হুট করেই বিয়েটা করে ফেলেছিলাম আমরা। শুধুই হুট করেই নয় এমন করে আগ পাছ না ভেবে বিয়ে করে ফেলাটাও আমাদের জন্য বেশ রিস্কিই ছিলো। মুখোমুখি পরিচয় ছিলো না আমাদের। যা কিছু ভালো লাগা ভালোবাসা, প্রথম পরিচয় থেকে বিয়ে সবই হয়েছিলো অনলাইনের কল্যানে। যদিও সেই পরিচয়টা ছিলো দীর্ঘদিনের। প্রায় ৩ বছরের। এভাবেই একে অন্যকে জানাশোনা, ঘন্টার পর ঘন্টা এক সাথে গুটুর গুটুর। মুখোমুখি দেখা না হলেও মনের চোখে সারাক্ষনই দেখা হত আমাদের। তবে বিয়ের মত এমন গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নেবার আগে ওর সাথে আমার দেখা মানে সামনা সামনি দেখা হয়েছিলো গুনে গুনে মাত্র ৩ বার। মুখোমুখি দেখা হবার বিষয়টা আসলে ততদিনে ছিলো গৌন। মুখ্য ছিলো পারস্পারিক নির্ভরতা, একে অন্যের উপর বিশ্বাস, মায়া আর ভালোবাসা। এটার জন্য মনে হয় না আজকাল আর এত সামনা সামনি দেখা শোনার প্রয়োজনও আছে। ওর সকাল থেকে সন্ধ্যে, ঘুম থেকে ওঠা বা ঘুমিয়ে পড়া এমন কি ঘুমের মধ্যটাকেও ততদিনে জেনে গিয়েছিলাম আমি। বর্তমানের অনলাইন, ফেসবুক, মুঠোফোনের যুগে এমন করে প্রায় সম্পূর্ণটাও জেনে ফেলা তেমন কঠিন নয়। লিখছি আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। যখন আমাদের পরিচয়ের শুরু।
পরিচয়ের শুরুতে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমি ওর প্রেমে পড়তে পারি বা সে আমার প্রেমে। আমরা আসলে খুবই ভালো বন্ধু ছিলাম। তার মত এমন একজন বন্ধু আমার সারা জীবনের পুরোটা সময় জুড়ে কখনও পাওয়া হয়নি। এমনটাই মনে হত আমার। তাকে আমার কখনও ছেলে বা মেয়ে বন্ধু এমন করে জেন্ডারের হিসাবেও বন্ধু মনে হয়নি। সে নারী পুরুষ সকল কিছুর উর্ধে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। সে যে কখনও আমার প্রেমেও পড়তে পারে এমনটা তাই আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। সে ছিলো আমার অতি বিশস্ত শুধুই এক বন্ধু। যাকে দিয়ে আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম। সে দিন বললে দিন আর রাত বললে রাতই মনে হত আমার। এত বিশ্বাস আমি আমার জীবনে কাউকেই করিনি। এত কনভিন্স আমি কখনও কাউকে দিয়ে হইনি। তবুও আজ মনে হয় আমি হয়ত তার প্রেমে পড়তাম না। কারণ দেবতা বা মহাপুরুষের প্রেমে মানুষ পড়তে পারে না। শুধুই শ্রদ্ধা করতে পারে। সেও কারো প্রেমে পড়তে পারে, তাও আবার আমার এও আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
কিন্তু এরপরেও বুঝলাম সে আমার প্রেমে পড়েছে মানে সে প্রেমে পড়েই গেলো এবং সে কথা আমাকে জানালো। এভাবে এক সাথে থাকতে থাকতে কখন সে আমাকে এইভাবে ভালোবেসে ফেলেছে নিজেও তা বুঝতে পারেনি। আমি তাকে ভালোবাসতাম ঠিকই কিন্তু তা ঠিক প্রেমে পড়ার মত নয়। কিন্তু তার সেই আহ্বান আমি উপেক্ষা করতে পারলাম না। এতদিনের এমন একজন বিশস্ত নির্ভরযোগ্য বন্ধুকে কি করে ফেরাবো আমি? কি করে উপেক্ষা করবো তাকে? তাকে ছাড়া জীবনে চলাটা তখন প্রায় অসম্ভব আমার কাছে। তাই মনকে বুঝালাম আর বুঝলাম আমার জীবনে তার মূল্য অপরিসীম। আর আমি তাকে ছাড়া চলতেই চাইনা। পারবোও না হয়ত।
এরপর আর দূরে থাকতেই চাইলাম না আমরা। আর তাই এক আলো ঝলমল বসন্ত সকালে আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরেই ফেললাম। এতক্ষন যারা এই লেখাটা পড়ছেন তারা হয়ত ভাবছেন এটা খুবই স্বাভাবিক ও চিরচেনা এক গল্প। মানছি এমন গল্প অনেকই আছে আমাদের জীবনে দেখা, জানা ও চেনা। আমিও শুনেছি। সে যাইহোক, চিরদিনের অপরিনামদর্শী আমি আরেক চির অপরিনামদর্শীর হাত ধরে আমার বাবার গুলশানের ঝাঁ চকচকে ফ্লাট ছেড়ে নাখালপাড়ার সরু গলির এক পলেস্তারা খসা বিল্ডিং এর রেলিংবিহীন সিড়ি বেয়ে তিনতলার ছাদের চিলেকোঠার এক কামরার সংসারে এসে উঠলাম। এমন না আমি এসব না জেনেই এসেছিলাম। এসবই আমার চেনা ও জানা ভিডিও চ্যাটের কল্যানে। কাজেই এসব জেনে শুনে ও মেনেই আমি তার হাত ধরে সেখানে এসে উঠেছিলাম। আমি কিশোরী ছিলাম না। আমি তখন রীতিমত জব করছি। কাজেই সেটা কিশোরী আবেগও ছিলো না। বলতে গেলে কিছুটা চ্যালেঞ্জ বা এক্সপেরিমেন্টও হতে পারে।
যেদিন বিয়ে করলাম সেদিন সকালবেলায় যখন মাকে জানিয়েছিলাম। মা তখন সবে মর্নিং ওয়াক সেরে এসে তার বেডরুমের প্রিয় বারান্দায় বসে তার প্রিয় পাখিদের সাথে মর্নিং টিকাপ হাতে বসেছিলেন। আমি যখন জানালাম আজ আমি একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। মা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বললাম মা এত অবাক হবার কিছু নেই। তুমি যে তোমার আনিসভাইকে ছেড়ে আমার বিত্তশালী বাবার সাথে বিয়ে করে ফেলেছিলে একদিন, তোমার বদরাগী বাবার ভয়ে সেটা আমি জানি। আর সেই কারণে তোমার আনিস ভাইও যে সেই রাতেই আত্মহত্যা করেছিলো সেই কথাটাও আমি জানি। এ নিয়ে সারাজীবন তুমি এক গোপন দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছো, যা তুমি কখনই কাউকেই বলতে পারোনা সেই কথা জানতেও আমার বাকী নেই। আমি তোমার ডায়েরী পড়েছি। তাই আমি কোনো সিনক্রিয়েট চাই না এবং সারাজীবন তোমার মত কোনো দুঃখও বয়ে বেড়াতে চাইনা। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি ওকেই বিয়ে করবো, যাকে আমি ভালোবাসি। আমাকে আমার বদরাগী বাবা বা সুন্দরী মা কেউই কোনোভাবেই আটকাতে পারবে না। আর তাছাড়া আমি নিজে জব করছি। দুজনে ভালোই থাকতে পারবো নিশ্চয়! এটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত। তুমি দোয়া করো মামনি। মা একটাও কথা বলেননি। আটকাননি আমাকে। হয়ত তার ব্যর্থতা আজ আমার ভেতরে পূর্ণ হতে যাচ্ছে এটা ভেবেই। তবে ঘটনার আকস্মিকতায় উনি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিলেন।
যাইহোক আমার বাবার বাড়ি, গাড়ি বিত্ত অহংকার সবকিছু ছেড়ে সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্তে এই চিলেকোঠায় উঠে আসা ব্যপারটাকে বাবা কি পরিমান ঘৃনার চোখে দেখবেন তা আমি দিব্য চোখেই দেখতে পাচ্ছিলাম কিন্ত আমি এও জানতাম বাবা কোনোদিনও আসবেন না আমার সিদ্ধান্তে নাক গলাতে। এমনকি আমি না খেয়ে মরে যাচ্ছি সে খবর পেলেও উনি আসবেন না, আমাকে উদ্ধার করতে। মোট কথা আমি এই পরিমান স্বাধীনতাতেই বড় হয়েছিলাম এবং নিজের সিদ্ধান্তের উপরে কেউ কখনও জবরদস্তি করেনি আমার পরিবারেও।
কাজেই সেই সন্ধ্যায় মিটমিটে বাল্বের এক রুমের সংসারে শুরু হলো আমাদের টোনাটুনির পথচলা। আমি যদিও পড়ালেখা শেষ করে তখন প্রায় বছর দুই জব করছি একটা মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে। কিন্তু ও তখনও আই বি এর স্টুডেন্ট। চালচুলোহীন। তাতে আমরা চিন্তিত তো ছিলাম না মোটেও বরং আমি জানতাম আমি একা যা উপার্জন করছি তা দিয়ে আমাদের দুজনের খুব ভালোই চলে যাবে। আনন্দে আর ভালোবাসায়...... শুধু ছেলেরাই সংসার চালাবে আর মেয়েরা বসে বসে খাবে ? সেদিন হয়েছে বাসী। মানে আমি এবং আমরা সবখানেই ভালোই এক্সপেরিমেন্টাল ছিলাম।
কি? অবাক হচ্ছেন বা মুখ টিপে হাসছেন এ কথা শুনে?
আচ্ছা সবই বলবো। আমাদের সেই এক্সপেরিমেন্টের কাহিনী। লেখাটা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আজ থামছি। আবার আসবো খুব শিঘ্রীই...
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:০৪