১৯৪৪ সাল। ৭৫ হাজার রুপি বাজেটের সিনেমা ‘রতন’ শুধুমাত্র গ্রামোফোন বিক্রি থেকেই মুক্তির প্রথম বছর ঘরে তুললো ৩ লাখ রুপি। অনিল বিশ্বাস (বরিশাল), মাস্টার গুলাম হায়দার (পাঞ্জাব), খেমচাঁদ প্রকাশ (রাজস্থান) কে টপকে হিন্দী সঙ্গীত পরিচালকদের শীর্ষ আসনে পৌঁছে গেলেন সঙ্গীতের জন্য লক্ষ্ণৌয়ের পৈতৃক বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ২৪ বছরের এক যুবক, নওশাদ আলী। উপমহাদেশের প্রথম এবং খুব সম্ভবত একমাত্র সুপারস্টার সঙ্গীত পরিচালক। কেমন ছিল তার জনপ্রিয়তা? ১৯৫০ সালে রাজকাপুর-সুরাইয়া অভিনীত ‘দাস্তান’ সিনেমার এপিগ্রাফ ছিল এরকমঃ ‘Naushad, Naushad, chaalis karor mein ek hi Naushad’ অর্থাৎ, ‘নওশাদ, নওশাদ, চল্লিশ কোটিতে নওশাদ একজনই’। ভারতের জনসংখ্যা তখন প্রায় চল্লিশ কোটি। নওশাদের নাম জানত প্রত্যন্ত অঞ্চলের পড়ালেখা না জানা মানুষগুলোও। শীর্ষস্থান দখলের পর ১৯৪৫-১৯৬৩ সময়কালে ৩০টি সিনেমায় সঙ্গীত দেন তিনি যার মধ্যে ৪টি ডায়মন্ড জুবিলী, ৭টি গোল্ডেন জুবিলী এবং ১৩ টি সিলভার জুবিলীর মর্যাদা লাভ করে। অর্থাৎ, মাত্র ৬টি সিনেমা বড় হিট হতে পারেনি। যাদু (১৯৫০) এবং দাস্তান (১৯৫০) সিনেমায় মুনাফার ৫০-৫০ শেয়ার দাবি করায় তা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রযোজকরা। পঞ্চাশের দশকে সিনেমা প্রতি তিনি নিতেন ১লাখ ১০ হাজার রুপি। তখন শীর্ষ নায়ক দিলীপ কুমারের পারিশ্রমিক ছিল ৩০ হাজার রুপি এবং অন্যান্য কম্পোজারদের ২৫-৩০ হাজার রুপি। এ সময়টাতে বছরে ১টির বেশি সিনেমা সাধারণত তিনি করতেন না। তাঁর সুরারোপিত বিখ্যাত সিনেমার মধ্যে আছেঃ রতন (১৯৪৪), আনমোল ঘড়ি (১৯৪৬), শাহজাহান (১৯৪৬), মেলা (১৯৪৮), দুলারী (১৯৪৯), আন্দাজ (১৯৪৯), দীদার (১৯৫১), আন (১৯৫২), বৈজুবাওরা (১৯৫২), শাবাব (১৯৫৪), উড়ান খা তোলা (১৯৫৫), মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭), কোহিনূর (১৯৬০), মুঘল-এ-আজম (১৯৬০), গঙ্গা যমুনা (১৯৬১), মেরে মেহেবুব (১৯৬৩) ইত্যাদি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মধ্যে আছেঃ উত্তর প্রদেশের লোকগানকে সিনেমায় ব্যাপকভাবে নিয়ে আসা, হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতকে আমজনতার কাছে পৌঁছে দেয়া, নিজের উদ্ভাবিত ইকো (echo)-র ব্যবহার, ভয়েস এবং মিউজিক ট্র্যাকের পৃথক রেকর্ডিং ও সাউন্ড মিক্সিং, আবহ সঙ্গীতকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান। প্রায় দুই দশক শীর্ষে থাকার পর পরিণত নওশাদের যখন মসনদে জাঁকিয়ে বসে থাকবার কথা, তখনি তিনি রাজত্ব হারালেন, ষাটের দশকে শুরুতে, বয়স সবে ৪৪। চল্লিশ দশকের বৈচিত্র্যময় আর উচ্ছ্বল নওশাদ প্রায় হারিয়ে গেছেন। কিন্তু সে বয়সেই তিনি কিংবদন্তী, সবসময়ই থেকেছেন প্রাসঙ্গিক। এতটাই যে, আমাদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যখন পুরান ঢাকার বর্ণণা করেন, সেখানেও তিনি নওশাদকে এড়াতে পারেন না। ২০১৯ তাঁর জন্মশত বার্ষিকী, ২৫ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার রাজু ভারতণের লেখা 'কম্পোজার অব দ্য সেঞ্চুরী' কে একটু কাটছাঁট করে সিনে সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য দেয়া হলো।
তিনি ছিলেন মহীরুহ, ভারতীয় সিনেমার এমন এক কিংবদন্তী যার জন্য সায়গল ও নূরজাহান স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে গান গেয়েছেন এবং এমন এক টাইটান যিনি রফি ও লতার মত শিল্পীদের তাদের আসনে অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন, যিনি আবিষ্কার করেছেন সুরাইয়া ও উমা দেবী-কে এবং যার সহায়তা না পাওয়ায় পরবর্তীতে পিছিয়ে পড়েন সামসাদ বেগম, তালাত মাহমুদ ও মুকেশ- এর মত শিল্পীরা।
"লতা যখন প্রথম আমার কাছে আসে আমি তাকে গাইতে বলিনি।" নওশাদ বলেন, "মজরুহ সুলতানপুরীর লেখা লিরিক-টা ২৫/৩০ বার আবৃত্তি করতে বলেছি। উঠায়ে যা উনকে সিতম এর উর্দু কাব্যিক নির্যাস যখন সে আত্মীভূত করেছে, তখনই কেবল আমি এটাকে রাগ কেদার-এ সাজিয়েছি। নার্গিসের ঠোঁটে সেটা অমর হয়ে আছে।"
নওশাদ কেদার বলতেন না, তিনি বলতেন কেদারা। ক্যারিয়ারের ২৫ বছর পূর্তীতে লতা যখন তার প্রিয় দশ গানের একটি হিসেবে মোগল-এ-আযম এর বেকাস পে করম কিযিয়ে কে বেছে নেন তখন আশ্বর্য হবার কিছু থাকেনা। লতার উর্দু ডিকশন ঠিক করার দায়িত্ব পালন করেন নওশাদ। তাঁর সহকারী লতাকে উর্দুর প্রশিক্ষণ দেন। আন্দাজ (১৯৪৯) এ লতার রেকর্ডিং এর সময় রাজ কাপুর উপস্থিত ছিলেন। এর আগে একবার তিনি লতার গলাকে 'পাতলা' বলে না করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রেকর্ডিং এর পর রাজ কাপুর লতাকে দিয়ে তাঁর বরসাত (১৯৪৯) সিনেমায় গান গাওয়ান।
১২ বছরের সুরাইয়াকে টুলের উপর দাঁড় করিয়ে গান রেকর্ড করান নওশাদ। দিল্লাগী (১৯৪৯) ও দাস্তান (১৯৫০) এ সুরাইয়া তার ক্যরিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স উপহার দেন। তু মেরা চাঁদ মে তেরে চাঁদনী (দিল্লাগী) খুব সম্ভবত সুরাইয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত গান। "সুরাইয়াকে মনে হত যেন পাশের বাড়ির মেয়েটি গাইছে। তার এই গুণটাকেই আমি চারদিন কি চাঁদনী (দিল্লাগী) ও ন্যায়নো মে প্রীত হ্যায় (দাস্তান) গানে কাজে লাগিয়েছি।"
লতা-রফি দৃশ্যপটে আসার আগেই নওশাদ বোম্বের শীর্ষ কম্পোজারের আসন দখল করেন। এজন্য তাকে নির্দিষ্ট কোনো শিল্পীর উপর নির্ভর করতে হয়নি। তবে লতার আগে তার পছন্দের গায়িকা ছিলেন প্রথমে আমিরবাঈ কর্নাটকী ও পরে শামসাদ বেগম। "শামসাদের গলা ছিল সহজ ও স্বচ্ছ।" যব উসনে গেসু বিখরায়ে (শাহজাহান)], না বোল পী পী মোরে আংগনা এবং চাঁদনী আয়ি বানকে পেয়ার (দুলারী) ইত্যাদি গানে তার এই দিকটিকেই ব্যবহার করেন নওশাদ।
সুহানি রাত ঢল চুকি-র রফির একটা আলাদা জায়গা ছিল নওশাদের সঙ্গীতে। আন্দাজ সিনেমায় মুকেশ এবং বাবুল সিনেমায় তালাত মাহমুদকে দিলীপ কুমারের ঠোঁটে প্রথম অতটা individualistic শোনায়। কিন্তু রফি যে এভাবে সবাইকে অতিক্রম করে যাবেন সেটা হয়তো কেউ ভাবতে পারেন নি, নওশাদ ছাড়া, রফি নিজেও নন। আনমোল ঘড়ি (১৯৪৬) এ তাঁর প্রথম একক গান তেরা খিলোনা টুটা বালক থেকে শুরু করে উড়ান খা তোলা (১৯৫৫)-র ও দূরকে মুসাফির এ রফি বদলেছেন অনেক, এই সময়ের মাঝে ঘটে গেছে বৈজু বাওরা (১৯৫২) বিস্ময়।
রাগ দরবারী-র ও দুনিয়াকে রাখওয়ালে, বা রাগ মালকোষ এ মন তরপত হরি দর্শন, বা রাগ গুজরাটি তোরি তে ইনসান বানো - নওশাদের ক্যারিজম্যাটিক তত্ত্বাবধানে রফি নিজেকে নিয়ে গেলেন ফিল্মী গানে অসাধারণ উচ্চতায়। রফির অসাধারণ রেঞ্জকে পরে অন্য কম্পোজাররাও ব্যবহার করা শুরু করলেন। রফি কীভাবে রফি সেটা একটি ঘটনাতেই বুঝা যায়। উড়ান খা তোলা-র ও দূর কে মুসাফির রাগ দূর্গায় হলেও শুরুতে এটা রাগ পাতদীপ-এর একটি গজল ছিলো। রেকর্ডিং এর পর নওশাদের মনে হলো কিছু একটা নেই এবং তিনি বললেন এটা পুনরায় রেকর্ড করতে হবে। সিনেমার নায়ক দিলীপ কুমারসহ অন্যরা অভিমত দিলেন গানটি ভালই হয়েছে। রফি কোনো মতামত দিলেন না। তিনি শুধু বললেন, "আমি রিহার্সালের জন্য কখন আসবো?"। রফি এবং গীতিকার শাকিল বাদায়ুনী, এঁদের উপর তাঁর বিশ্বাস ছিল অগাধ। নওশাদ মনে করতেন তিনি যেভাবে চাইতেন, সেভাবেই এঁরা ডেলিভারি দিতে পারতেন। মেহবুব খান পরিচালিত অমর (১৯৫৪) সিনেমার প্রায় সব গান লতার গাওয়া। রফি শুধু থিম সং গাইলেন, ইনসাফ কি মন্দির হ্যায় ইয়ে ভগবান কা ঘর হ্যায়, রাগ ভৈরবীতে। সিনেমায় লতারও ভৈরবীতে গান ছিল একটা খামোশ হ্যায় খেওয়ানহার মেরা। রফির ভৈরবী যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল পুরো সিনেমাকে। পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে তালাত মাহমুদ, মান্না দে, মুকেশ ছিলেন। তালাতে ধারণা নওশাদের সামনে সিগারেট খাওয়ার জন্য নওশাদ তাঁকে আর গান গাইতে ডাকেন নি। কিন্তু বাবুল (১৯৫০) পরবর্তী সময়ে নওশাদ যে ধরনে সঙ্গীত দিচ্ছিলেন সেটা তিনি তালাত মাহমুদের কন্ঠ ব্যাবহার করে সাফল্য পেতেন না। ১৯৪৮-৪৯ সময়ে মুকেশের কন্ঠে অনেক হিট উপহার দেন নওশাদ। কিন্তু, মুকেশের কন্ঠে কোনো ধরনের নিগূঢ়তা ছিলো না (আন্দাজের সাফল্যের পরও দিলীপ কুমার এই অভিযোগ করেছিলেন)। নওশাদ মনে করতেন মান্না দে-র গলা শুষ্ক। 'একমাত্র রফির গলাতেই romantic resilience ছিল যেটা আমার কম্পোজিশনের সব সূক্ষন ব্যপারগুলোকে তুলে ধরতে পারতো। ' কিশোর কুমারকে দিয়ে তিনি ১৯৭৫ সালে একটি ডুয়েট গাইয়েছিলেন, তবে সিনেমায় গানটি ছিল না। ১৯৫০ পরবর্তী নওশাদিয়ান মেলোডিতে কিশোর কুমারের স্থান ছিলো না। যখন ছিল (১৯৪০-৪৯), তখন কিশোর কুমার বলবার মতো কোনো শিল্পী ছিলেন না। লতা বা রফি, যত বড় শিল্পীই হোন না কেন, তাঁদের নওশাদের বাড়িতে তাঁর মিউজিক রুমে এসে রিহার্সাল করতে হতো।
সেই সময়, বোম্বে সিনে দুনিয়ার ২নং সঙ্গীত পরিচালক সি রামচন্দ্র বলে বেড়াতে লাগলেন যে sad song এ তিনি নওশাদের সমতুল্য। নওশাদের জবাব ছিল সুস্পষ্ট। লতাকে দিয়ে রাগ ইমনে তিনি গাওয়ালেন না মিলতা গম তো বরবাদি কে আফসানে কাহা যাতে। বৈজুবাওরার রাগ ভৈরবে সাজানো লতার মোহে ভুল গায়ে সাওয়ারিয়া শুনে সি রামচন্দ্র বলেছিলেন 'এই গানটা যদি আমার কম্পোজিশন হতো!'
নওশাদের কার্টার রোডের বাসভবনের মিউজিক রুমে যাওয়াটা ছিল একটা অভিজ্ঞতা! একদিকে দেয়াল ঘেঁষে পিয়ানো যা মনে করিয়ে দেয় পিয়ানোতে তাঁর অসাধারণ কম্পোজিশনগুলোকে, যেখানে তাঁর কাছাকাছি কেবলমাত্র অনিল বিশ্বাস কে ধরা যায়। এত অর্জনের পরও নওশাদ ছিলেন নম্র, নিজের ভুল স্বীকার করতে পিছ পা হতেন না, অন্যের প্রশংসা করতেও তাঁর বাধতো না। কখনো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যাপারে কোনো রুঢ় কথা বলতেন না। সমালোচনার জবাব তিনি দিতেন তাঁর সঙ্গীত দিয়ে এবং এদিকে তিনি ছিলেন অব্যর্থ। কারণ, সঙ্গীত দেবার আগে প্রতিটি স্ক্রিপ্ট তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। একই কথা অন্যদের ক্ষেত্রে বলা যায় না।
১৯৫৩ সালের কথা। নওশাদের সঙ্গীত নিয়ে কোনো সিনেমাই সিল্ভার জুবিলী হিট এর নিচে নামতো না। সেটা না হলে হতো গোল্ডেন জুবিলী বা ডায়মন্ড জুবিলী। বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির টপ ডিস্ট্রিবিউটররা (financing producers) নিয়ম করেছিলেন যে, নওশাদের রেকর্ডিং এ তারা উপস্থিত থাকতে পারবেন তবে কোনো কথা বলবেন না। ১৯৫০ থেকে তিনি সিনেমাপ্রতি ১ লক্ষ রুপি নিতেন এবং অর্কেস্ট্রেশনের জন্য অতিরিক্ত ১০ হাজার রুপি নিতেন। ১৯৫৫ সালে সি রামচন্দ্র দ্বিতীয় কম্পোজার হিসেবে ১ লক্ষ রুপি পারিশ্রমিক নেয়া শুরু করেন কিন্তু ১৯৫৮-র পর প্রযোজকরা সেটা দিতে আর রাজী হন নি। অর্কেস্ট্রেশনের জন্য রামচন্দ্র অতিরিক্ত টাকা দাবি করলেও, কখনো পান নি। নওশাদের অর্কেস্ট্রেশন ছিল সবার থেকে আলাদা এবং এখানে তিনি অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। বলিউডে তিনিই প্রথম ১০০-পিস অর্কেষ্ট্রা পরিচালনা করেন। আবার মেরে মেহবুব গানটি রেকর্ড করেন ৬-পিস অর্কেষ্ট্রা দিয়ে।
সি রামচন্দ্র বা হুসনলাল-ভগতরাম, অনিল বিশ্বাস বা শচীন দেব বর্মন, রোশন বা মদন মোহন, সলিল চৌধুরী বা ওপি নাইয়ার, খইয়াম বা জয়দেব - সবাই অবিস্মরণীয় সংগীত দিয়েছেন। কিন্তু মুম্বাই ফিল্মে সবারই জানা ছিল, সমকক্ষদের মধ্যে নওশাদ পরিষ্কারভাবে প্রথম। "Where others imposed, Naushad composed".
রিদম কিং খ্যাত ওপি নাইয়ারের অনুপ্রেরণা ছিলেন নওশাদ। হাসতে হাসতে বলতেন, "আমি ওকে অনেক কপি করেছি"। তবে সুর নয়, স্টাইল। ওপি নাইয়ারের আগে রিদম কিং যদি কাউকে বলা যায় সেটা নওশাদ। মদন মোহন, খৈয়াম, এ আর রহমান-এর প্রিয় সঙ্গীত পরিচালক তিনি। মদন মোহন, শুঙ্কর-জয়কীষাণ সরাসরি তাঁর গান থেকে গান বানিয়েছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন হাল আমলের ইসমাইল দরবারকেও। অনিল বিশ্বাস, সি রামচন্দ্রের নেতৃত্বে নওশাদ বিরোধীদের মিটিং হতো নিয়মিত। নওশাদের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে কম্পোজার সাজ্জাদ হোসেন কবিতাও বানিয়েছিলেন। সবাই যে এমন ছিলেন তা নয়। শচীন দেব বর্মন, জয়মালা রেডিও অনুষ্ঠানে তাঁর নিজের গানের বাইরে একটি গানই বাজিয়েছিলেন, বন্ধু নওশাদের 'মধুবন মে রাধিকা নাচে রে' গানটি দিয়ে প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন তিনি। রাহুল দেব বর্মনও, তাঁর নিজের গানের বাইরে একটি গান বাজিয়েছিলেন, নওশাদের 'তু গঙ্গা কি মৌজ মে'।
১৯৬০ সালে মুঘল-এ-আযম নওশাদ যখন সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরষ্কারটি শঙ্কর-জয়কীষাণের (দিল আপনা অর প্রীত পারায়ী) কাছে হারেন তিনি ছিলেন ক্ষুব্ধ। টাইমস গ্রুপ অফ ইন্ডিয়ার জেনারেল ম্যানেজার জেসি জৈন-কে বলেন, "আপনি মুঘল-এ-আজম এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার গ্রুপের কোনো পত্রিকায় ভবিষ্যতে লিখবেন না হিন্দী সিনে সঙ্গীতের মান কেন নেমে যাচ্ছে!" নওশাদের একমাত্র ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারটি ছিল বৈজুবাওরা সিনেমার টু গঙ্গা কি মৌজ মে গানের জন্য। পদ্মভূষণ লাভ করেন ১৯৯২ সালে। তবে ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদা সাহেব ফালকে সম্মাননা পান ১৯৮২ সালে। কেবলমাত্র আর একজন ব্যক্তি কম্পোজার হিসেবে এই সম্মাননা পেয়েছেন, তিনি রাইচাঁদ বড়াল (হিন্দী ফিল্ম সঙ্গীতের জনক হিসেবে বিবেচিত)। যদিও পঙ্কজ মল্লিক এবং ভূপেন হাজারিকাও এ পুরস্কার পেয়েছেন - তারা শিল্পী হিসেবে সমধিক পরিচিত।
নওশাদ আশা ভোঁসলে কে খুব একটা ব্যবহার করেন নি। তিনি মনে করতেন আশা লতার চেয়ে ভার্সেটাইল, কিন্তু আশার কন্ঠে এক ধরনের 'বাজারি' ব্যাপার আছে যেটা ট্র্যাডিশনাল নায়িকা/গানের জন্য তাঁকে কম উপযোগী করে তোলে। তাঁর এ মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন লতা-আশা দু'জনেই। সামসাদ বেগমের উপর তিনি অন্যায় করেছেন বলে মনে করতেন। আরো বেশি গান তাঁর প্রাপ্য ছিল।
মালকা-এ-তারান্নুম নূরজাহান যখন ৩৩ বছর পর ভারত আসলেন, নওশাদের সঙ্গীত আয়োজনে শামুখানান্দা হলে তিনি গাইলেন আনমোল ঘড়ি (১৯৪৬)- এর রাগ পাহাড়ীর বিখ্যাত গান আওয়াজ দে কাহা হ্যায়। তারপর নূরজাহান গাইলেন জাওয়া হে মোহাব্বত ও মেরে বাচপন কে সাথী। শাহজাহান সিনেমায় তিনি কুন্দললাল সায়গল-কে দিয়ে গাওয়ালেন ৪টি অবিস্মরণীয় গান - গাম দিয়ে মুশকিল (কাফি), এ দিল বেকারার ঝুম (বিহাগ), চাহা বরবাদ করেগি (বাগেশ্রী) এবং যব দিল হি টুট গায়া (ভৈরবী)। নওশাদের কাছে কে এল সায়গল ছিলেন ultimate singing star আর মোহাম্মদ রফি ultimate ghost voice। ৫০ জনের বেশি নারী শিল্পীকে ব্যবহার করেছেন তিনি। তাদের মধ্যে লতাকেই সেরা মানতেন। যদিও নূরজাহান পাকিস্থান চলে না গেলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারতো।
রফি থেকে হরিহরণ, প্রেম নগর (১৯৪০) থেকে তাজ মহল (২০০৫), নওশাদের যাত্রা ছিল দীর্ঘ এবং এটা তিনি সম্পন্ন করেন অতুলনীয় মর্যাদার সাথে। উর্দু কবিতার উপর তার আয়ত্ব তাঁকে আইকনদের আইকন বানিয়েছিল। নওশাদ চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর প্রতিবিম্ব রয়ে গেছে কারণ তাঁর সঙ্গীত টাইমলেস। টাইমলেস কারণ ৩ মিনিটের অরিজিনাল গ্রামোফোন রেকর্ডে তিনি সারাজীবনের আনন্দকে ধরে রাখতে পারতেন।
শচীন দেব বর্মন সংক্ষেপে মূল কথাটাই বলেছিলেন, " কোয়ালিটি আমাদের সবারই ছিল। কিন্তু নওশাদের কাছ থেকে আমরা শিখেছি কীভাবে কোয়ালিটির সাথে পপুলারিটিকে মেশাতে হয়"। নওশাদের তত্ত্বাবধানে সিনে সঙ্গীত কি শিল্প না নৈপূন্য ছিলো? চাঁদনী রাত (১৯৪৮) এর সামসাদ-রফি ডুয়েট চেন কে দিল কিউ ফের লে আঁখে শুনুন, আপনি ধরতে পারবেন না রফির শিল্প কোথায় শুরু হয়েছে এবং শামসাদের নৈপূন্য কোথায় শেষ হয়েছে। আপনি শুধু জানবেন নওশাদ সেখানে আছেন, সর্বত্র, ফিল্ম মিউজিককে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে।
নওশাদ এর সুরারোপিত কিছু উল্লেখযোগ্য সিনেমার সম্পূর্ণ অ্যালবামঃ
মুঘল-এ-আজম (১৯৬০) পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া গানটির পুরোটি এখানে
বৈজুবাওরা (১৯৫২)
আনমোল ঘড়ি (১৯৪৬)
রতন (১৯৪৪)
শাহজাহান ১৯৪৬
আন্দাজ ১৯৪৯
মেলা ১৯৪৮
অমর ১৯৫৪
বাবুল ১৯৫০
শাবাব ১৯৫৪
উড়ান খাতোলা ১৯৫৫
আন ১৯৫২
দুলারী ১৯৪৯
মাদার ইন্ডিয়া ১৯৫৭
দীদার ১৯৫১
দিল্লাগী ১৯৪৯
গঙ্গা যমুনা ১৯৬১
আনোখি আদা ১৯৪৮
যাদু ১৯৫১
দিল দিয়া দর্দ লিয়া ১৯৬৬
কোহিনূর ১৯৬০
দাস্তান ১৯৫০
রাম অর শ্যাম ১৯৬৭
মেরে মেহবুব ১৯৬৩
সাজ অর আওয়াজ ১৯৬৬
সোনি মাহিওয়াল ১৯৫৮ প্লে লিস্ট
লীডার ১৯৬৪
দিওয়ানা ১৯৫২
আদমী ১৯৬৮
পালকি ১৯৬৭
সান অব ইন্ডিয়া ১৯৬২
সাথী ১৯৬৮
সংঘর্ষ ১৯৬৮
পাকিজা ১৯৭২
পাকিজার টাইটল মিউজিক, ৩ টি ঠুমরী এবং আবহ সঙ্গীত নওশাদের। কিন্তু তিনি কখনো এটা নিয়ে কিছু বলেন নি। পাকিজার মূল সঙ্গীত পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ ১৯৬৮ তে মারা যান। এক সময়ের সহকারীর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে এগিয়ে আসেন নওশাদ।
টিভি সিরিয়াল 'দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান' এবং 'আকবর দ্য গ্রেট' এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি।
২০০১ সালে স্টারডাস্ট হিরো হোন্ডা আয়োজিত শতাব্দী সেরা পুরষ্কারে শতাব্দী সেরা সঙ্গীত পরিচালক নির্বাচিত হন তিনি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৩৬