মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড মিজানুর রহমানকে নিয়ে এখন অনেকেই ভাবছেন। সম্প্রতি কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনার কারনে তার সুডো নিরপেক্ষতার ধব্জাটা খসে পড়েছে। বিশেষ করে তার কিছু মন্তব্য বর্তমান রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সাফাই ছাড়া আর কিছু না। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারন না করতে, তিনি আমাদের সবক শেখাবার চেষ্টা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আইনের অধ্যাপক নিজে তার শ্রেনীকক্ষে যদি তার ছাত্রদের শিখিয়ে থাকেন অন্যায়ের কাছে কিভাবে মাথা নত করতে হয় তাহলে অবাক হবো কিভাবে? কারন সে কথাই তো তিনি দেশবাসীকে শিখাতে চাই। তার এই সবকের প্রথম ছাত্র লিমন। বেশকিছু দিন আগে হেফাজতের উপর পুলিশি নির্যাতন নিয়ে তাকে কথা বলতে শুনিনি। উলটো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন যখন বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তখন এই প্রফেসর আমাদের বলেছেন উলটো কথা।
তার আওয়ামী লীগ প্রীতির ব্যাপারটা আর ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এটাও এতদিনে দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার, আমাদের বড় দুই দল সাংবিধানিক পদ থেকে দারোয়ানের পদ পর্যন্ত দলীকরনের ব্যাপারে সর্বাদাই একে অপরেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করে আসছে। সেদিক থেকে মানবাধিকার কমিশনে সাচ্চা দলীয় লোক না বসিয়ে উপায় ছিল কিনা আমার জানা নেই। নির্বাচনের বছরে আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধ সকল মত ও দলকে নির্যাতন চালাবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটা তার কাজের মধ্যেই ইভিডেন্ট। ঠিক একি সময়ে মানবাধিকার কমিশনের এই চেয়ারম্যানকে আবারো তিন বছরের জন্য স্বপদে বহাল রাখার কথা ভাবছে । এটা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বর্তমান চরিত্র থেকেই আমরা যা বুঝতে পারছি তাহল মানবাধিকার কমিশন আর দুর্নীতি দমন কমিশন এই দুটোকে যতটা দুর্বল করে রাখা যায় অন্যভাবে বললে যত দলীয় স্নেহধন্য ব্যক্তিদেরকে এই কমিশনের কর্তাব্যক্তি করা যায় ততই চলমান অন্যায় অবিচার চালাতে সুবিধা হবে শাসক শ্রেনীর। নিকট অতীতে ক্ষমতাসীনদের এই কৌশল কাজে দিয়েছে বলেই বিশ্বাস করে দেশের রাজনৈতিক সচেতন নাগরিকরা।
আমাদের মানবাধিকার কমিশনের আর যাই থাকুক বিচার করার অধিকার নেই। কিন্তু বিচার চাওয়ার বা পাওয়ার ক্ষেত্রেও যে এই কমিশনের কোন ভূমিকা নেই তা এখন পরিষ্কার। ক্রসফায়ারের নামে বহু হত্যাকান্ড ঘটে গেছে আমাদের দেশে। এগুলোর প্রায় বেশীর ভাগই দুটো কারনে ঘটেছে, প্রথমত রাজনীতির ভিন্নমত খতম এবং দ্বিতীয়ত ,দুর্নীতি পরায়ন আইন শৃংঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা অপব্যবহার করার কারনে । সম্প্রতি আমরা কিছু ঘটনার দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলে এই ব্যাপারে সন্দেহ থাকবে না। সাভারের ব্যবসায়ী শামিম হত্যাকান্ড এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার মোল্যা নজরুলের কর্মকান্ড।
সবচেয়ে ভয়ানক হল আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মখা আলমগীর যখন বললেন যে বিদ্যমান আইনেই পুলিশের গুলি করার বিধান দেয়া আছে। আমরা নাগরিক হিসেবে শঙ্কিত থাকি যখন মোল্যা নজরুলদের হাতে সেই ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। আদালতের বিচার ছাড়াই রাজপথে পুলিশের হাতে বিচার তুলে দেবার ঘটনা আদালত অবমাননার শামিল কিনা সেটা আইনবিদদেরকে ভাবতে হবে।
তবে আইনের প্রফেসর মিজানুর রহমানকে সে কষ্ট করতে বলছি না। কারন তিনি এই রাষ্ট্রেরই বিরুদ্ধাচারন করতে পঙ্গু লিমনকে মানা করেছেন। সাথে সাথে আমাদেরকেও। পুলিশের বিচার হয়না আমাদের দেশে। তাদেরকে আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় না। যদি কেউ নজির দেখাতে পারেন যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারনে তাদের ফাঁসি হয়েছে তাহলে বিশ্বাস করব।
সম্প্রতি ফৌজদারী কার্যবিধির সংশোধনের কথা আমরা সবাই শুনেছি। সেখানে বিচারের পরিবর্তে "সমঝোতা" করবার অনেক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই ব্যাপারে আইনমন্ত্রী ব্যাখাটা খুবই হতাশাজনক।অনেকেই বলেছেন এই আইনে সাধারন জনগন আইনীভাবে সুবিচার পাবে না। এর ব্যাখায় তিনি বলেছেন," এই আইনের সুবিধা সাধারন জনগন পাবে না তা ঠিক নয়"। কিভাবে বিশ্বাস করব তার কথা যখন লিমনের মত মানুষ সুবিচারের পরিবর্তে "সমঝোতা" পেতে যাচ্ছে।
মামলাজট কি জনগনের তৈরী সমস্যা নাকি আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়ার সমস্যা? এর দায় সুবিচার আঙ্কাখাকারীদের ঘাড়ে চাপানোতে সত্যিই কি সমস্যা কমবে নাকি বাড়বে?
লিমনের ঘটনার পরে এই সমস্যা বেড়ে যাবার প্রবনতাই আমরা দেখব। কারন এখন মামলা করবার জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জন্য আরো বেশী করে বাজেট করতে হবে লিমনের মত ভাগ্যহতদেরকে। আর যারা সেই ক্ষমতা রাখেন না তাদেরকে মুখ বুজে সয়ে যেতে হবে সকল অন্যায় অবিচার।
সমঝোতা আর সুবিচার এক কথা হয় কিভাবে? রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যই ভয়ানক। বিচার চাইতে গিয়ে যদি উলটো শাস্তি পেতে হয় তাহলে আমরা সবাই মগের মুল্লুকে বাস করছি। মগের মুল্লুকের যেমন কোন লেজিটিম্যাসি নাই, তেমনি "সমঝোতার" কোন লেজিটিম্যাসি দেখছি না আমরা। এখন লিগ্যালিটির প্রশ্নটা শোষনের প্রশ্নের সাথেই মিলিয়ে পাঠ করতে আর কোন অসুবিধা থাকার কথা না।
এরকম পরিস্থিতিতেই উদ্ভট সব মিজানুর রহমান মার্কা সমাধান চিন্তা করা যায়। এটা একটা বিকৃত ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের প্রতিচ্ছবি ছাড়া কি হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ১:১২