
বর্তমানে একদল বিজ্ঞানী পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি সম্পর্কে নুতন তথ্য দিয়েছেন। ভাসেলডরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর উইলিয়াম মার্টিন এবং গ্লাসগোতে স্কটিশ এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ সেন্টারের প্রফেসর মাইকেল রাসেল এর মতে:- প্রাণ সৃষ্টির আগে কোষের জন্ম হয়। প্রথমে কোষ জীবন্ত ছিল না। এটি মৃত ছিল এবং এর সৃষ্টি হয় আয়রন সালফাইড হতে। বিজ্ঞানীগণ গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, জীবনের সৃষ্টি হয়েছিল সমূদ্রের তলদেশে অন্ধকারে জলমগ্ন ক্ষুদ্র পাথুরে পরিবেশে অর্থাৎ আয়রন সালফাইড পাথরের তৈরি অতি ক্ষুদ্র প্রোকষ্ঠ ইনঅরগ্যানিক ইনকিউবেটরে। তাদের বর্ণনা অনুসারে সতন্ত্র ও সংরক্ষিত কোন স্থানে বা আধারে প্রথমে জীব কোষের গঠন সম্পন্ন হয়। প্রথমে কোষ মৃত ছিল। পরবর্তীতে তা প্রাণের মলিকিউলে পূর্ণ হয় অর্থাৎ কোষে প্রাণ সঞ্চার ঘটে।
প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট প্রজাতির জীবকোষে সেই প্রজাতিটির জন্য নির্ধারিত নির্দিষ্ট সংখ্যক জীন বহিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান থাকে। গতানুগতিক স্বাভাবিক জন্ম প্রক্রিয়ার অধীনে নির্ধারিত স্বাভাবিক জীন বাহিত বৈশিষ্ট্যগুলোর আদান প্রদান ঘটে। ফলে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণীদের মাঝে জেনেটিক নিয়ন্ত্রনের আওতায় একটি নির্দিষ্ট সীমানার অভ্যন্তরেই বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশগত বৈষম্যের কারণে আকৃতি ও প্রকৃতিগত কতিপয় বায়োলজিকাল পরিবর্তন অর্থাৎ সীমানির্দেশিত বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ কারনেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের গায়ের চামড়ার রং-এ ও চেহারায় পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই আমার ও আপনার রং কালা আর প্রিন্সেস ডায়না সাদা। কিন্তু তাই বলে একটি নির্দিষ্ট জীব প্রজাতি থেকে কখনই স্রষ্টা প্রদত্ত নির্দিষ্ট জীন বাহিত বৈশিষ্ট্যের সীমানা অতিক্রম করে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নুতন জীব প্রজাতির জন্ম হয় না। যেমন ধানের বীজ থেকে গম হয় না, কাকের ডিম থেকে কোকিল এবং শিম্পাঞ্জীর পেট বা এইসব জন্তুদেরই কোন পূর্বপুরুষের ঔরশ থেকে মানুষের জন্ম হয় না। এখনও এ ধরনের কোন প্রমাণ মেলেনি, কখনও মিলবেও না।
বিভিন্ন কারণে জীবকোষের মধ্যে কখনো মিউটেশন ঘটলে ত্রুটিপূর্ণ ক্রোমসোম বা জীনের উদ্ভব ঘটতে পারে। আর এই ত্রুটিপূর্ণ জীনের কারণে প্রজননের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির অন্তর্গত কিছুটা ভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতির নুতন এক প্রকার জীবের জন্ম হতে পারে। আবার নিকট সাদৃশ্যের বৈশিষ্ট্যধারী দুটি ভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যে কদাচিত প্রজনন ঘটলে কিছুটা ভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতির সংকর প্রজাতির জীবের জন্ম হয় বটে। কিন্তু দেখা গেছে যে, সংকর প্রজাতির প্রণীদের প্রজনন ক্ষমতা লোপ পাওয়ায় বা অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হওয়ায় স্বাভাবিক বংশবিস্তারের পথরুদ্ধ হয়। ফলে অচিরেই এর বিলুপ্তি ঘটে।
মিউটেশনযুক্ত অস্বাভাবিক ক্রোমসোম বা জীনের কারণে কখনো কখনো বংশগতভাবে ব্যাধিগ্রস্ত বা অস্বাভাবিক মানব প্রজন্মের সূচনা হতে পারে। যেমন-
*ক্রোমসোম ২১ একটি অতিরিক্ত অর্থাৎ এক জোড়ার পরিবর্তে তিনটি থাকলে ‘Down Syndrome’ নামক অস্বাভাবিক শিশু জন্ম নেয়:--জন্মগতভাবে এদের মুখমন্ডল অস্বাভাবিক হয়। দুটি চোখের ব্যবধান বেশী হয় ও চোখের পাতায় ভাঁজ থাকে, নাক চ্যাপ্টা, মুখ কিছুটা খোলা ও হাত, পা এবং হৃদপিন্ড অস্বাভাবিক হয়।
*ক্রোমসোম ১৮ একটি অতিরিক্ত অর্থাৎ এক জোড়ার পরিবর্তে তিনটি থাকলে ‘Edward’s Syndrome’ দেখা দেয়:- এদের মাথা পাশাপাশি চ্যাপ্টা, হাত ছোট ও আঙ্গুলের ছাপ সরল হয়। এরা দুর্বল ও ছোট হয়। এদের মানসিক অপূর্ণতা খুব বেশী হয়। এরকম বাচ্চা এক বছর বয়সেই মারা যায়।
*ক্রোমসোম ১৩ একটি অতিরিক্ত থাকলে ‘Patau Syndrome’ দেখা দেয়:--এদের মানসিক অসম্পূর্ণতা খুব বেশী। দেহের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অঙ্গে সাংঘাতিক ত্রুটি থাকায় এরা জন্মের পরেই মারা যায়।
*সেক্স-ক্রোমসোম X দুইটি ও Y একটি থাকলে 'Kleinfelter’s syndrome' দেখা দেয়:--এদের ক্রোমসোমের সংখ্যা ৪৭। এর মধ্যে অটোসোম ৪৪টি অর্থাৎ (৪৪ টি অটোসোম + X X Y )। এরকম লোকেরা মোটা, হাত-পা দীর্ঘ ও দেহ লোমযুক্ত হয়। বুদ্ধি কম হতে পারে। এরূপ পুরুষেরা শুক্রাণু উৎপন্ন না হওয়ায় সাধারনত অনুর্বর হয়।
*Turner’s Syndrome':- এরূপ স্ত্রীলোকের সেক্স-ক্রোমসোম X একটি কম থাকে। এদের ক্রোমসোমের সংখ্যা ৪৫। এরা খর্বাকৃতির হয়। বর্মের মত বুক, ছোট গৃবা, হাতটা কনুই থেকে কিছুটা বাঁকা থাকে। চোখ, কান, নখ ও হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। এদের যৌন চরিত্র সাধারনত অপরিনত থাকে।
আবার লীথ্যাল বা প্রাণনাশক জীনের উপস্থিতিতে জীবনীশক্তি হ্রাস পায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। যেমন:-
*একটি লীথ্যাল জীন হোমজাইগাস অবস্থায় থাকলে ‘Amaurotic Idioc’ নামক অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়:- শৈশবেই অর্থাৎ ৪-৭ বছর বয়সেই এদের দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। বয়ঃবৃদ্ধির আগেই অন্ধত্বের পাশাপাশি মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। ফলে অচিরেই এদের মৃত্যু ঘটে।
*অন্য একটি লীথ্যাল জীন হোমজাইগাস অবস্থায় থাকলে ‘Icthyosis’ রোগ হয়:- শিশুকাল থেকেই এদের ত্বক মোটা, শক্ত, খোলসযুক্ত ও গভীর খাঁজবিশিষ্ট হয় । এই খাঁজ থেকে রক্তপাত হয় এবং বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটায় এদের মৃত্যু হয়।
*এছাড়াও সেমি-লীথ্যাল জীনের প্রভাবে Huntington’s Chorea, Epilopia, Retinoblastoma ইত্যাদি রোগ হয়।
তবে একই প্রজাতির অন্তর্গত জীবদের মাঝে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত বৈশিষ্ট্যগুলোর আদান প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে স্বাভাবিক জন্ম-প্রক্রিয়ার আওতায় উন্নত বৈশিস্ট্যসম্পন্ন একই প্রজাতির স্বাভাবিক জীব জন্মগ্রহন করে। মানুষের ক্ষেত্রেও প্রজননের মাধ্যমে মাতা ও পিতার মধ্যকার স্বাভাবিক জীনবাহিত মানব-বৈশিষ্ট্যগুলোর আদান প্রদানের ফলে সীমানির্দেশিত বংশগত বিবর্তনের ধারায় স্বাভাবিক নব প্রজন্মের আগমন ঘটে।
এই পৃথিবীতে কতকাল পূর্বে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে তা সঠিকভাবে জানতে পারা না গেলেও অন্ততঃ এটুকু বুঝে নেয়া যায় যে, প্রথম মানব ও মানবী হযরত আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রচনার পূর্বক্ষণে মানুষের সাথে আকৃতি, প্রকৃতি, দৈহিক শক্তি, সক্রিয় ক্ষমতা ইত্যাদি কতিপয় নিকটতর সাদৃশ্যের বৈশিষ্ট্যধারী ওরাংওটাং, গরিলা, শিম্পাঞ্জী, গ্রেট অ্যাপস্, নিয়ানডারথাল ইত্যাদি যেসব জন্তুদেরকে বা তাদের পূর্বপুরুষদের অনেকে মানুষের পূর্বপুরুষ হিসেবে ধারনা করে- ওদের আবির্ভাব ঘটাই স্বাভাবিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে যুক্তিসংগত। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে ও অধীনে গতানুগতিক জন্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বানর প্রজাতি বা পরবর্তী গ্রেটএপসদের পূর্বপরুষের মধ্য থেকেই বিবেকবান মানব জাতির জন্ম হয়েছে এরূপ ভাববার কোন অবকাশ নেই।
এ পর্যন্ত মানবকোষের ক্রোমসোমে তিনশ কোটি জেনেটিক-লেটারস্ আবিষকৃত হয়েছে। মহান স্রষ্টা এই তিনশ কোটির ১% - ১.২% অর্থাৎ একটি, দু'টি বা একশটি নয় বরং ৩ - ৩.৬ কোটি জেনেটিক লেটারস বাহিত "সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মানব-বৈশিষ্ট্যসমূহের বা হিউম্যান জেনম"- এর অধিকারী হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। শধু তাই নয়, এর সাথে "junk-DNA " তথা "Alu elements" এর বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার। এই হিউম্যান জেনম- এর কারণেই মানুষের পূর্বপুরূষ হিসেবে ধারণাকৃত জন্তুদের থেকে মানুষ স্বতন্ত্র জীব হিসেবে পরিগণিত হয়। কোন কোন দিক থেকে যতই নিকটতর হিসেবে প্রতীয়মান হোক না কেন, ঐসব ২৪ জোড়া ক্রোমসোমধারী জন্তুদের মধ্য থেকে ২৩ জোড়া ক্রোমজোমের অধিকারী ও “হিউম্যান জেনম” অর্জনকারী মানব-শিশু কখনও জন্ম নেয়নি এবং নেবেও না। মলিকুলার বায়োলজি, জেনেটিক্স ও জীবাশ্মবিজ্ঞানের বর্তমান অগ্রগতির আলোকে এ ধরণের কোন প্রমাণ এখনও মেলেনি। মানুষ সৃষ্টির জন্য অবশ্যই মানব বৈশিষ্ট্যধারী প্রাণের একক অর্থাৎ জীবন্ত ও পূর্ণাঙ্গ মানবকোষ গঠনই পূর্বশর্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। আর এই জীবন্ত মানবকোষ কেবলমাত্র মহান স্রষ্টার নিয়ন্ত্রিত পরশেই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। সুতরাং মানুষের পূর্বপুরুষ মানুষই। মানুষের পূর্বপুরুষের সন্ধান পেতে হলে ২৩ জোড়া ক্রোমজোমের অধিকারী ও “হিউম্যান জেনম” অর্জনকারী আদি মানবের সন্ধানই করতে হবে।
শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি একই আদি পিতা-মাতার সন্তান-সন্ততি হিসেবে এই পৃথিবীর সব মানবমন্ডলী পরস্পর একই সূত্রে গাঁথা ও পরম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। তাই শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শণ স্বরূপ সকল সৃষ্টির হিত সাধনের জন্য মানুষকে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। কারণ শুধু শক্তি অর্জন করলেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয় না। বরং অর্জিত শুভ শক্তিকে সকল অন্যায় রোধে এবং সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে সঠিকভাবে ব্যবহার করলেই কেবল প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হতে পারে। মহান স্রষ্টা মানুষকে ভাল-মন্দ বিচারের ক্ষমতা অর্থাৎ বিবেক দান করেছেন । বুদ্ধি ও বিবেকের সহায়তায় মহান স্রষ্টার নির্দেশিত পথে থেকে সুচারুরূপে কর্ম সম্পাদন করতে পারলেই একজন মানব সন্তান প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়। আর এই সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমেই কেবল বিভ্রান্তির নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে ইহকালীন ও পরকালীন চুড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব।
মন্তব্য ও তার সাথে দেয়া লিংকগুলো দেখলে ভাল হয়-
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১১ বিকাল ৫:০০