গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসকে কেন্দ্র করে, লন্ডনের বিশ্ববিখ্যাত “গ্লোব থিয়েটার”-এ ২১শে এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ছয় সপ্তাহব্যাপি “আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব।” বিশেষত ২৩ শে এপ্রিল, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্মদিন কে কেন্দ্র করে, তাঁরই প্রতিষ্ঠিত করা “গ্লোব থিয়েটার”- এবার মঞ্চায়িত করবে ৩৭টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষার ৩৭ মঞ্চ নাটক!
আনন্দের ও গৌরবজনক বিষয় হল, শিল্প সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং একই সাথে বিখ্যাত এই আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে, এই প্রথমবারের মতো আমাদের দেশ অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে!! এ এক অভূতপূর্ব সম্মাননা আমাদের জন্য!!
আমাদের জন্য অভূতপূর্ব সম্মাননা কেন এটি বুঝতে হলে আগে গ্লোব থিয়েটার কি বা কি এর কর্মকাণ্ড আগে সেটি জানা জরুরী। এর রয়েছে ৫০০ বছরেরও বেশী গৌরবজনক এক ইতিহাস।
১৫৯৯ সালে কাঠের তৈরি কয়েকটি বসার জায়গা আর উন্মুক্ত একটি মঞ্চ নিয়ে যাত্রা শুরু করে আজকের "গ্লোব থিয়েটার!" রাণী প্রথম এলিজাবেথ জন্ম দিয়েছিলেন ইংরেজি শিল্প-সাহিত্য, বিশেষত নাটক এর জন্য এক স্বর্ণযুগ! তাঁর শাসনামলে (১৫৫০-১৬২০) ইংরেজি মঞ্চ নাটক পৃথিবীতে এক নবজাগরনের সূচনা করেছিল। তাই এই যুগকে বলা হত “age of drama.”
নাটকে শেক্সপিয়ার, ক্রিস্টোফার মার্লো, বেন জনসন, থমাস মিডেলটন, থমাস হেউড সহ প্রমুখ, অন্যদিকে পদ্যে এডমুন্ড স্পেন্সার, ফিলিপ সিডনী, জর্জ চ্যাপম্যান ইত্যাদি মিলে ইংরেজি সাহিত্যকে একপ্রকার হিমালয়ে পৌঁছে দেয়।
প্রাথমিক নকশা
পরবর্তীতে শেক্সপিয়ার বা তাঁর প্রতিষ্ঠান Lord Chamberlain's Men , শেক্সপিয়ার যুগের বিখ্যাত অভিনেতা Richard Burbage , তাঁর ভাই Cuthbert Burbage , John Heminges , Augustine Phillips , Thomas Pope – এই ছয় জন হলেন গ্লোব থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা বা শেয়ারহোল্ডার। অবশ্য Richard Burbage এর বাবা James Burbage লন্ডনের Shoreditch (বর্তমান পার্ক স্ট্রীট) তে ১৫৭৬ সালে নাটকের জন্য একটি মঞ্চের কথা চিন্তা করেন। পরবর্তীতে Peter Street (carpenter) এর ডিজাইনে তৈরি হয় কাঠের “গ্লোব থিয়েটার।” কিন্তু ২৯ শে জুন, ১৬১৩ তে আগুনে পুড়ে যায় এই থিয়েটার।
কাঠের তৈরি গ্লোব
পরবর্তীতে বচরেই দ্বিতীয় দফায় টেমস নদীর কাছে Southwark Bridge Road, London –এ গড়ে উঠে গ্লোব থিয়েটার যাকে "Shakespeare's Globe!" ও বলা হয়ে থাকে।
১৫৯৯ সালের গ্রীষ্মে শেক্সপিয়ার তাঁর বিখ্যাত নাটক Henry V প্রথম এখানে মঞ্চায়িত করেন।
আরও মঞ্চায়িত হয় তাঁর Julius Caesar , Romeo and Juliet সহ অসংখ্য নাটক , আরও মঞ্চায়িত হয়েছিল আরেক সুবিখ্যাত বেন জনসনের নাটক- Every Man out of His Humour
এমনকি শেক্সপিয়ার নিজে এই মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন, তাঁরই লেখা সব বিখ্যাত নাটক “Hamlet”এর “the Ghost of Hamlet's father”; “As You Like It” এর বিশ্বস্ত চাকর “Adam”; “Macbeth” এর “King Duncan”; “Henry IV” এর “King Henry” সহ অসংখ্য চরিত্রে।
লোগো
প্রবেশ দ্বার
ধীরে ধীরে গ্লোব থিয়েটারের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিশ্বব্যাপী। বাড়তে থাকে নাটকের সংখ্যা। একে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে উৎসব! তখন কেবল রাজ্যসম্প্রদায়ের সদস্যই নয়, সাধারণ মানুষও উপভোগ করতে শুরু করেন এই মঞ্চ!
খোলা স্টেডিয়ামের (Amphitheatre) আদলে গড়া, তিন তলা বিশিষ্ট এই থিয়েটারের মূল মঞ্চকে বলা হয় “পিট।” প্রায় ৩,০০০ দর্শক একসঙ্গে বসে সূর্যের আলোয় বেলা ২ টা ত থেকে ৫ টা পর্যন্ত এই মঞ্চে নাটক দেখতে পারেন।
কোন বাড়তি আলোর ব্যবহার হয় না এতে। মূল মঞ্চটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪৩ ফুট (১৩.১ মিঃ), প্রস্থে ২৭ ফুট (৮.২ মিঃ), মূল ভূমি থেকে ৫ ফুট (১.৫ মিঃ) উপরে।
মজার ব্যাপার হল, Pit এর কাছে দাঁড়িয়ে নাটক উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে দিতে হবে “one Penny.”
নানা প্রান্ত থেকে আসা নাটক মঞ্চায়ন
গ্লোব থিয়েটারের মূলবাণী হলঃ “totus mundus agit histrionem” ল্যাটিন এই বাক্য এবং তৎকালীন পিউরিটান ধর্মীয় বাণীতে উজ্জীবিত হওয়া এর মানে, "because all the world plays the actor” বাংলায়- “পৃথিবী একটি রঙ্গমঞ্চ, আমরা সবাই অভিনেতা!”
এবার শুনি ঢাকা থিয়েটারের কথা। মূলত আমাদের মঞ্চ নাটকের ইতিহাস অনেক গৌরবজনক। স্বাধীনতা পরবর্তী রাজধানী ঢাকায় অনেকগুলো নাট্যদল গঠিত হয়েছিল, সেগুলো হলঃ থিয়েটার (ফেব্রুয়ারি- ১৯৭২), নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় (আগস্ট-১৯৭২), নাট্যচক্র (আগস্ট-১৯৭২), আরণ্যক নাট্যদল (১৯৭২), ঢাকা থিয়েটার (জুলাই-১৯৭৩), ঢাকা পদাতিক। আর চট্টগ্রামে গঠিত হল, চট্টগ্রাম থিয়েটার (১৯৭৩), অরিন্দম (১৯৭৪)।
আমরা পেয়েছি আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশিদ, সেলিম আল দিন, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ, সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজউদ্দিন আহমেদ, এস এম সোলাইমান ইত্যাদির মতো গুণী ব্যক্তিত্ব, যারা বিকশিত করেছিলেন বাংলা নাটক। এঁদের প্রচেষ্টায় ও সাংগঠনিক শক্তিতে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয় আলাদা নাট্য বিভাগ।
বাংলা আধুনিক নাটকের প্রবাদ প্রতিম সেলিম আল দিনের হাত দিয়ে গড়া বন্ধু নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সাথে ঢাকা থিয়েটার ইতিমধ্যেই দেশে, এবং বিদেশে তাদের প্রতিভার সাক্ষর রেখেছে। “কেরামত মঙ্গল, “হাত হদাই,” “চাকা,” “ধাবমান,” “কীর্তনখোলা” সহ অসংখ্য জনপ্রিয় এবং নন্দিত মঞ্চনাটক উপহার দিয়ে চলেছে।
সেই ধারাবাহিকতায় “ঢাকা থিয়েটার” মঞ্চায়িত করতে যাচ্ছে শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক “দ্যা ট্যাম্পেস্ট!” ট্যাম্পেস্ট- এর ছায়ায় আমাদের দেশীয় আবহ ও অবস্থান বিচারে (পাঁচালি- ডায়ালগ, গান, নাচ, ঢোল, বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে মঞ্চ নাটকের একটি শাখা) ঢাকা থিয়েটার বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে এই প্রথম বারের মতো গ্লোব থিয়েটারে নাটক মঞ্চায়িত করতে যাচ্ছে!! এই প্রথমবারের মতো আমাদের বাংলা ভাষা, গান, নাচে তার মাধুর্য ছড়াতে যাচ্ছে গ্লোব থিয়েটারে!
খবর সূত্র
এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রুবায়েত আহমেদ। সার্বিক পরিচালনা ও নির্দেশনায় আছেন প্রথিতদশা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। সংগীত ও নৃত্য পরিচালনায় থাকবেন শিমুল ইউসুফ, মঞ্চ তৈরি করবেন ঢালি আল মামুন। অভিনয়ে আছেন- শিমুল ইউসুফ, কামাল বায়েজিদ, শহিদুজ্জামান সেলিম, খাইরুল ইসলাম পাখী, চন্দন চৌধুরী, রুবেল লোদি, রফিক মোহাম্মদ, এশা ইউসুফ সহ প্রমুখ শিল্পী।
চলছে মহড়া
আগামী ৭ ও ৮ মে, গ্লোব থিয়েটারে দুবার মঞ্চায়িত হবে আমাদের নাটক “দ্যা ট্যাম্পেস্ট।” সে উদ্দেশ্যে ২ বা ত মে ঢাকা থিয়েটার তাদের ১৫ সদস্যের একটি দল নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে যাবে। এবং শিল্পকলা একাডেমীর ১ নং রিহার্সেল রুমে সংশ্লিষ্ট সবাই মহড়ায় ব্যস্ত। তার আগে “আমরা স্বপ্ন নদীর নাইয়া” স্লোগানে ২৭ শে এপ্রিল শিল্পকলা একাডেমীতে দেশীয় দর্শকদের জন্যও এটি প্রথমে মঞ্চায়িত হবে।
এই লিঙ্কে গিয়ে লন্ডন প্রবাসিরা এই নাট্য উৎসবের সব রকম খোঁজ খবর ও টিকেট বুকিং দিতে পারবেন।
এটি নিঃসন্দেহে কেবল একটি শুরু। আরও আরও অসংখ্য দল, নাটক একসময় গ্লোব থিয়েটার রাজত্ব করবে, এর দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করবে, এই আশা করি। আমাদের নাটক, কিংবা সাহিত্য-সংস্কৃতির আরও আরও যেসব কৃষ্টিকলা আছে, তা উত্তর উত্তর ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী।
একটি দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, খেলাধুলা বাহির বিশ্বে সে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাই দেশীয় শত অন্যায়, কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, অভাব, নাগরিক দুর্দশার মাঝেও এসব সকল ক্ষেত্রের তরুণ থেকে প্রবীণ, ছাত্র থেকে গৃহিণী, শ্রমিক থেকে উদ্যোক্তা; যারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা উড়ান আমাদের লাল-সবুজ পতাকা, তাদের সকলকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
গ্লোব থিয়েটারে বাংলাদেশের এই পদার্পণ অন্তহীন গৌরবের হোক।
__________________________________________________
*** আজ উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্মদিন। সাহিত্য বা নাটক অনুরাগী তারা উনার নাম বা বই পড়েনি এমনটা বিরল। তাঁর এবারের জন্মদিনে আমাদের দেশের নাটক আন্তর্জাতিক ভাবে সম্পৃক্ত হতে যাচ্ছে, বিষয়টা দারুণ। সবার জন্য শুভকামনা।