তুমি ইডেন কলেজ থেকে সমাজকল্যাণ বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছ। পড়াশুনার ফাঁকে পার্টটাইম জবও করতে। ঢাকা কলেজে অধ্যয়নরত ছোট ভাইকে লেখাপড়ার খরচ চালাতে মাঝে মধ্যে সাধ্যমত সাহায্য করতে। এগুলো তো একজন বিচক্ষণ ও বিবেকসম্পন্ন মানুষেরই পরিচয় বহন করে। তুমি তোমার বাবা-মার যোগ্য সন্তান বটে। তোমাকে দেখে অনেকেরই অনেক কিছু শিখবার আছে। শুধু উচ্চশিক্ষা গ্রহণই নয়, যথাযথভাবে তুমি তা কাজেও লাগিয়েছ। অনেকেই যা পারেনি। বিয়ে পড়ানোর পরেও যৌতুকের বলি হবার হাত থেকে মুক্তির লক্ষে তুমি যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছ (প্রথম আলো- ২৪ পৃষ্ঠা- কলাম- ২ "কন্যা সাহসিকা") তা ভেবে প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণে মনে হলো- ভালই হয়েছে। বিয়ের পিরিতে যে অশান্তি ও দন্দ দানা বেধেছে, তা সারা জীবনময় বয়ে বেড়ানোর কোন মানেই হয়না।। মনে হচ্ছিল নারীদের অবলা বলার দিন শেষ হলো বলে। যদিও পথটি বন্ধুর, তথাপি সেই অন্ধকার পথটি এতদিনে যে কিছুটা আশার আলো খুঁজে পেল, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তোমার নামে লোকে যে যাই বলুক- তোমার প্রতি রইল আমাদের লাল ছালাম। তোমার উদ্দেশ্য যদি সত্যিই সৎ হয় এবং অন্তর হয় স্বচ্ছ, তবে জেনে রেখ, 'তোমার হার নেই।' তুমি শুধু তোমার নয়, বাবা-মা, পরিবার, এমনকি গোটা নারী সমাজের কথা ভেবেছ। সবার ব্যথাকে তুমি তোমার প্রতিবাদী ভাষায় প্রকাশ করেছ। তুমি যে সাহস দেখিয়েছ তা কজনে পারে? তবে আমি বিশ্বাস করি যে, এখন থেকে অনেকেই এমনটি পারতে শিখবে। আমার নিজের বোন নেই, তাই বোনের অভাব এবং কদর আমি হারে হারে অনুভব করি। তোমার সাথে দেখা হলে ভাল হত, আরও অনেক কথা হত। জানিনা হবে কিনা। তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ ও শুভকামনা করছি। ভবিষ্যৎ সাক্ষাতের আশা রেখে, তোমার সাথে সুর মিলিয়ে আজ মনের কিছু কথা বলতে চাই।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এবং বাস্তবে যারা অধিক নির্যাতিত, তাদের একজনের পক্ষে মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছি। হতে পারেন তিনি ফারজানা নামের একজন বা অন্য কেউ। তাদের পাশে থাকার এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
সুখময় বন্ধন রচনাই বিয়ের মূল উদ্দেশ্য। এর জন্য প্রথমত চাই সহমর্মী দুটি অন্তর। তারপর অন্যসব হিসেব-নিকেশ, মান-অভিমান, টানা-পড়েন; মনের প্রশান্তির জন্য এসব অবশ্যই গৌণ জ্ঞান করা চাই। তাই পাত্রী এবং পাত্রীপক্ষ উভয়কেই মনে রাখা উচিত, যে পুরুষ যৌতুক চায় বা নেয় তার মন মানসিকতা কখনই ভাল হতে পারে না। কারন সেই পুরুষটি জীবন সঙ্গিনী পাবার জন্য সম্পর্ক করেনা, বরং টাকা-কড়ি, ধন-সম্পদের লোভে বিয়ের ফাঁদ পাতে। নিঃসন্দেহে এরা স্বার্থপর, ছোট মনের মানুষ ও পুরুষ জাতির কলঙ্ক। স্বভাবগত কারনেই এরা নিজেরা যেমন সুখী হতে পারেনা, তেমনি অন্যকেও সুখী করতে পারেনা। অনেকের ক্ষেত্রে বিষয়টি তাড়াতাড়ি প্রকাশ পায়। আবার অনেকে ধীরে-সুস্থে প্রকাশ করে। যখনই প্রকাশ পাক না কেন তাদেরকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। একবার প্রশ্রয় পেলে এরা মাথায় চড়ে বসে। তাদের লোলুপ দৃষ্টির ছোবল থেকে নিস্তার পাওয়া তখন বেশ কঠিন হয়ে পরে। যৌতুকের কালো থাবা যে দিন দিন বিস্তার লাভ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন নারীর যৌতুকের মর্মান্তিক স্বীকারে পরিণত হওয়ার ঘটনা থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়। শুধু অশিক্ষিত বা গরীব ঘরে নয়, অনেক নাম করা শিক্ষিত মহলও এই কুৎসিত মানসিকতা থেকে মুক্ত নয়।
তাই যারা যৌতুক নেয় তারা যে 'খুব নিকৃষ্ট মানসিকতার' এই প্রচার চালাতে হবে এবং তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সেই সাথে যারা যৌতুক চাইবে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো 'মেয়েদেরকে সচেতন হতে হবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে'। যে সব পুরুষ বা পরিবার যৌতুকের ইংগিত দেয়, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক না করে বরং পাত্রী ও পরিবার উভয়ের পক্ষ থেকে সরাসরি না বলার মত সৎ সাহস রাখতে হবে। নারী সমাজ যতদিন আত্মনির্ভরশীল ও সচেতন না হবে, ততদিন পরিবার বা পাত্রী কেউই এই সৎ সাহস দেখাতে পারবে না।
আরকেটি বিষয়। উভয় অভিভাবকের পক্ষ থেকে বিয়ের কথা পাকাপাকি করার আগে ছেলে-মেয়ের মাঝে কিছু সময়ের জন্য সাক্ষাৎ ও ভাব বিনিময়ের ব্যবস্থা করা উচিত বলে আমি মনে করি। তবে এ সময় আশেপাশে একটু ব্যবধানে ভাই-বোন বা কোন নিকট আত্মীয় উপস্থিত থাকা চাই। বিচক্ষণ পাত্র-পাত্রী হলে এ সময়ের মধ্যেই তারা একে অপরকে কিছুটা হলেও জেনে নেবার সুযোগ পায়। তাদের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে যা খুবই জরুরী। অভিভাবকের জন্যও এটি একপ্রকার স্বস্তির বিষয় হতে পারে।
সবশেষে একটা কথা না বললেই নয়, যৌতুক প্রথাকে নির্মূল করতে চাইলে অন্তত বিয়ের সময় গিফট্-টিফট্ লেন-দেনের ব্যাপারে হিসেব-নিকেশের কালচারটাও দয়া করে বন্ধ করা দরকার বৈকি। কারন এসব কালচারই শেষে সমাজের অন্ত্রে আলসার হয়ে দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তা ক্যন্সারের রূপও ধারন করতে পারে বৈকি। কথাটা ভেবে দেখবেন কিন্তু।