বর্তমান বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে Acquired Immunodeficiency Syndrome সংক্ষেপে (AIDS) এইডস্ও একটি। এই এইডস্ হলো শরীর বা মনের অস্বাভাবিক অবস্থা নির্দেশক লক্ষণসমষ্টি -যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতির কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় আত্মপ্রকাশ করে।
এক ধরনের ভাইরাস ( যার নাম সংক্ষেপে HIV বা Human Immunodeficiency Virus ) এর মাধ্যমে এইডস্ এক জনের দেহ থেকে অন্যের দেহে সংক্রমিত হয়। কোন মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে তাদেরকে HIV+ বলা হয়।
প্রথমত আক্রান্তের দেহে ভাইরাসটি অর্থাৎ এইচআইভি বংশবিস্তার করতে থাকে। এই ভাইরাসের প্রধান কাজ হচ্ছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (virus & immune mediated destruction of key immune effector cell, CD4 lymphocyte) অকেজো করে ফেলা। আক্রান্তের শরীরের রক্তে HIV-RNA এর মাত্রা যত বাড়তে থাকে এবং একই সাথে CD4 lymphocyte এর সংখ্যা যত কমতে থাকে, এইচআইভি-সংশ্লিষ্ট রোগগুলো (HIV-related diseases) দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার হারও তত বাড়তে থাকে। CD4 lymphocyte এর সংখ্যা 200/mm3 এর নীচে নেমে এলে প্রতিষেধক প্রদান করা সত্ত্বেও সংক্রামক ব্যাধিগুলোকে প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রাথমিক অবস্থায় এইডস্- এর উপসর্গগুলো মূলত ব্যকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস ও প্যারাসাইট দ্বারা সংক্রমণের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং যা HIV অর্থাৎ এইডস এর ভাইরাস দ্বারা কারো শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার উপর নির্ভর করে। এইচ.আই.ভি মোটামুটিভাবে দেহের সবগুলো অঙ্গ ও তন্ত্রকেই আক্রান্ত করে। প্রায় সব ধরণের সংক্রামক-রোগই সুযোগমত AIDS রোগীর শরীরে বাসা বাঁধে। এইডস্ আক্রান্ত ব্যাক্তিরা প্রায়শই বিভিন্ন রকম ক্যান্সারে ভোগে যেমন ক্যাপোসিস সারকোমা, সারভাইকাল ক্যান্সার এবং রোগপ্রতিরোধ তন্ত্রের ক্যান্সার অর্থাৎ লিমফোমা। এভাবে অবশেষে এইডস্ (Acquired Immune Deficiency Syndrome) রুদ্রমূর্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে আক্রান্ত মানুষের দেহটি নানা রকম রোগ-জীবাণুর চারণ-ভূমিতে পরিণত হয় এবং অসংখ্য রোগ-ব্যাধিতে জর্জরিত হাড্ডিসার কঙ্কালের রূপ ধারণ করে। চরম শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনা ভোগের পর অবশেষে একদিন সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার পর আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু অনেকদিন (এমনকি বছরের পর বছর) পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারে না। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে ৬ - ৮ সপ্তাহ পর সাধারণ কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে যেমন- জ্বর, দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি ও পেশিতে ব্যথা, গলায় ব্যথা, মুখে ক্ষত, মাথা ব্যথা, অস্বাভাবিক আলস্য বা তন্দ্রাভাব, দুর্বলতা, ওজনহানী ইত্যাদি। সাধারণত ৩ - ৪ সপ্তাহের মধ্যে এই উপসর্গগুলো চলে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে এইডস্-এর প্রকাশলাভের সময়টা অল্প। আবার কারো ক্ষেত্রে অনেকদিন অর্থাৎ ৮ - ১০ বছরের মত লেগে যায়। যাদের ক্ষেত্রে অওউঝ প্রকাশলাভের সময়টা বেশী এবং বিশেষ করে HIV দ্বারা infected কোন নারী/পুরুষ যতদিন পর্যন্ত undiagnosed থাকবে ও চিহ্নিত হবেনা, তাদের দ্বারা HIV সংক্রমণের হারও বেশী হবে।
যত দিন যাচ্ছে এইডস্ মহামারির আকার ধারণ করেছে। ২০০৭ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে এ পৃথিবীতে প্রায় ৩ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে এ মরনব্যাধির ছোবলে ১৯ - ২৪ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার জনের বয়স ১৫ বছরের নীচে। আর এই আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
এইডস্ এর মূল কারণ এইচ.আই.ভি কিভাবে সংক্রমিত হয় তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল-
*HIV দ্বারা আক্রান্ত হলে সাময়িক ভাবে সাধারন কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কিছুদিনের মধ্যেই তা থেকে মুক্ত হয়ে শারীরিক স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় আক্রান্ত ব্যক্তিটি (পুং/স্ত্রী) স্বভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। নিজের অজান্তেই সে প্রথমত তার স্ত্রী/স্বামী-কে সংক্রমিত করে এবং পরবর্তীতে তারই কারণে প্রাণপ্রিয় সন্তানেরাও অনেক ক্ষেত্রেই এই মরণব্যাধির ছোবল থেকে রেহাই পায় না। এখানেই শেষ নয়, বিশেষ করে ফ্রি-সেক্সের দেশগুলোতে লাগামহীন যৌন-জীবনে অভ্যস্ত সেক্স-পার্টনারদের বদৌলতে এই ভাইরাসটি অতিদ্রুত ও সবার অজ্ঞাতেই সমাজ তথা গোটা জাতির ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে।
*HIV+ ব্যক্তির রক্ত অন্য কারো শরীরে সঞ্চালন করলে আর্থাৎ ব্লাড-ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে।
*একই সময়ে একই সিরিঞ্জ দ্বারা অনেকের শরীরে ইনজেক্সন দেয়ার মাধ্যমে অথবা রক্ত পরীক্ষার সময় রক্ত গ্রহণ করলেও এ ভাইরাসটি এক জনের দেহ থেকে অনেকের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
*অবাধ ও অবৈধ যৌন মিলন, সমকামিতা ও অন্যান্য অস্বাভাবিক যৌন কর্মের দ্বারা ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।
*HIV আক্রান্তদের মাড়ির ক্ষত হতে নিঃসৃত রস মিশ্রিত লালা, দেহের ক্ষত হতে নিঃসৃত রস ও মাতৃদুগ্ধ দ্বারাও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
*সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আক্রান্ত মা হতে সন্তানের দেহে এই ভাইরাসটি সংক্রামিত হতে পারে।
*বর্তমানে মাদকাসক্তি একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, যা সমাজ তথা গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মাদকাসক্ত অবস্থায় এবং নেশার চাহিদা মেটাতে গিয়ে একজন মানুষ বিবেকশুন্য হয়ে যায়। তখন সে অতি সহজেই চুরি, ডাকাতি, খুন, ছিনতাই, জেনা ও ব্যভিচার সহ নানা রকম অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। ফলে একদিকে যেমন সমাজের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে, তেমনি লাগামহীন অবৈধ সম্পর্ক এবং একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে একই সময়ে অনেকে মাদক গ্রহণের ফলে এইডস্ সহ নানা রকম সংক্রামক রোগের প্রকপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
দৈনন্দিন পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রের স্বাভাবিক কাজকর্ম ও মেলামেশার মাধ্যমে, এমন কি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বা কাপড় চোপড়ের মাধ্যমেও এই ভাইরাস সংক্রামিত হয় না। তাই অযথা ভয় পেয়ে দূরে ঠেলে না দিয় এইডস্ রোগীদের সাথে স্বাভাবিক ও বন্ধুসুলভ আচরণ করাই মানবতার দাবি।
এখানে দেখুন- 'এইডস্' প্রতিরোধে আমাদের করণীয়-
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১২ দুপুর ২:০৬