যতই সময় গড়াচ্ছে, ব্যাপারটা ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের দুই বাড়ি পড়েই সামীরদের বাড়ি। বাড়ি বলতে বিশাল প্রাসাদ। শিবলী-সামীর দুই ভাই। তাদের পূর্ব-পুরুষ জমিদার ছিলেন। অন্তত তারা তাই বলে। প্রাসাদটি সেই সূত্রেই তাদের কাছে।
যাইহোক, ঘটনা হচ্ছে, তাদের বাড়ির সামনে সকালবেলা থেকেই এক মেয়ে বসে আছে। অচেনা অজানা এক মেয়ে বাসার সামনে বসে আছে, এ নিয়ে তো কৌতূহল হবেই, তার চেয়ে বেশি হবে কোলাহল। তাই হচ্ছে।সেই সকাল থেকেই সামীরদের বাসার সামনে মানুষ জড়ো হয়ে আছে। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল। মাঝখানে, দুপুরে মানুষ কম ছিল, বাসা থেকে খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে এখন আবার জড়ো হয়েছে তামাশা দেখতে। মেয়েটিও মুখ খুলছেনা।সকালে যা একটু খুলেছিল, এখন মুখ বন্ধ। তার কথার মূল কথা যা বুঝ গেল তা হচ্ছে, সামীরের সাথে তার প্রেমের সম্পর্কে ছিল। সে তাকে বিয়ের কথা বলে রিলেশন করে। এখন সে অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক করে এবং তাকে এড়িয়ে চলে। বুঝাই যাচ্ছিল যে প্রেমের সম্পর্কটা কতদুর গড়িয়েছে। কিন্তু যাকে নিয়ে এতো সমস্যা, তার ঘর ভিতর থেকে বন্ধ এবং ঘটনাক্রমে তাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে সবার চোখের আড়ালে। সে এখন আমাদের ঘরে। চুপচাপ শান্ত হয়ে আরাম চেয়ারে বসে উপন্যাস চবকাচ্ছে।
আমার বাবা বুঝতে পারছেন না কি করবেন। তিনি ঘরের এমাথা থেকে ওমাথায় জোড়ে জোড়ে হাটছেন। আসলে কিছু করার নেই। সামীরকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া যাবেনা। হাজার হোক পাশের বাড়ির ছেলে বিপদে পড়ে এসেছে। আবার কেউ যদি জেনে যায় যে সামীর আমাদের ঘরে, তাহলে আমাদের ঘরের আশেপাশেও লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। এই চরম উভয় সঙ্কটের মাঝে আমার মা নামাজের চকিতে। তিনি বসে বসে তসবীহ পড়ছেন, বিপদ মুক্তির জন্য। তবে আদতেই বিপদ মুক্তি হবে কিনা তা একমাত্র আল্লাহই জানেই। মেয়েটা যে জায়গা ছেড়ে নড়ছেনা।
লোকে বলাবলি করছে, এ কেমন বখাটে মেয়েরে বাবা, আরেক ছেলের বাড়ির সামনে পড়ে আছে।কেউ কেউ আবার বলছিল, মেয়েটার আর কিই বা করার ছিল, হয়তো শারীরিক সম্পর্কও করে ফেলেছিল।
আর আমি যে বসে বসে তামাশা দেখছি তা নয়। সমস্যা আমারোও একটা আছে। এই অচেনা অজানা মেয়েটা আর সবার কাছে হলেও আমার কাছে অচেনা নয়।
মেয়েটির নাম শাহীনা। সামীরের সাথে তার সম্পর্কও ছিল। এমনকি কয়েকদিন আগে আমি তাদের দেখা করার ব্যবস্থা করে দিসি। কথা বলার জন্য। আর আমি বাহিরে থেকে পাহাড়া দিতাম। আর মাঝে মাঝে ভিতরে যখন চকচক শব্দ হতো, তখন হাহুতাশ হত।
তাদের প্রেমের উপন্যাসের সূচনাটা হয়েছিল, রাস্তার পাশের চায়ের টোঙয়ে। শাহীনারা থাকতো আমাদের গ্রামের পাশের একটা ছোট গ্রামে।দু'গ্রামের মাঝে একটি রাস্তা। মেয়েটি কোনো কারনে প্রায়ই এ রাস্তা দিয়ে হেটে যেত। আমরা চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার হাটা দেখতাম।নিজেকে নচিকেতা ভাবতাম আর সে নীলাঞ্জনা।তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে গরম চা একসাথে মুখে ঢুকিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলতাম তার ইউত্তা ছিলনা
মেয়েটি অতি সুন্দরী ছিলনা। অতি সাধারন মেয়ে। তবে তার চেহারায় যেন কি একটা ছিল। এসব মায়াকাড়া মেয়েদের কখনোও বয়ফ্রেন্ডের অভাব হয় না। এই মেয়েরো এরকম এক বয়ফ্রেন্ড বের হল। আর মেয়েটা সম্ভবত তার সাথেই দেখা করতে যায়। আমাদের সবার মন ভেঙ্গে গেল। আঙ্গুর ফল টক। তাই আমরাও মেয়ের বিভিন্ন দোষ বের করে চা খাওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগ দিলাম।
হঠাৎ একদিন হাটা বন্ধ। ধরে নিলাম বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আসতে পারছে না। কিন্তু না, বন্ধু পাভেল খোজ খবর নিয়ে বলল, দোস্ত, হয়ে গেছেতো। আমরা বলি, কি হয়ে গেছে? বিয়ে? "আরেহ, না, ব্রেকআপ হয়ে গেছে।"
একি কান্ড, সেই দিন না তারা দেখা সাক্ষাত করলো! আজিব ব্যাপার।মেয়েদের চেনা বড় দায়।
সামীর বলল, দোস্ত! চা তো আজকে পানি পানি লাগতাছে।
- কই নাতো!
- হ লাগতাছে।
- কিরে তোরে রোগে-টোগে ধরে নাই তো। রোগ হলে সবকিছু বিষাদ লাগে।
- আমারোও তাইলে রোগেই ধরছে।
- তোর আবার কোন রোগ?
দোস্ত আমার উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, প্রেমরোগ।
সাথে সাথে সবার হাসি ঠাট্টা আর টিপ্পনি কাটা শুরু হয়ে গেল।
আমি বললাম মানুষ প্রেমে পড়লে সবকিছু মিস্টি লাগে, আর তোর কিনা পানি পানি লাগে। তাও ভাল, টক তো লাগতাছেনা।
সেদিন সন্ধায় বাড়ি ফেরার পথে অনেক কথাই মনে হল। মেয়েটাকে আমি নিজের প্রেমিকা হিসেবে কল্পনা করতে লাগলাম।
পরের দিন সামীর আর আমি একসাথে কলেজে যাই।প্রতিদিনই যাই। তবে যাওয়ার পর আমি আর তাকে খুজে পাইনা, কোনদিনও না। কিন্তু সেদিন সে আমার সাথে সারাক্ষন ছিল। এমনকি টিফিনের সময় নিজের টাকায় চানাচুরের দোকান থেকে চনাচুর এনে আমাকে খাওয়াল। তারপর যখন কলেজ শেষ হলো তখন সে আমাকে বলল,দোস্ত, একটা কাজ করতে হবে।
- কি কাজ?
- তুই তো এলাকায় আমাদের চেয়ে ভালো হিসেবে পরিচিত, তাই কাজটা একমাত্র তুই করতে পারবি।
- আরে বলনা কি কাজ!
- একটু ঝুকি নিতে হবে এই আর কি।
- আরে ধুর! বলবিতো আগে!
- শোন, তোরে শাহীনার সাথে দেখা করতে হবে।
- তারপর? অকে গিয়ে বলতে হবে যে তুই অকে পছন্দ করস?
- হ।
- এ আর এমন কি!
- ব্যাপারটা যেইরকম সহজ মনে হইতাছে, আসলে সেইরকম না।
- কেন?
- ওদের গ্রামে যাওয়া লাগবে। ওদের গ্রামের ছেলেরা অর সাথে আমারে কথা বলতে দেখলে ঝাড়ি দিব। তাই তুই যাবি।
কি আশ্চর্য! সামীর কথা বললে ঝাড়ি দিবে, আর আমি কথা বললে দিবে না, তারমানে তারা ভাবতেই পারেনা আমি শাহীনাকে প্রেম নিবেদন করতে পারি।
যাইহোক, গেলাম তাদের গ্রামে । যাওয়ার আগে পরিপাটি হয়ে গেলাম। কে বলবে আমি আরেকজনকে সাহায্য করার জন্য যাচ্ছি।
তাকে খুজে পেলাম কিভাবে অর্থাৎ তার সাথে দেখা করতে গিয়ে কত কাঠ খর পুড়াতে হয়েছে সেকথা নাহয় বাদ থাক। আসা যাক, কি কথা হয়েছে দেখা হওয়ার পর-
তেমন কিছু বলিনি। মুখ ফুটে বলতে চেয়েছিলাম নিজের কথা, নিজের মনের কথা। শুধু বলেছি, তোমাকে সামীর ভালোবাসে।
সে একবার হেসে বলল, আপনি একথা বলার জন্য এখানে এসেছেন? আমি আরোও ভাবলাম .........
- কি ভাবলে?
উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। আর কোন কথা বের হল না তার মুখ থেকে। হাসিও বন্ধ হয়ে গেল।শুধু একবার বলল, উনাকে আমি চিনিনা।
আমি সেখান থেকে চলে এলাম, রাস্তার আসপাশ হতে ক্রুদ্ধ কিছু দৃস্টি নিয়ে।
বাসায় ফিরে এলাম সেদিন অনেক রাত করে। কেন এতো দেরি হল কেউ জানেনা। আমি নিজেও জানিনা। মা বলল, তোর সাথে সামীর দেখা করতে এসেছিল।
আমি চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কানে বাজতে লাগলো সেই মনোমুগ্ধকর হাসির শব্দ।
পরদিন শোনা গেল, শুধু আমি নয়। আমার বন্ধু মহল থেকে আরোও তিন চার জন গিয়েছিল অই গ্রামে। এবং একজন নাকি মার খেয়ে এসেছে।
যাবেই তো, না যেয়ে কি করবে তারা? ঘরের লক্ষী পায়ে ঠেলে দিবে? অবশ্যই নয়।
তবে অসব খবর শুনেও সামীরের মুখের রেখা পাল্টালোনা, যেমন ছিল তেমনই আছে। সামীর আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কি বলল সে?
- বলল, আমি উনাকে চিনিনা।
- তাহলে আমিই যাবো, চিনিয়ে দিয়ে আসি।
সামীরের মুখে ক্রুর হাসি। আমার কাছে সে হাসি মানুষের মনে হলনা। কিসের জন্য?
হয়তো হিংসা। সে কিভাবে আমাকে দিয়ে বলে ফেলল। অথচ আমি এখনোও আমার বন্ধুদেরই বলতে পারিনাই।
পরদিন চিনিয়ে দিয়ে আসলো আমার বন্ধু সামীর। এবং হয়তো সাথে সাথেই প্রেম হয়ে গেল। আমি ঠিক জানিনা। আমার জানার আগ্রহই হইনি যখন আমি বুঝে গেছি আমাকে দিয়ে হবেনা।
আনেকদিন, প্রায় কয়েকমাস পর সামীর আবার আমার কাছে আসল। বলল, আমি শাহীনার সাথে দেখা করব। তোকে পাহাড়া দিতে হবে। কেন জানি আমি রাজি হয়ে গেছিলাম সেদিন। হয়তো তাকে একনজর দেখতে পাব বলে।
সেদিনের পর আরোও অনেকবারই গেছি। এবং দেখেছি তাকে। সেও হয়তো আমার দিকে তাকিয়েছিল দুএকবার ভুল করে। তবে এটুকুতেই আমি খুশি ছিলাম না।
একদিন তাকে পেলাম রাস্তাতে, কোনো এক জায়গায় যাচ্ছিলাম তখন। আমাকে দেখার সাথে সাথেই থেমে গেল, ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
আমি কিছুই বলিনাই, শুধু ছোট একটা হাসি দিলাম, মানে যা ভাবার ভেবে নাও। সে আমাকে চোপ দেখে বলল, আচ্ছা আপনাকে দেখলে কেন শুধু মনে হয় আপনি আমাকে পছন্দ করেন? আসলেই কি করেন?
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মুখে বললাম, না, না, তা কেন হবে!
- ও, আমি আরোও ভাবলাম......
- কি ভাবলা?
- না কিছুনা।
-তুমি কি শুধুই ভাবো?
মেয়েটি হিহিহি করে হাসলো।
আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো, আমি একে হারালাম, চিরতরে।
শাহীনা চলে যাওয়ার পর কোথায় যাওয়ার কথা ছিল তা ভুলে বাড়ি ফিরে এলাম। পরেরদিন আবার সেখানে গেলাম, অর্থাৎ আমার গন্তব্য পথে। ফিরে এসে শুনি শাহীনা আমার খোজ করেছিল। তার পরেরদিন আমি তাদের গ্রামে গেলাম। ভাগ্যবসত তাকে রাস্তাতেই পেয়ে গেলাম। সে আমাকে দেখেই বলল, দেখ ভাইয়া, সামীর আর আমার সাথে যোগাযোগ করছেনা।। শুনলাম সে নাকি অন্যকোন মেয়ে সাথে ঘুরে বেড়ায়।
আমি বললাম, জানিনাতো এমন কিছু।
- ভাইয়া আমি অকে ছাড়া বাচবোনা।
- কেন বাচবেনা ? আগে কি ও ছিল? তখন কি করছিলা?
- তুমি বুঝতেছনা , আমাদের ভালোবাসা সবটুকু সিরিয়াস।
- তুমি কি তাই মনে কর?
শাহীনা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। সে কি বলবে তা বুঝতে পারছে না।
তারপর চোখ নামিয়ে আমাকে বলল, এখন আমি কি করব? আমার বাবা মা এই সম্পর্কের কথা জানে। জানিনা তাদের কি বলব।
আমিও চুপ করে রইলাম
সে আবার বলল, আমার বাবা জানতে পারলে ঘর থেকে বের করে দেবে। আমারদের গ্রামের সবাই জানে এই সম্পর্কের কথা।
সে আমাকে কিছু না বলেই আমাকে সামনে রেখে চলে যেতে লাগলো।
- শাহীনা। আমি তাকে পিছন থেকে ডাক দিলাম। সে পিছন ফিরে আবার আমার দিকে মুখ করে দাড়ালো। আমি তাকে বললাম, আমি তোমাকে ভালবাসি।
বলার পর মনে হল পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। গাছপালা পশুপাখি সব তাকিয়ে আছে আমাদের দুজনের দিকে। কিন্তু সে......
সে আমার দিকে ক্রুর দৃস্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে আবার নিজের পথে হেটে গেল।
আমার মনে হল, আমি অনেক বড় একটা কাজ করে ফেলেছি। আমার বুক থেকে যেন দেড় মন ওজনের পাথর নেমে গেল। ও তখন যাই ভাবুক, আমি তো বলেছি। এখন যদি তার বাবা ঘর থেকে বের করে দেয় তবে...
তবে আমি তাকে বাসায় নিয়ে আসবো। যেভাবেই হোক।
তবে আমি বুঝিনি যে এমন এক সময় আসবে যখন আবেগকে সরিয়ে স্বার্থকে মেনে নিতে হবে, স্বার্থকে আকড়ে ধরতে হবে। আজই সেদিন। আজ যখন জানালার গ্রিলের ফাকে তাকিয়ে তার মুখন দেখলাম, হাল্কা দুঃখ হল, হাল্কা নয়, প্রচন্ড। কিন্তু মুখ হাসি হাসি করে আছি কেউ যেন না বুঝে। এই কেলেংকারিতে আমি জড়াতে চাই না। আমি কে তার? কেউনা। সেকি আমার বাসার সামনে বসে আছে? না। সেতো সামীরকেও ভালোবাসেনি। সামীরের বাবার সম্পদের প্রেমে পড়েছে। তাই আমি আর এগিয়ে যাবনা তার দিকে। ইতিমধ্যে সাংবাদিকরাও এসে পড়েছে। বাহিরে তাই কোলাহলের মাত্রাটাও বেড়ে গেছে। ভিতরে রয়েছি আমি, আর সামীর। দুই বিশ্বাসঘাতক।
পুনশ্চঃ অনেক দিন আগে একটা নিউজ পেপারে এইরকম একটা হেডলাইন দিয়েছিলঃ প্রেমিকের বাড়ির সামনে প্রেমিকার অনশন
বাকি সবটুকুই কল্পনা প্রসুত।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:০৩