়ালেখা জানা জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ণ একজন মেয়ে। তো কোন নির্বুদ্ধিতে নিজের পায়ে না দাঁড়ানো একজন বেকার ছেলেকে বিয়ে করে বসলে বলোতো? ভেবে দেখেছো এই ছেলে খাওয়াবে কি? কি পরাবে তোমাকে? তোমার কোনো দায় দায়িত্ব নিতে পারবে সে? আরে সে নিজেই তো বাপের ঘাড়ে খায়। তোমাকে খাওয়াবে কি? সে না হয় বেকুবের মত কাজ করলো। তুমি করলে কি করে?
আমি বললাম, আমাকে খাওয়াতে হবে না। আমি জব করছি। আমাদের দুজনের সংসার ঠিক ঠিক চলে যাবে যতদিন ও জব না পায় আমিই চালাবো? উনি বিস্ফারিত নেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন! বললেন, কি বললে তুমি! তুমি সংসার চালাবে! একি কলিকাল! তো বউ এর টাকায় এখন চলতে হবে আমার ছেলেকে! ক্রোধে ফুসছিলেন উনি। আমার চোখ ফেটে জল আসছিলো। অনেক কষ্টে দৃঢ় প্রত্যয়ে কান্নাটাকে ধরে রাখলাম আমি। উনি ক্রোধে উন্মত হয়ে আমার দিয়ে তাকিয়ে রইলেন....
হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে চিৎকার করে হাউমাউ কান্না শুরু করলেন। সাথে ছিলো উনার বিলাপ! এত কষ্ট করে ছেলেকে খাইয়ে পরিয়ে বড় করে এই ছিলো তার কপালে! কত আশা ছিলো পড়ালেখা শিখে ছেলে তার বড় চাকুরি করবে। বাবা মায়ের মুখ উজ্বল করবে। তাদের মনের মত একটা লক্ষী ফুটফুটে বউ বিয়ে করবে। এমনকি তার জন্য তার দূর সম্পর্কের এক বোনের মেয়েকে ঠিকও করে রেখেছিলেন তিনি। অথচ আজ এ কি দেখলেন! একি শুনলেন! এখন তিনি কি করে মুখ দেখাবেন উনাদেরকে!
আমি নিশব্দে ওখান থেকে উঠে এলাম। তখন সন্ধ্যা নামছে। আমি জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দুপুরবেলার সেই গোলাপী সাদা মাধবীলতার ফুলগুলো একটু যেন ম্লান মুখে ঝুঁকে পড়েছে। দুপুরের সেই চুড়ুই পাখি দুটোর কোনো সাড়া নেই এখন। সব কিছু কেমন যেন গুমোট আর বদ্ধ লাগছিলো আমার। নিজেকে খুব অপরাধীও মনে হচ্ছিলো। আমি জানালার শিকে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ। ফিরে দেখলাম শুভ্র। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না আমি। ওর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:৩৪