পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের কচ্ছ (কচ) জেলায় শুষ্ক লবণে আচ্ছাদিত প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার শুভ্র মরুভূমিতে (white desert) প্রতিবছর শীতকালে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় তিন মাসব্যাপী পালিত হয় "রণ উৎসব" (rann-utsav)। গুজরাট সরকারের তত্ত্বাবধানে ব্যাপক প্রস্তুতি ও আয়োজনের মধ্য দিয়ে নভেম্বর মাসে এই উৎসবের শুরু হয়। এই উৎসবে মেলা, নাচগান, খেলাধুলা, যোগব্যায়াম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি সবকিছু রয়েছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হচ্ছে পূর্ণিমার রাত্রিতে দিগন্ত বিস্তৃত সফেদ মরুভূমি, নীল আকাশ, জলাভূমির সবুজ জল এবং চাঁদের আলোর যৌথ বিন্যাশে সৃষ্ট চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক দৃশ্য। বিরাট এলাকায় বিস্তৃত বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে এই উৎসব প্রায় তিন মাস পর ফেব্রুয়ারী মাসে শেষ হয়।
কচ্ছের অবস্থান ও ভৌগলিক পরিচিতি
কচ্ছ (কচ) পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের একটি জেলা। এটি ভারতের বৃহত্তম জেলা (৪৫,৬৭৪ বর্গ কিলোমিটার), মোট জনসংখ্যা ২০,৯২,৩৭১। এই জেলার একটি বৃহৎ অংশ অগভীর আর্দ্রভূমি যাকে বলা হয় কচ্ছের বৃহত্তর রণ। এই জেলাটি কচ উপসাগরীয় উপকূল এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরব সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত, উত্তর ও পূর্বাংশের অংশগুলি কচের বড় রণ এবং কচের ছোট রণ নামে পরিচিত। এর দক্ষিণ প্রান্তে বান্নি তৃণভূমিগুলি অবস্থিত। এই জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ।
বিচিত্র প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের এই রণ এলাকা লবণাক্ত মাটি দিয়ে গঠিত মরুভূমি। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় এই এলাকাটি সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে ডুবে থাকে। শীতকালে পানি শুকিয়ে গেলে আবার শুষ্ক মরুভূমিতে রূপ নেয়। এই মরু এলাকার উপরিভাগে সাদা লবণের একটা হালকা স্তরের সৃষ্টি হয় যার কারণে একে শুভ্র মরুভূমি (white desert) বলা হয়। এটি ভারতের অন্যতম উষ্ণতম অঞ্চল যেখানে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা গড়ে ৪৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শীতের তাপমাত্রা নাটকীয়ভাবে কমে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচেও চলে যায়। এখানে হিন্দু, মুসলিম, জৈন এবং শিখ ধর্মসহ অনেক ধর্মের লোক বাস করে। সরকারিভাবে যদিও বেশিরভাগ জলাভূমিকে সুরক্ষিত অঞ্চল হিসাবে সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে তারপরেও এলাকাগুলোতে গবাদি পশু চারণ, আগুনের কাঠ সংগ্রহ এবং লবণ উত্তোলনের কার্যকলাপের কারণে রণ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকির মধ্যে রয়েছে। রণে বেশ কয়েকটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং সুরক্ষিত সংরক্ষণাগার রয়েছে। এই জেলার বড় শহর ভুজ (Bhuj) থেকে রণের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার, বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘন্টা।
ভারতে কচ্ছের বৃহত্তর রনের উত্তরে রয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এটি ভারত ও পাকিস্তানের স্পর্শকাতর সীমান্তগুলোর একটি। কারণ প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ এই অনুর্বর লবণাক্ত নিম্নঅঞ্চলটি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ ছিল যা ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিল। অনেক আগে সাগরের সাথে সিন্ধু নদের মিলনস্থল কচ্ছের রণের মধ্যেই ছিল। ১৮০১ সালের ভূমিকম্পে সিন্ধুর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে মিলনস্থলটি পাকিস্তানের দিকে সরে যায়।
আলেয়া
বান্নী তৃণভূমি এবং কচ্ছের রনগুলিতে আলেয়া পরিলক্ষিত হওয়া নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। স্থানীয় লোকেরা এগুলোকে "ছির বাট্টি" (ভুতের বাতি) বলে অভিহিত করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেন যে আলোগুলি মাঝে মাঝে লুকোচুরি খেলে এবং তাদের সন্ধান করে বা অনুসরণ করে। কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে অন্ধকার রাতে কেবল রাত 8 টার পরে আলো দেখা যায়, সবসময় মাটি থেকে দুই থেকে দশ ফুট উপরে থাকে এবং রাতের বেলা এগুলোকে অনুসরণ করে অনেকে জঙ্গলে বা মরুভূমিতে পথ হারিয়ে ফেলে। বায়ুমণ্ডলীয় এই ভৌতিক আলো (আলেয়া) যা রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে বা খোলা প্রান্তরে দেখা যায় তা বিজ্ঞানীদের মতে গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা থেকে উৎপত্তি। বিজ্ঞানীরা যাই মনে করুক না কেন, পর্যটকরা জোৎস্না রাতে এই আলেয়ার সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠে অনাবিল আনন্দ লাভ করে।
রণ উৎসবের কর্মযজ্ঞ
উৎসবের মূল ভেনুর অবস্থান ধর্দো (Dhordo) গ্রামে হলেও কচ্ছ জেলার সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন আয়োজন হয়ে থাকে। চোখ ধাঁধানো রঙ্গিন সাজসজ্জা, হস্তশিল্পের লোকজ নকশার বুনন, চিত্রের অলংকরণ, সংস্কৃতির অনবদ্যতা, সংগীত ও নৃত্যের মুর্চ্ছনা, সব মিলিয়ে কচ্ছের শুষ্ক জমিতে একটি স্বতন্ত্র পরিবেশ ও আবহের তৈরি হয় যা এই অঞ্চলের পরিচয়, কৃষ্টি এবং চেতনাকে প্রতিফলিত করে। রাজ্যের অন্যতম পরিবেশগত ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যময় জেলা কচ্ছ এসময় শিল্প, কারুশিল্প, সংগীত, নৃত্য, মানুষ এবং প্রকৃতিকে উদযাপনের একটি জনপ্রিয় স্থানে পরিণত হয়। সব ধরনের পর্যটকের আনন্দ-বিনোদনের সুবিধার্থে এখানে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করা হয়। যেমন বিভিন্ন রাইডের সমন্বয়ে অস্থায়ী শিশু পার্ক, স্থানীয় লোকজ ও হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ও মেলা, মরুভূমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে গানের আসর, উটের কাফেলা ও উটের পিঠে ভ্রমণ, ঘুরি উড়ানো, স্থানীয় রান্নাও রাস্তার খাবারের দোকান, খেলাধুলো-ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। উল্লেখ্য পরিবেশ সুন্দর ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্দেশ্যে মরুভূমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে কোনো দোকানপাঠ বসতে দেওয়া হয় না এমন কি এখানে হকারেরও প্রবেশ নিষেধ। তাই রণের শুভ্র মরুভূমিতে ভ্রমণের সময় ভ্রমণকারীরা সাথেই পানীয় ও খাবার নিয়ে যায়।
Activities-Facilities
শুভ্র মরুভূমির অভিজাত আবাসিক এলাকা 'তাঁবু শহর' (tent city)
বিশেষ করে পূর্ণিমা রাতের বিস্ময়কর এবং অপরূপ নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য প্রতিবছর এসময় এখানে ভিড় করে দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক। অভিজাত ও সৌখিন পর্যটকদের জন্য কচ্ছের রনের এই মরুভূমির একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অস্থায়ীভাবে তাঁবুর আদলে গড়ে তোলা হয় পাঁচ তারকা হোটেলের সমমানের রাত যাপনের কামরা বা স্যুট। এই অভিজাত এলাকায় তাঁবুর নির্দিষ্ট অতিথি ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারে না। বিলাসী পর্যটকেরা বিস্তীর্ন সফেদ মরুভূমিতে উষ্ণ আতিথেয়তার ছোঁয়ায়, সর্বোচ্চ নিরাপত্তায়, আরাম-আয়েসে, শয়নকক্ষ থেকে নিরুপদ্রবে, একাকী, অন্তরঙ্গে অথবা সপরিবারে পূর্ণিমার চাঁদ, চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত শ্বেত-শুভ্র মরুভূমি ও জলাভূমির অথৈ জলরাশির অপরূপ সৌন্দর্যকে চোখ ও হৃদয় দিয়ে উপভোগ করার জন্য এই ব্যবস্থা!
আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপণ ও বাস্তবতা
রণ উৎসবকে জনপ্রিয় করার জন্য গুজরাট সরকার প্রতি বৎসর আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপণের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। তাছাড়া স্থানীয় পর্যটক সংস্থাগুলোও বিভিন্ন রকমের ট্যুর প্যাকেজের ব্যবস্থা করে। তবে পর্যটকদের অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু জানা যায় এখানে উৎসবের সময় সবকিছুর দাম থাকে আকাশচুম্বী। বিশেষ করে থাকার হোটেল খুবই কম, যা আছে তাও নিম্নমানের এবং ভাড়া খুব বেশি। তাছাড়া হোটেল-রেস্টুরেন্টের নোংরা পরিবেশ ও নিম্নমানের খাবার-দাবারে অনেকের পেটের পীড়াসহ নানারকম সমস্যা হয়। এখানে সারা বছরে আবাসিক হোটেলের ব্যবসা মাত্র তিন মাসের। তাই খুব ভালো মানের স্থায়ী হোটেল এখনো গড়ে উঠেনি। যার কারণে দূর-দুরান্তের বেশির ভাগ পর্যটক ভুজ শহরে অবস্থান করে। সকালে গাড়িতে বা বাসে রণে এসে আবার নিশি রাতে হোটেলে ফিরে যায়।
কচ্ছ জেলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও উৎসবের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র:
তথ্যও ছবিসূত্র:
১। Kutch district
২। Rann Utsav
৩। rannutsavonline-Activities-Facilities
◄ আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব ৩ - হগম্যানায় | আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব ৫ - উইন্টারলুড ►
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ভোর ৪:০২