তাদের এই প্রশ্নের জবাব আমি এভাবেই দিতে চাই-
আল-কোরআন-
সূরা আল আ’রাফ (মক্কায় অবতীর্ণ)
(০৭:০১) আলিফ, লাম, মীম, ছোয়াদ।
(০৭:০২) এটি একটি গ্রন্থ, যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে করে তুমি এর মাধ্যমে ভীতি-প্রদর্শন কর। অতএব, এটি পৌছে দিতে তোমার মনে কোনরূপ সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়। আর এটিই বিশ্বাসীদের জন্যে উপদেশ।
(০৭:০৩) তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা তো খুব কম সংখ্যকই উপদেশ গ্রহণ কর।
আল-কোরআনের উপরের আয়াতের শর্তমতে আমার কাছে 'আহলে হাদিছ' ও 'আহলে কুরআন' -এ দুটোর মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। সুতরাং কেউ আমাকে 'আহলে হাদিছ' বা 'আহলে কুরআন' ভাবলেও ভাবতে পারেন। প্রত্যেক মুসলিম মাত্রই একবাক্যে ও নির্দ্বিধায় আল-কোরআনে প্রদত্ত স্বয়ং আল্লাহতায়ালার হাদিছে/বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করে বিশ্বাসীদের দলে অন্তর্ভূক্ত হওয়া চাই।
শান্তির ধর্ম হলো ইসলাম। অজ্ঞানতা হেতু ধর্মের নামে অশান্তি সৃষ্টি করা কোন বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে না। আল-কোরআন সম্পর্কে সাধ্যমত জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা প্রত্যেক ইমানদারের জন্য ফরজ। তাই এই জ্ঞানের পরিধিকে বাড়াবার তাগিদ আমি সব সময়ই অনুভব করি এবং সর্বদা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাকে প্রায়শই নানা রকম কটুক্তি ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আমি তো কোন ছাড়; স্বয়ং আল্লাহর নবী রাসূল (সাঃ) -কে এর চেয়েও কটু কথা শুনতে ও কঠিন পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রেরিত কিতাবে যে বিধান স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তা অনুসরণের ব্যপারে রাসূল (সাঃ) সর্বদাই বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং যারা অবমাননা করত তাদের সাথে কখনই কোন আপস করেন নাই। ইমানদার মাত্রই এরূপ মনোভাবই পোষন করা চাই। মহান আল্লাহতায়ালা যেন আমাদের সবাইকে একনিষ্ঠ ও সঠিকভাবে তাঁর বাণী অনুধাবন করার তৌফিক দান করেন।
আল-কোরআনের ভাষ্য মতে হালাল ও হারাম স্পষ্ট। আল্লাহতায়ালা যা সরাসরি হারাম হিসেবে ঘোষণা করেন নাই, জোর করে টেনে হেঁচড়ে সেই ব্যপারে হারাম হিসেবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া আদৌ ঠিক কি? অন্য কারো যুক্তি শুনে আল্লাহর কিতাবে হারাম হিসেবে স্পষ্টরূপে ঘোষিত হয়নি এমন কোন বিষয়কে কেউ হারাম ভেবে আরাম বোধ করলে সেই দায় একান্তভাবে তারই। বিশ্বাসী মাত্রই এসব ব্যাপারে ঢালাওভাবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবার আগে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
আসুন, এ সম্পর্কে প্রথমত মহান আল্লাহতায়ালার নিচের বাণী গুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করি-
সূরা আত তাওবাহ (মদীনায় অবতীর্ণ)
(০৯:৩১) ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে ওদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে এবং মরিয়মের পুত্রকেও। অথচ ওদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল একমাত্র মাবুদের ইবাদতের জন্য। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তারা তাঁর সাথে যে শরীক সাব্যস্ত করে, তার থেকে তিনি সর্বাত্মকভাবে পবিত্র।
সূরা ইউনুস (মক্কায় অবতীর্ণ)
(১০:৫৯) বল, আচ্ছা লক্ষ্য করে দেখ, যা কিছু আল্লাহ তোমাদের জন্য রিযিক হিসাবে দিয়েছেন সেগুলোর মধ্য থেকে তোমরা নিজেরাই কতককে হারাম আর কতককে হালাল সাব্যস্ত করে নিয়েছ কি? বল, আল্লাহ কি তোমাদেরকে তা করার অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহর নামে মিথ্যা বানিয়ে বলছ?
সূরা নাহল (মক্কায় অবতীর্ণ)
(১৬:১১৬) তোমাদের মুখে যা আসে তা-ই বলে দিও না- এটা হালাল এবং ওটা হারাম। এতে করে আল্লাহর নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা চালানো হবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে এরূপ মিথ্যা কথা প্রচার করে, তারা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারে না।
সূরা আল আন-আম (মক্কায় অবতীর্ণ)
(০৬:১১৯) আর কি কারণে তোমরা সেসব আহার করবে না, যার উপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে? অথচ আল্লাহ যেগুলোকে তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন তা তো তিনি নিজেই সুস্পষ্ট ও ভিন্ন ভিন্ন করে তোমাদের জন্য বলে দিয়েছেন; কিন্তু সেগুলোও তোমাদের জন্যে হালাল, যখন তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও। অনেক লোক আপন খেয়াল- খুশি মতো না জেনে অন্যকে বিপথগামী করে; তোমার প্রতিপালক সীমালংঘনকারীদের সম্বন্ধে যথার্থই জানেন।
অনেকে আউট-অফ কন্টেক্স আল-কোরআনের আয়াত তুলে ধরে হারাম নয় এমন কিছুকে ঢালাওভাবে হারাম বানাবার জন্য তর্কে লিপ্ত হন। এরূপ ক্ষেত্রে এই আয়াত গুলোর প্রকৃত বক্তব্য বোঝার ক্ষেত্রে সবারই অসুবিধা হতে পারে। বিশেষ করে এগুলোকে ব্যবহার করে কেউ যখন ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে এনে সেটাকে কথার মারপ্যাচে তাদের মত করে সাজানোর অপচেষ্টা করেন, তখন যারা আল-কোরআন সম্পর্কে ভালভাবে অয়াকিবহাল নন এমন অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতে পারেন।
আল্লাহতায়ালা রাসূল (সাঃ) এর উপর সত্যসহ যে কিতাব আল-কোরআন নাযিল করেছেন তার নির্দেশ অনুসরণ করা এবং সেই অনুযায়ি বিচার ফয়সালা করাই তাঁর একমাত্র মিশন ছিল এবং কোনরূপ বাড়াবাড়ি না করে প্রত্যেক প্রকৃত বিশ্বসীরও তাই হওয়া উচিত। ভাই ও বোনেরা, আসুন তবে এবার আমার বা অন্য কারো কথা নয়, ধৈর্য সহকারে নিম্নে প্রদত্ত মহান আল্লাহতায়ালার বাণী-গুলো মনযোগ দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করি। হালাল/হারাম নির্ধারনের ব্যপারে এই কিতাবের মৌল নীতি ও নির্দেশের বাহিরে অতিরক্তি বাড়িয়ে বলার কোন এখতিয়ার রাসূল (সাঃ) এর ছিল না এবং এমনটি যে তিনি করতেই পারেন না, নিচের আয়াতগুলো সেই সাক্ষ্যই বহন করছে। শুধু তাই নয়, অনেকেই যে অনেক কথা বানিয়ে বলবার অপচেষ্টা করবে সে ব্যাপারেও সাবধান করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাসীদের জন্য এই কিতাবের বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় অর্থাৎ অপ্রাসঙ্গিক কোন (৪৫:০৬-১১), (৭৭:৪৯-৫০) হাদিছ অর্থাৎ কথা, গল্প, বানানো খবরে বিশ্বাস করাও যে নিষেধ, সেই নির্দেশও এখানে স্পষ্ট-
সূরা আল জাসিয়া (মক্কায় অবতীর্ণ)
(৪৫:০৬) এগুলো আল্লাহর আয়াত, যা আমি তোমার কাছে আবৃত্তি করি যথাযথ রূপে। অতএব, আল্লাহ ও তাঁর আয়াতের পর তারা কোন হাদিছে (কথা, গল্প, খবর) বিশ্বাস স্থাপন করতে চায়?
(৪৫:০৭) প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপাচারীর দুর্ভোগ।
(৪৫:০৮) সে আল্লাহর আয়াতসমূহ শুনে, অতঃপর অহংকারী হয়ে জেদ ধরে, যেন সে আয়াত শুনেনি। অতএব, তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন।
(৪৫:০৯) যখন সে আমার কোন আয়াত অবগত হয়, তখন তাকে ঠাট্টারূপে গ্রহণ করে। এদের জন্যই রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।
(৪৫:১০) তাদের সামনে রয়েছে জাহান্নাম। তারা যা উপার্জন করেছে, তা তাদের কোন কাজে আসবে না, তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে তারাও নয়। তাদের জন্যে রয়েছে মহাশাস্তি।
(৪৫:১১) এটা সৎপথ প্রদর্শন, আর যারা তাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে, তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সূরা আল মুরসালাত (মক্কায় অবতীর্ণ)
(৭৭:৪৯-৫০) সেদিন মিথ্যারোপকারীদের দুর্ভোগ হবে। অতঃপর কোন কথায় তারা এরপর বিশ্বাস স্থাপন করবে?
সূরা আল হাক্বক্বাহ (মক্কায় অবতীর্ণ)
(৬৯:৪০) নিশ্চয়ই এই কোরআন একজন সম্মানিত রাসূলের আনীত।
(৬৯:৪১) এবং এটা কোন কবির কালাম নয়; তোমরা কমই বিশ্বাস কর।
(৬৯:৪২) এবং এটা কোন অতীন্দ্রিয়বাদীর কথা নয়; তোমরা কমই অনুধাবন কর।
(৬৯:৪৩) এটা বিশ্বপালনকর্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ।
(৬৯:৪৪) সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত,
(৬৯:৪৫) তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম,
(৬৯:৪৬) অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা।
(৬৯:৪৭) তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারতে না।
(৬৯:৪৮) এটা খোদাভীরুদের জন্যে অবশ্যই একটি উপদেশ।
(৬৯:৪৯) আমি অবশ্যই জানি যে, তোমাদের মধ্যে কতক মিথ্যা আরোপকারী রয়েছে।
(৬৯:৫০) নিশ্চয় এটা অবিশ্বাসীদের জন্যে অনুতাপের কারণ।
(৬৯:৫১) নিশ্চয় এটা সন্দেহাতীত সত্য।
(৬৯:৫২) অতএব, তুমি তোমার মহান পালনকর্তার নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।
সূরা আল মায়েদাহ (মদীনায় অবতীর্ণ)
(০৫:৪৮) আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববতী গ্রন্থ সমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। অতএব, তুমি তাদের পারস্পারিক ব্যাপার সমূহে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সেই অনুযায়ী ফয়সালা কর এবং তোমার কাছে যে সৎ পথ এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে না। আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব, দ্রুত কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন কর। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে।
(০৫:৪৯) আর আমি আদেশ করছি যে, তুমি তাদের পারস্পরিক ব্যাপার সমূহে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা কর; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাক- যেন তারা তোমাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করেছেন। অনন্তর যদি তার মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখ, আল্লাহ তাদেরকে তাদের গোনাহের কিছু শাস্তি দিতেই চেয়েছেন। মানুষের মধ্যে অনেকেই নাফরমান।
সূরা আন নিসা (মদীনায় অবতীর্ণ)
(০৪:৬৪) বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তার অনুসরণ করা হয়। যখন তারা নিজেদের উপর জুলুম করেছিল, তখন যদি তোমার কাছে আসত এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইত, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও পরম-দয়ালু রূপেই পেত।
(০৪:৭৯) তোমার যে কল্যাণ হয়, তা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে আর তোমার যে অকল্যাণ হয়, সেটা হয় তোমার নিজের কারণে। আর আমি তোমাকে পাঠিয়েছি মানুষের প্রতি আমার রাসূল (পয়গামের বাহক) হিসাবে, আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
(০৪:৮০) যে রাসূলের অনুসরণ করবে সে আল্লাহরই অনুসরণ বা আনুগত্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি তোমাকে (হে মুহাম্মদ), তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।
দেখা যাচ্ছে যে, (০৪:৬৪) নং আয়াতের এই অংশটিতে (বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তার অনুসরণ করা হয়) স্পষ্ট ভাষায় আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী রাসূলের (সাঃ) অনুসরণ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এরসাথে (০৪:৮০) নং আয়াতটি মিলিয়ে পড়লে বুদ্ধিমানদের জন্য এর প্রকৃত বক্তব্য অনুধাবন করা তো খুব একটা কঠিন হবার কথা না। বিশেষ করে মক্কায় অবতীর্ণ আয়াত সমূহ লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, রাসূলকে (সাঃ) আল্লাহতায়ালার কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করার জন্য নির্দেশ দিয়ে প্রথমত বিশ্বাসীদের মন ও মগজকে সেভাবে প্রস্তুত করে তোলা হয়েছে। সুতরাং সেগুলোর সাথে এই (০৪:৮০) আয়াতের বক্তব্যটি মিলিয়ে পড়লে সহজেই বুঝে নেয়া যায় যে, যেহেতু প্রথমত রাসূলকে (সাঃ) আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ অনুসরন করতে বলা হয়েছে, তাই এই অনুসরন করা সম্বন্ধে রাসূলের (সাঃ) কোন বক্তব্য কখনই আল-কোরআনের নির্দেশকে অতিক্রম করার অধিকার রাখে না।
সূরা আল-আনফাল (মদীনায় অবতীর্ণ)
(০৮:২০) অর্থ- হে বিশ্বাসীরা! আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর এবং তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না যখন তোমরা তাকে (তার কথা) শুনতে পাও।
সূরা আল আহযাব (মদীনায় অবতীর্ণ)
(৩৩:২১) অর্থ- নিশ্চয় তোমাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে, যে কারো জন্যই যিনি আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে,
(৩৩:৩৬) আর একজন মুমিন পরুষের পক্ষে উচিত নয় এবং একজন মুমিন নারীরও নয় যে, যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন সে ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কোন পছন্দ থাকে। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে, সে তো প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে রয়েছে।
সুতরাং (৩৩:২১) নং আয়াতের বক্তব্য অনুসারে সেই সময়ে উদ্ভুত যে কোন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন সাপেক্ষেই রাসূলের (সাঃ) উপস্থিতিতে তাঁর যে কোন নির্দেশ/পরামর্শ মানা তাঁর সাথে অবস্থানরত মুসলিমদের জন্য 'ওয়াজিব' হিসেবে একদিকে যেমন অবশ্য কর্তব্য ছিল। অপরদিকে তেমনি (০৮:২০) তাঁর কথা নিজ কানে শুনেও অবজ্ঞা করে এর বিপরীত কিছু করাটা চরম বেয়াদবিই হত। (৩৩:৩৬) নং আয়াতের বক্তব্য অনুসারে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রেরিত রাসূল অর্থাৎ পথপ্রদর্শক ও সুসংবাদদাতার মাধ্যমে তাঁর কিতাবে যে ফয়সালা জানিয়ে দিয়েছেন তা সর্বকালের জন্যই শাশ্বত ও সার্বজনিন এবং অমান্য করা বা কম-বেশি করা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে থাকারই সামিল।
১০) সূরা ইউনুস (মক্কায় অবতীর্ণ)
১৫) অর্থ- আর যখন তাদের কাছে আমার প্রকৃষ্ট আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন যাদের আশা নেই আমার সাক্ষাতের, সে সমস্ত লোক বলে, নিয়ে এসো কোন কোরআন এটি ছাড়া, অথবা একে পরিবর্তিত করে দাও। তাহলে বলে দাও, একে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তিত করা আমার কাজ নয়। আমি সে নির্দেশেরই আনুগত্য করি, যা আমার কাছে আসে। আমি যদি স্বীয় পরওয়ারদেগারের নাফরমানী করি, তবে কঠিন দিবসের আযাবের ভয় করি।
১৬) অর্থ- বলে দাও, যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমি এটি তোমাদের সামনে পড়তাম না, আর নাইবা তিনি তোমাদেরেকে অবহিত করতেন এ সম্পর্কে। কারণ আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না?
মহান স্রষ্টার বাণীই আমার জন্য যথেষ্ট। যেখানে আলে-কোরআনের নির্দেশ পরিবর্তনের ক্ষমতা স্বয়ং রাসূলকেই (সাঃ) দেয়া হয় নাই। সেখানে আল-কোরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সহী হাদিছ ছাড়া আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের নামে চালানো অন্য কারো বাণীকে স্রষ্টা প্রেরিত ঐশী বাণীর উপরে প্রাধান্য দেবার আমার কোনই প্রয়োজন নেই। কারন যখন মানুষ আল-কোরআনের নির্দেশকে উপেক্ষা করে অন্য কারো নির্দেশ, কথা ও কর্মকে বেশি প্রাধান্য দেবে, তখনই তারা গোমরাহি ও বিভেদে লিপ্ত হয়ে পড়তে বাধ্য। কাজেই কোন হাদিছের বক্তব্য যদি আল-কোরআনে প্রদত্ত কোন বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক বা বিপরীত ধর্মী হয়, তাহলে সে সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বনের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।
অনেকে আল-কোরআনের আয়াত খন্ডিতভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহতায়ালার ঘোষিত হালাল/হারামের বিধানকে ছাপিয়ে অতিরঞ্জিত বিধি নিষেধ আরোপ করে তা রাসূলের (সাঃ) নামে চালাবার প্রয়াশ নিয়ে থাকে। যা শুধু গোনাহের কাজই নয়, বরং স্বয়ং স্রষ্টা মানুষের স্বভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ (হালাল/হারামের) যে বিধান দিয়েছেন, তা বাড়ানো বা কমানোর ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। যার সুদূরপ্রসারী ব্যাড-এফেক্ট বড়ই মারাত্মক বৈকি। যেমন অনেকে (৫৯:০৭) নং আয়াতের এই অংশটুকু (রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা) ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে রাসূলকে (সাঃ) হালাল/হারামের বিধানদাতা বানিয়ে নিজেদের অভিরুচি অনুযায়ি মতামত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু এটি এর পূর্বের আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়লে আসল বক্তব্য সহজেই বুঝে নেয়া যায়-
সূরা আল হাশর (মদীনায় অবতীর্ণ)
(৫৯:০৬) আল্লাহ নির্বাসিত ইহুদিদের (বনু-বনুযায়রের) কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, সেজন্যে তোমরা ঘোড়ায় কিংবা উটে চড়ে যুদ্ধ করনি, কিন্তু আল্লাহ যার উপর ইচ্ছা, তাঁর রসূলগণকে প্রাধান্য দান করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।
(৫৯:০৭) আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।
*সূরা আনফালে গনীমত (যুদ্ধ জেহাদের ফলশ্রুতিতে লব্ধ সম্পদ) ও ফায় (যুদ্ধ বা জেহাদ ছাড়াই শত্রুরা যে সম্পদ ফেলে পালিয়ে যায়) এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই আয়াতে ফায় এর সম্পদের হকদার নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা হকদার নির্দিষ্ট করার নির্দেশ দেবার পর কে কতটুকু পাবে তার ভার রাসূল (সাঃ) উপর ন্যাস্ত করার ইংগিতও দিয়ে দিয়েছেন এবং এই ক্ষেত্রে রাসূলের (সাঃ) এর সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়াকে তাঁরই আনুগত্য করার সাথে তুলনা করে সেই নির্দেশকেই জোরদার করেছেন।
উপরের এই আয়াতগুলোর শর্তমতে আমি একবাক্যে ও নির্দ্বিধায় সেই আহলে হাদিছ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত হতে রাজি নই, যারা হালাল/হারাম নির্ধারনের ব্যপারে আল্লাহর কিতাবে প্রদত্ত সুস্পষ্ট বিধানের সাথে সামঞ্জস্যহীন অর্থাৎ অপ্রাসঙ্গিক কোন হাদিছে (কথা, গল্প, খবর) একবাক্যে ও নির্দ্বিধায় বিশ্বাস স্থাপন করে ভ্রান্ত পথের অনুসারী হতে চায়।
হাদিছ গ্রন্থে আল্লাহর বাণী আল কোরআনের সাথে সামঞ্জস্যহীন অনেক কথা ও কিচ্ছা কাহিনী আছে যা কোন বিবেক সম্পন্ন মানুষ অন্ধভাবে গ্রহণ করতে পারেনা। যতই আমার প্রিয় রাসূলের (সাঃ) অকাট্য বক্তব্য বলে চালানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, আল-কোরআনের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক এসব অন্য কোন মানুষের বানানো কোন কিছুরই আমার কাছে গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম। আল-কোরআনের বক্তব্যকে ছাপিয়ে এসব আমার অন্তরকে মোটেই ছুঁতে পারেনি। আল-কোরআনে যা সরাসরি হারাম বলা হয়নি সেই বিষয়কে সরাসরি হারাম মানাটাও গোনাহের কাজ। তবে এমন কোন বিষয় যদি থেকে থাকে যা আল-কোরআনে সরাসরি হারাম হিসেবে ঘোষিত হয়নি, কিন্তু রাসূল (সাঃ) এর সহী হাদিছে সেই সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বনের ইংগিত থেকে থাকে, তাহলে সেই বিষয়টিকে আল-কোরআনে ঘোষিত হারাম বিষয়গুলোর মত হারাম নয়, বরং সেই সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বনে আমি বদ্ধ পরিকর এবং এক্ষেত্রে আমি সর্বদা মধ্যপন্থাই অবলম্বন করি। কারন আমি বিশ্বাস করি যে, চরম পন্থা মানুষকে কখনই শান্তি দিতে পারে না। চরম-পন্থীরা নিজেরা যেমন শান্তি পায়না, তেমনি অপরকেও শান্তি থেকে বঞ্চিত করে। তাই ভাই সাবধান;
"আহলে হাদিছ বা আহলে কোরআন"- এই দুটি দলের কোন একটির মাঝে কেউ আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করলে, সেটা তাদের অভিরুচি। আমি আবারও স্পষ্ট ভাষায় জানাচ্ছি- আল-কোরআন আমার কাছে সবার ঊর্ধে, এরপর আল্লাহর বাণীর সাথে বিন্দুমাত্র সাংঘর্ষিক নয়, রাসূলের (সাঃ) এরূপ হাদিছকে আমি পৃথিবী অন্য সবকিছুর চাইতে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেই এবং মানতে চেষ্টা করি। আশাকরি বিষয়টি পরিষ্কার করতে পেরেছি।
সুতরাং আসুন, আর দেরি না করে 'আহলে হাদিছ বা আহলে কোরআন' নামক দলাদলি দূর করার প্রয়াশ নেই। অযথা কটুক্তি, বাড়াবাড়ি ও বিদ্বেষ ছেড়ে আল্লাহর রজ্জু আল-কোরআন এবং এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাদিছ/রাসূলের (সাঃ) আদর্শকে চিনে ও বুঝে পালন করার জন্য দৃপ্ত অঙ্গীকার গ্রহণ করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১২ বিকাল ৩:৪২