তিনি ছিলেন ডাচ ফুটবলের অবিসংবাদিত রাজপুত্র । মাঠে তাঁর অবিশ্বাস্য সব কারিকুরিতে রীতিমতো ‘হা’ করে দিতে পারতেন ফুটবল পিয়াসীদের । ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত ‘টোটাল ফুটবল’ নামক অনবদ্য এক কৌশলে মুগ্ধ-বিমোহিত করে গেছেন ‘দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ কে ।
কোচ রাইনাস মিশেলের মস্তিস্ক-প্রসূত টোটাল ফুটবলকে মাঠে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি । এবং বিশ্ব ফুটবল দেখল অসাধারণ এক কূশলী ফুটবল । সবাই একসাথে আক্রমণে, একই সাথে মধ্যমাঠে, এবং একই সাথে রক্ষণে । যেন সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ ।
পশ্চিম জার্মানীর কাছে ’৭৪ এর ফাইনালে হেরে সোনালী ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখা হয়নি নেদারল্যান্ডের এই রাজপুত্রের । পারেননি, ’৭৮ এ-ও । আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে, মারিও ক্যাম্পাসের কাছে হেরে সেবারও হলো না । বিশ্ব ফুটবলও যেন হতাশায় কাতরে মরলো তাঁর না-পাওয়ার দুঃখে । বিশ্বকাপটারও যে বড় আশা ছিল, একদিন ডাচ-রাজপুত্রের স্পর্শে ধন্য হবে !
বিশ্বকাপ না-পাওয়ার দুঃখ নিয়েই বিদায় বলে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলকে । তবে ক্লাব ফুটবলে জিতেছিলেন একের পর এক ট্রফি । আয়াক্সের হয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে রাজত্ব-ই করেছিলেন, এই রাজপুত্র । টানা তিনবার হয়েছিলেন ইউরোপ-সেরা, আর ডাচ-লিগ তো নিজেদের সম্পত্তিই যেন বানিয়ে ফেলেছিলেন । সৌন্দর্য্যের পূজারী ছিলেন বলেই হয়তো আয়ক্সের পর শত প্রলোভনের থোড়াই কেয়ার করে পাড়ি দিয়েছিলেন বার্সালোনায় । সেখানেও উড়িয়েছেন তাঁর জয়ের কেতন । সুন্দর ফুটবলে মোহিত ও ধন্য করেছেন স্প্যানিশ ও বিশ্ব ফুটবলকে ।
বার্সালোনায় পরে কোচ হিসেবে যোগ দিয়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, জানান দিয়েছিলেন তাঁর কোচিং প্রতিভারও । বিধ্বস্ত বার্সালোনায় ফিরিয়ে এনেছিলেন স্প্যানিশ-সিংহাসন । গড়ে তুলেছিলেন গার্ডিওলাদের নিয়ে ‘ড্রীম টিম’ । সাথে বার্সালোনার ক্লাব কর্তৃপক্ষকে দিয়েছিলেন ফুটবল গড়ে তোলার এক রুপরেখা । তাঁর থিউরী মেনেই ‘লা মাসিয়া’ তৈরী হয়েছে । সেখান থেকে উঠে এসেছে, একের পর এক দুর্দান্ত সব ফুটবলার । স্পেন পেয়েছে ‘টিকি টাকা’ নামক এক ফুটবল সৌন্দর্য্য ! জাভি, ইনিয়েস্তা, ফ্যাব্রিগাস, মেসি... অনবদ্য সব ফুটলারের কারখানা-ই যেন ‘লা মাসিয়া’ । যার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন আমাদের আজকের এই রাজপুত্তুরই ।
ক্যান্সার ধরা পড়েছিল তাঁর ফুসফুসে । বলেছিলেন ক্যান্সারকে তিনি ২-০ গোলে হারিয়ে দিবেন । পারলেন না হারাতে, উলটো নিজেই হেরে গেলেন । শরীরের সব জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সেই ক্যান্সার এবং তাকে নিয়ে গেছে ওপারের অচেনা জগতে ।
চিরন্তন ফুটবল-সৌন্দর্য্যের পূজারী তিনি, আপোষ করেন নি কখনো অসুন্দরের সাথে । তিনি দেখতে যেমন রাজপুত্র ছিলেন, মাঠেও ছিলেন তেমনি । তাঁর এক ড্রিবলিংয়ে ডিফেন্ডাররা এতটাই বোকা বনে যেতেন যে, সেটার নাম-ই হয়ে গিয়েছিল ‘ক্রুইফস টার্ন’ । তিনবার ব্যালন ডি অর কিংবা তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ অথবা ১০ বার ঘরোয়া লিগ জেতা, সবকিছুর চেয়েও যিনি ফুটবলের সৌন্দর্য্যকেই হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন, অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন । তাই হয়তো অকপটে বলতে পেরেছিলেন ‘ফুটবল খেলাটা সহজ কিন্তু সহজ ফুটবল খেলাটাই কঠিন’ ।
হেনড্রিক ইয়োহানেস ক্রুইফ (২৫এপ্রিল ১৯৪৭-২৪ মার্চ ২০১৬) যাকে সবাই চেনে ইয়োহান ক্রুইফ নামে । দৈহিক কোন আকৃতিতে হয়তো আর আমাদের মাঝে নেই । তবে তিনি থাকবেন, তাঁর ফুটবলে, তাঁর সুন্দর ফুটবলের চেতনায়, তাঁর দর্শনে, তাঁর অনবদ্য সব সৃষ্টিতে, তাঁর টোটাল ফুটবল এ ।
শান্তিতে থাকুন ক্রুইফ
RIP Johan Cruyff
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:২৬