......
স্নান সেরে কাপড়-চোপড় পরে দুটো টিঠি লিখতে বসে যাই আমি। একটা লিখলাম বাড়ীতে। ভালোয় ভালোয় পৌছতে পেরেছি এই খবরটা জানিয়ে দিলাম। দ্বিতীয় চিঠিটা লিখলাম আমার অফিসে। এ সময় রবি দাসও এসে পড়ে। চিঠি দুটো তাকে দিয়ে তাগাদা দিলাম যেন আজই কাউকে তিরাহ পাঠিয়ে চিঠি দুটো পোষ্ট করে আসে।
রবি দাস তখুনি একজন যুবক চৌকিদার, বিশ্বেশ্বরকে তিরাহ পাঠিতে দেয়। এবং নিজে লান্চের টিফিন ক্যারিয়ার সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমার সাথে বেদরওয়ারাহ রওয়ানা হয়।
একটা কাঠের পুল পেরিয়ে পাথুরে ঢালু পথ দিয়ে আমরা উপত্যাকায় পৌছি। এবং ধানক্ষেত দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলা সরু পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেদরওয়ারাহর সেই পাহাড়ে এসে উপস্থিত হই- যেখানে অসংখ্য গুহার অন্ধকারাচ্ছন্ন খোলামুখ হাঁ করে আছে।
ধানক্ষেত পার হয়ে গেলে কৃষকদের ছোট ছোট ঘর চোখে পড়ে। তার থেকে কিছুদুর সামনে এগিয়ে গিয়েই উঁচু মত সমতল জায়গায় গিয়ে পৌছি আমরা। এখানে একটি ফলের বাগান আছে। তারপাশেই একটি কাঠের ব্যাংলোবাড়ী। ঘন গাল-পালার ঘেরা বিভিন্ন ফলের গাছের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা একটি ছোট গেট চোখে পড়ে- যেটা বাগানের ভেতর চলে গেছে। এবং ভেতরে একটি ছোট কটেজের অংশ চোখে পড়ে। কটেজের পোর্টিকো থেকে গেট পর্যন্ত একটি ছোট ঢালাই করা রাস্তা ছিল। - যার উপর কালো রঙের হীরক জাতীয় পাথর কেটে কেটে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। গেটের উপর ডানদিকে ছোট একখানি কাঠের সাইনবোর্ড ঝুলছিল। যার একটি পেরেক দিয়ে আটকানো তক্তাটা আস্তে আস্তে দুলছিল। আমি ঘাড় বাঁকা করে সাইনবোর্ডটার লেখাটা পড়লাম।
"রিচার্ড কটেজ"- সাইনবোর্ডটায় লেখা।
গেটের দু'দিকেই রকমারী ফুলের বাগান। একজন মহিলা মাথা নীচু করে ফুলের বাগানে পানি দিচ্ছিলেন। প্রথমে আমি তাঁকে দেখতে পাইনি। নহরদারের সাথে আলাপ করতে-করতে চলে যাচ্ছিলাম। এই সময় সেই মহিলা- সম্ভবতঃ আমাদের কথাবার্তা শুনে চমকে উঠলেন।এবং পানি দেয়ার ঝাড় হাতে নিয়ে ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে গেলেন। আর আশ্চর্য হয়ে যেন আমাদের দেখছিলেন। ভদ্রমহিলার গায়ে সাদা সেলোয়ার এবং লম্বা রূপালী চমকের নকশা আঁটা ওড়না। এবং দাঁড়িয়ে আছেন।
ওড়নার ফাঁক দিয়ে মহিলার গোল-গোলাপী চেহারায় একরাশ উৎকন্ঠা ঝড়ে পরে যেন। এবং তিনি আশ্চর্যমাখা চোখজোড়া দিয়ে আমাকে নিরীখ করছেন। তিনি আমাকে, আমি তাকে, আমরা একজন অপরজনকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখছিলাম। তাঁকে পোশাকে-আশাকে, চাল-চলনে, এবং চুল বাধার ধরনে যেন মনে হচ্ছিল শহুরে। এই দম বন্ধ হয়ে যাওয়া জংলী এলাকায় তিনিও একজন শহুরেকে এভাবে তাঁর সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আচম্বিতে হতভম্ভ হয়ে যান।
"সাহেব বেরওয়াহদার গুহাগুলোর ছবি আঁকতে এসেছেন"- নম্বরদার রবি দাস নিজের ভারী পাগড়ী সামলাতে সামলাতে বললেন। পরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে- "ইনি মাহমুদ সাহেবের স্ত্রী। এই বাংলোর মালিক।"
আমি চমকে উঠে লখনভী ঢংয়ে "আদাব" বললাম। ভদ্রমহিলা স্মিত হেসে জবাব দিলেন। এবং গেট খুলে আমাদের ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানালেন।
আমি ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ করতে করতে পোর্টিকোর সাথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আলাপের মধ্যেই ভদ্রমহিলা জানালেন, তাঁর নাম নাসিমা। তাঁর স্বামীর নাম মাহমুদ। ওরা দু'জনে গত বারো বছর থেকে এই কটেজে বসবাস করছেন। তাঁর স্বামী একজন বিত্তবান লোক, তবে সম্মান-জ্ঞান বড় টনটনে। নিঃসঙ্গতা তাঁর বড় প্রিয়।
(কৃষণ চন্দরের "ফুলে ফুলে খোঁজে ফেরে" বইটির পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯)