জুন ২০১৭ এর কোনো একদিন।
রাঙ্গামাটির স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিধ্বসের কিছুদিন পরের কথা।
খাবার বিতরন চলছে, রাঙ্গামাটির উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে।
পাশেই কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা। সেই চেয়ারগুলোতে শুয়ে এক শিশু একমনে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের খেলনা গাড়ী চালাতে ব্যস্ত। যে কেউ খেয়াল করলেই উপলব্ধি করতে মোটেও দেরী হবে না যে, আশে পাশের মানুষ বা খাবারের আয়োজনের দিকে তার মোটেও নজর নেই। তার সমস্ত মনোযোগ জুড়ে রয়েছে ছোট্ট এক প্লাস্টিকের খেলনা গাড়ী।
শিশুটির একাগ্রতা নজরে পড়ে আশ্রয়কেন্দ্রের এক ভলান্টিয়ার্স, শাফিনের।
ইউল্যাবে পড়াশোনার সুবাদে ঢাকায় থাকলেও শাফিনের বাড়ী রাঙামাটিতে। আত্নীয়-স্বজন, শৈশবের লেখাপড়া, বন্ধু-বান্ধব সব কিছু রাঙ্গামাটি কেন্দ্রিক। তাই রোজার বন্ধে সে রাঙামাটিতে নিজের পরিবার আর বন্ধুবান্ধবের সাথেই দিন কাটাতে এসেছিল। পরে ভুমিধ্বসের ভয়াবহতায়, তার মতো আরো অনেকের সাথেই যোগ দিয়েছে ভলান্টিয়ার্স হিসেবে, বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে।
আরো কিছুক্ষণ দেখার পরে, ধীর পায়ে শাফিন তার কাছে এগিয়ে যায়।
নিঃশব্দে পাশে বসে পড়ে।
মনোযোগ দিয়ে খেলায় ব্যস্ত থাকলেও শিশুটি কিছুক্ষণের মধ্যেই শাফিনের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। কিন্তু কোন ভাবান্তর নেই। আগের মতোই প্লাস্টিকের চেয়ারে উপুড় হয়ে শুয়ে গাড়ী চালাতে থাকে।
একটু সময় নিয়ে শাফিন তার সাথে আলাপচারিতা শুরু করলো।
নাম, বাবার নাম, বাড়ী কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
এক পর্যায়ে জানতে চাইল,
- “এই গাড়িটা কার ?”
- “এইটা আমার গাড়ী।” শিশুটি উত্তর দেয়, প্রশ্নকর্তার দিকে না ফিরেই।
- “তুমি এখানে কেন, তোমাদের বাড়িঘরের কি হইছে?”
- “আমার ঘর ভাইঙ্গা গেছে। স-অব কিছু নষ্ট হইয়া গেছে, আমার ঘরের। কিন্তু আমি আমার গাড়ী বাচাইছি।” যেন শিশুটি কোন এক দৈব বলে জানতো - অনাগত প্রশ্ন কি হতে পারে। আর তাই, প্রশ্ন করার আগেই জানিয়ে দেয় কিভাবে সে তার প্রিয় গাড়িটাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে।
পুরো আলাপচারিতায় শিশুটি একবারের জন্যেও শাফিনের দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না। মাথা নিচু করে, নিবিষ্ট মনে গাড়ী চালাতে চালাতেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়। তারপরে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার গাড়ীকে নিয়ে। যে গাড়ীটিই তার কাছে এখন সবকিছু। যার সাথে জড়িয়ে আছে ফেলে আসা ঘরবাড়ী কিংবা শৈশবের মধুর স্মৃতি। কে জানে, এমনকি পরিবারের প্রিয় কোনো সদস্যও।
কথা বাড়ানোর মতো আর কিছু খুঁজে পায় না, শাফিন।
মন ভারী হয়ে উঠে। দৃষ্টি সরিয়ে নেয় দূর পাহাড়ের অস্পষ্ট সবুজের দিকে।
হাতের কাছেই লাইনে দাঁড়ানো নারীপুরুষ কিংবা খাবার বিতরণে ব্যস্ত অন্য ভলান্টিয়ার্সদের কেউ ব্যাপারটি খেয়াল করে না। খেয়াল করার উপায়ও নেই তাদের। কিভাবেই বা তাঁরা জানবে যে, এই মাত্র এক শিশুর কাছ থেকে মমত্বের এক অবিস্মরণীয় উদাহরণ শিখেছে এই তরুণ।
ছবিঃ শাফিন মাহামুদ চৌধুরী প্রিয়।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৯ সকাল ১০:৩৩