somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: সীমান্তের নীল

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আষাঢ়ের দিন । বৃষ্টি ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে দুপুর। অজানা কোনো অভিমানে বিষণ্ন আজ আকাশটা। মেঘের রাজ্যে ক্ষণে ক্ষণেই গতিময় কান্নায় স্নান করে নেয় আমাদের পৃথিবী। তারপর জবজব-চপচপ শব্দে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে।
এমনই এক সন্ধ্যা লগ্নে নীল ধীর লয়ে উপস্থিত হল সীমান্তের দোকানে। দোকানি সীমান্ত যেন মুগ্ধ নীলের পদভারে। সীমান্তের অবাক নয়ন যুগলের চাহনিতে মিষ্টি এক রোদ্দুর।
-সুবহানআল্লাহ্, এততো সুন্দর আল্লাহর সৃষ্টি! সীমান্তের এ কথাটি স্বরের নিম্নতম স্কেল থেকে উচ্চারিত হলেও নীল-এর ইন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছাতে যথেষ্ট ছিল। নীল কিছুটা অস্থিরতায় চোখ ফেরাতেই সীমান্ত বলল -জী ম্যাম। আজ ,এই প্রথম কোন ক্রেতা আমার দোকানে এল।
-ও, তাই বুঝি? এই পথ ধরেই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনার দোকানের নতুন কালেকশনটা একটু দেখে যাই।
- ম্যাম, এ এলাকায় আমার দোকানের সুখ্যাতি আছে। আপনি মনে হয় আজ ই প্রথম এলেন। তাই বোধ হয় জানেন না।
-না, না, আগেও এসেছি দু'একবার। জামা কিনেছিলাম, শাড়ি-চুড়িও কিনেছিলাম। কিন্তু আপনাকে এর আগে কখনো দেখিনি।
-ও, আচ্ছা। আমি মাঝে মাঝে থাকতে পারিনা। যার জন্য এমন একজন ক্রেতাকে মিস করেছিলাম মনে হয়। এনিওয়ে, দেখুন আজ যদি আপনার কিছু পছন্দ হয়, তাহলে একটা 'স্পেশাল প্রাইস' করে দেব আপনার জন্য।
কথাগুলো বলতে বলতে সীমান্ত 'ক্যাশ কাউন্টার' থেকে উঠে নীলের পেছন পেছন গেল। দোকানি হিসেবে সীমান্ত খুব রুচিশীল এই প্রান্তে। ‘বেইলি রোডের’ এই সড়কী বাজারে তার এবং তার ভাইয়ের আলাদা-আলাদা দুটো দোকান আছে। ছাত্রজীবন থেকেই সীমান্ত ভাইয়ের সাথে দোকান করতো। একটা সময় ভাইয়ের দোকান ছেড়ে নিজের মত করে শাড়ি, মেয়েদের থ্রি-পিস এবং সাজ-সজ্জার এ বিপণিটি প্রতিষ্ঠিত করে। দু'বছরের মধ্যেই যেটি সবার কাছে বেশ পরিচিত হয়ে গেছে। বিশেষ করে নারী এবং মেয়েদের কাছে।
নীল ঘুরে ঘুরে দেখছে। সীমান্ত 'ল্যান্ডিং স্টিক' দিয়ে একটা শাড়ি নামিয়ে বলল, এই শাড়িটা দেখুন, অনেক সুন্দর শাড়ির আঁচলটা, দারুণ কারুকাজে আঁকা। আপনাকে বেশ মানাবে শাড়িটায়!
নীল হাতে নিয়ে দেখতেই পছন্দ হয়ে গেল। সত্যিই চোখে লাগার মত একটা শাড়ি। শাড়িটার মুল্য জানতে চাইল নীল।
সীমান্ত সহাস্য বদনে প্রানবন্ত বাক্যে বলল- কী যে বলেন ম্যাম! আপনি দেখুন আর কোনো শাড়ি বা জামা পছন্দ হয় কী-না। আমি আপনাকে বলেছিলাম না- আপনার জন্য বিশেষ ছাড় দেবো? তাই মোটেও ভাববেন না! আমি একবারেই ‘প্রাইস’ করে দেব। কথা দিলাম, অন্য কোনো দোকানে আপনি এমন শাড়ী এ দামে আর একটাও পাবেন না। আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন ম্যাম। সব ক্রেতাই আমার কাছে লক্ষ্মী।
একজন দোকানদারের এমন সুন্দর ভাষায় কথা বলা দেখে নীলের বেশ ভাল লাগে। পুরো দোকান ঘুরে নীল দুটি জামাও পছন্দ করে তুলে নিল। একটি শাড়ি ও দুটি জামার মূল্য সীমান্ত এতোই কম করে দিল যে নীল তা অনায়াসেই বুঝতে পারল। প্যাকেট করতে করতে সীমান্ত বলল, ম্যাম, আবার আসলে খুব খুশি হব। প্রতি সপ্তাহেই আমাদের নতুন কালেকশন আসে।আসবেন নিশ্চই?
জড়তাহীন এবং সাবলীল আহবানে নীল কে মুগ্ধ করে সীমান্ত। নীল বের হয়ে যাওয়ার সময় সীমান্ত বলল, ম্যাম, চা খাবেন? আমাদের পাশেই চায়ের দোকান, চা টা বেশ চমৎকার হয়!
-না-না, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমাকে বাসায় যেতে হবে। মা চিন্তা করবেন।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে বেশ, আরেকদিন এলে না খাইয়ে ছাড়বোনা কিন্তু।
সীমান্তের হাসিটা বেশ ভাল লাগার মত। প্রাণ খোলা হাসি তার চোখে মুখে লেগেই থাকে। নীল দোকান থেকে বের হয়ে গেল। রিক্সাওয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলল -এই রিক্সা যাবে?
-কই যাইবেন আপা?
-এইতো ইস্কাটন-এ।
-হ, যামু।
-কত নিবে?
-আশি টাকা দিবেন আপা।
-এততো টাকা তো ভাড়া নেই।
-আইজকা আছে আপা, জাগায় জাগায় পানি জমছে। আর যে জাম আইজকা।
-আচ্ছা, চলো চলো। একটু দেখেশুনে জলদি যাবে।
নীল রিক্সায় উঠে বসলো। রিক্সাওয়ালা জলজটের মধ্যে প্যাডেলে চাপতে থাকে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে, আর রিক্সা চলতে থাকে নীলের বাসার উদ্দেশ্যে অনেকটা ধীর গতিতে।
সীমান্তকে তার কর্মচারি জুয়েল এসে বলল- ভাইয়া জিনিসগুলা লস এ দিয়ে দিলেন?
ঈষৎ হেসে সীমান্তের উত্তর- কখনো কখনো দিতে হয় জুয়েল। যাও, দু'কাপ চা নিয়ে এসো। এই মুহুর্তে লস হলেও মনটা ভীষণ ভাল। সাথে ছোট পেঁয়াজুগুলো কয়েকটা নিয়ে এসো।
রাতে আট টার পর নীল বাসায় ঢুকলো। ঢুকেই মাকে বলল, মা রাস্তায় যা পানি জমেছে আজ , তার উপর জ্যাম।আমি আবার একটা দোকানে গিয়ে আরো দেরি করে ফেলেছি।
-হুম, তাইতো বলি তোর এত দেরি হচ্ছে কেন? কী কিনেছিস,দেখি?
নীলের ছোট বোন এসেও দেখতে চাইল কী কিনেছে নীল। নীল তার মা আর ছোট বোনকে জামা আর শাড়িগুলো দেখাল। আর বলল, জানো মা, কাপড়গুলো এত কম দামে দিল যে শুনে অবাক হয়ে যাবে তুমি। এই যে দেখছ শাড়িটা, মাত্র আটাশশো পঞ্চাশ টাকা, আর জামাগুলো ছাব্বিশশো করে।
-হ্যা, তাহলেতো অনেক সস্তা হয়েছে বলে মনে হয়। নীলের বোন নুপুর বলল, হ্যা আপি অনেক ভাল হয়েছে!
-হুম, আর দোকানদারের ব্যবহারও খুব ভাল। নুপুর জানতে চাইল দোকানটি কোথায় আপি?
নীল দোকানের ‘লোকেশন’ বর্ননা করতে করতে জামা আর শাড়ি ‘রিপ্যাক’ করে তুলে রাখল আলমারিতে।নীল কেনা-কাটায় খুব ই সৌখিন। কোনো কিছু চোখে লেগে গেলে তা তার সংগ্রহ করা চাই। সংগ্রহের পর তা বেশিরভাগ সময়ই পড়ে থাকে আলমিরা অথবা ওয়্যারড্রোবে।
নীল বিবাহিত। তার স্বামী একটা মাল্টিন্যশনাল কোম্পানিতে 'প্রজেক্ট ডিরেক্টর' পদে কাজ করছে। কাজের প্রয়োজনে গত মাসে সে লন্ডনে গেছে, তিন মাসের একটি অফিসিয়াল সফরে।

কিছুটা ফ্রী সময় বলে নীল মায়ের বাসায় থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের উপর একটা কোর্স করছিল। নীলের সখ একজন ভাল ডিজাইনের হওয়া। স্বল্প মেয়াদের এ কোর্সটি করে ভাল কিছু শিখতে পারলে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তার।
দু’দিন পর। একেবারেই রৌদ্রোজ্জল শান্ত বিকেল। নীল ক্লাস শেষ করে সীমান্তের দোকানে গেল। সীমান্ত গালভরা হাসি দিয়ে আপন কাউকে পাবার মত করে নীল কে স্বাগত জানালো। দোকানে আজ অনেক ক্রেতার উপস্থিতি আছে।তবু নীলকে দেখেই সীমান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও ফোনে দু’টো পেপের জুসের অর্ডার দিয়ে দিল।
নীল নিজের মত করে ঘুরে ঘুরে দেখছে। একটা বিদেশি লিপস্টিক, একটা কাজল আরো কিছু টুকিটাকি কসমেটিকস নিয়ে ক্যাশের সামনে এল। এর মধ্যেই জুস চলে এলে সীমান্ত নীলকে নিতে বলল।
- আরে,আমার জন্য? কখন বললেন? আমি খাবোনা। আমি বাইরের তেমন কিছু খাইনা।
-ও আচ্ছা, আমি তো জানিনা, তাই অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলাম।।ভয় পাবার কিছু নেই ফ্রেশ জুস। আমি যেখান থেকে আনিয়েছি, ওরা মান বজায় রেখেই তৈরি করে। সুতরাং এটা খেতে পারেন।আমি খুব খুশি হবো।

নীল ‘স্ট্র’ টা টিসু দিয়ে মুছে জুস পান করছে। সীমান্ত অন্য ক্রেতাদের থেকে বিল নিতে নিতে নীলের সাথে কথা বলছে। কথার মাঝে নীলকে জিজ্ঞেস করল- আপনার বাসা কি এখানেই?
-নাহ, ইস্কাটনে, আমার মায়ের বাড়ি।
-মায়ের বাড়ি?
-হু, মায়ের বাড়ি।
নীলের কথায় সীমান্ত কিছুটা অবাক হল। কিন্তু ব্যস্ততায় ভুলে গিয়ে নিজের কাজে মন দিল। নীল কসমেটিকস গুলো ক্যাশের পাশেই সীমান্তের সামনে রাখল। সীমান্ত মুল্য হিসেব করে না দেখেই ওগুলো 'প্যাক'দিল।
নীল জানতে চাইল- দাম কত এসছে?
-যা নিলেন, দাম ধরবার মত নয়। আজ থাক। অন্যদিন একসাথে নিয়ে নিবো।
-না, তা বললে হবেনা। আজই নিতে হবে। নইলে আমি আর আসবোনা।
-ও তাই? এমন কথা বলতে নেই। ঠিক আছে দিন চারশ পঞ্চাশ টাকা দিন। নীল পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে দিচ্ছে... তখনি সীমান্ত হাত বাড়িয়ে রেখে দিতে বাধ্য করলো নীলকে। তারপর বলল- আপনার নামটাতো জানা হয় নি। আমি কী নামটা জানতে পারি?
-হুমম, অবশ্যই পারেন। আমার নাম নিলুফার ইয়াসমিন (নীল) ।
-বাহ, চমৎকার নাম, নীল! এক আকাশ নীল! বেশ ভাল।আমি নীল আকাশ পছন্দ করি। আর এমন একজন নীলকে কার না পছন্দ হবে! আর আমি সীমান্ত নিজে থেকেই বললাম।
একটু হেসে নীল বলল, ঠিক আছে, ধন্যবাদ। দোকানে নতুন তেমন পছন্দের কিছু পেলাম না আজ ,তাই টুকিটাকি নিলাম। কিন্তু আর কখনো এমন করবেন না প্লিজ। আমি পছন্দ করিনা এসব।
-ও, আচ্ছা। প্রমিজ করলাম, না-না, কানেও ধরলাম। এবার থেকে আর ভুল হবে না ম্যাম। আপনার মোবাইল নাম্বার দিয়ে যান। ভাল 'কালেকশন'এলে আমি ফোন দিবো আপনাকে। যদি আপনার আপত্তি না থাকে। নীল হাসিমুখে নাম্বার দিয়ে বিদায় নিল দোকান থেকে।

আজ নীল বিদায় নিলে সীমান্ত নীলের চলে যাওয়া দেখছিল, যেন সে তার নিজের কাউকে বিদায় দিচ্ছে এমন করে। সীমান্তের চোখে নীলকে অপরূপা লাগে। কেমন যেন এক নীলাভ্রের পরশে উজ্জীবিত হয় সীমান্তের প্রাণ। নীল এলেই তার ভীষণ ভাল লাগে। মন চায় নানান বাহানায় নীলকে ধরে রাখতে তার দু’নয়নের চাহনিতে।
কিছুদিন পর একদিন বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল নীল। এমন সময় মোবাইলে রিং বেজে উঠে তার। মোবাইলটা হাতে তুলে নিল সে। অপরিচিত একটা নাম্বার। তাই ধরলোনা। কিন্তু একটু পর আবার রিং হলে ‘পিক’ করল নীল।
জ্যি, ম্যাম, আমি সীমান্ত। কী চিনতে পেরেছেনতো?
নীল চিনতে পেরেছে ঠিকই তবুও জানতে চাইল-কোন সীমান্ত যেন?
-এই দেখ, ভুলেই গেলেন? আরে বেইলী রোডের দোকানি। মনে পড়েছে এবার?
-ওহ, আচ্ছা, আচ্ছা। হ্যা, এবার মনে পড়েছে। কেমন আছেন?
- আমি ভাল আছি। তা আপনি কেমন আছেন? অনেক দিন হল দোকানে আসেন না। তাই ভাবলাম একটু ফোন করে খবর নেই। দোকানে বেশ কিছু নতুন সংগ্রহ এসেছে।
-তাই? ঠিক আছে সময় করে আসবোনে। নীল ফোন রাখবার মত করে বলল।
- সীমান্ত না রাখবার বাহানায়- তো ... কী করছিলেন?
-একটা বই পড়ছিলাম।
-কার লেখা?
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের।
-তাই? আমার খুব প্রিয় একজন কবি তিনি।তাঁর কবিতা আমার অনেক ভাল লাগে জানেন?
বিশেষ করে ‘কেউ কথা রাখেনি'এর মত কবিতাগুলোতো আমার একেবারে প্রাণ ছুঁয়ে যায়!
-হুমম, আমারো। আপনি এখনো বই পড়েন?
-কেন? আমি সব সময় ই বই পড়ি। বই আমার প্রিয় সঙ্গি। এমনকি দোকানেও মাঝে মাঝে পড়ি। এটা আমার অন্যতম সখও বটে।
-তাই? ‘গ্রেট।’

এভাবে নানান কথায় সীমান্তের মন ভরে যায়। নীলও সীমান্তের রুচিবোধের কাছে নিজেকে মানিয়ে নেয়। তারপর থেকে ধারাবাহিক যোগাযোগ। সীমান্ত ধীরে ধীরে নীলের কাছকাছি চলে আসে। ভাল লাগা, মন্দ লাগা অথবা রসহীন সময়ে সীমান্ত রসোর্ত্তীর্ণ হয় নীলের রসবোধের কাছে।
নীল মাঝে মাঝেই দোকানে এসে ঘুরে যায়। সীমান্ত প্রতি দেখায় নতুন কিছু করে।নীল উপভোগ করে সীমান্তের পাগলামীগুলো।নীলের হৃদয়ে জন্ম নেয় সীমান্তের প্রতি ভাললাগা কিংবা মায়ার কিছু অনুভূতি।কিন্তু বিবাহিত মেয়েদের এমন কোনো ভাললাগা সমাজিকভাবে বিবর্জিত দেশে দেশে।
আজ দোকানে নয়, নীল এসেছে মৌচাকে। সীমান্তকে ফোন করে জানালে সীমান্ত ছুটে গেল সেখানে। নীলের সাথে কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে তারপর বসলো দুজন কফি শপে।
-আচ্ছা নীল, আপনাকে তুমি করে বললে কী আপনার খুব বেশি আপত্তি আছে?
-হুম, আছে। হা হা হা।
-হেসোনা, বলনা আপত্তি আছে কী-না।
-তুমিতো বলেই দিলে।
-হা হা হা, তাহলে তুমিও যে তুমি বললে? চলো আজ থেকে তুমি, তুমি, তুমি মিলে তুমিতে চলে যাই।
-না,
-হ্যা,
-আমি বলছি না।
-আমি বলি হ্যা,
-ওকে, ওকে।
-আচ্ছা, তোমার ফেসবুক আইডি বলো। আমি এড পাঠাই। কষ্ট করে খুঁজে পাঠাও। আমার যে নাম বলেছি, ও নামেই পাবে আমায়।
সীমান্ত পেয়ে গেল নীলের ফেসবুক আইডি। ইয়া হু, পেয়ে গেছি। এটা না?
-কই দেখি!
-না, এটা না।
-কী বল?
-হি, হি, এটাই।
-তোমার কোনো ছবি নেই কেন?
-আমি ফেসবুকে ছবি দিতে পছন্দ করিনা। তাই নেই।
-ওহ, গুড। কিন্তু তোমায় তো কেউ চিনবেনা তাহলে।
-পরিচিতদের শুধু রাখি। তারা ছবি না হলেও চিনে যায়। আচ্ছা, আমাকে যেতে হবে। উঠো তাহলে।

বাসায় গিয়ে নীল সীমান্তকে এক্সেপ্ট করে নেয়। যার মাধ্যমে নীলের আপডেটস জানতে থাকে এবং বিভিন্ন খবরা-খবর আদান প্রদান করতে থাকে ইনবক্সের মাধ্যমে। সীমান্তের চোখে পড়ে নীলের জন্ম তারিখ। পরের দিনের জন্ম তারিখের লিস্টে নাম আসে নীল-এর। সীমান্ত ভাবতে থাকে কী করা যায়? নীলকে আন্দোলিত করতে বেইলি রোডের সবচেয়ে দামী এবং রাজকীয় একটা লং ফ্রক কিনে নেয় সে।সীমান্ত প্রিয়জনদের নিজের পছন্দনীয় উপহার দিতে পছন্দ করে। এখন সীমান্তের কাছে তার সবচেয়ে প্রিয়জন নীল।
রাত বারটা বেজে গেলে নীলের মোবাইলে ফোন এল সীমান্তের।নীলকে জন্মদিনের প্রথম শুভেচ্ছা জানাল সীমান্ত। নীল জানে তার স্বামী ফোন করেবে এখন, তাই ব্যস্ততার ভান করে ফোন রেখে দিতে চাইল। নীলকে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে ফোন রেখে দিতে বাধ্য হল সীমান্ত।
পরদিন নীল দোকানে এলে সীমান্ত নীলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে অতি মনোরম একটি 'গিফট প্যাক' তুলে দিল নীলের হাতে। -এটা তোমার জন্য। সম্রাজ্ঞীর জন্মদিনে সীমান্তের অতি ক্ষুদ্র উপহার।
নীল বেশ অবাক হয়েই উপহারটি গ্রহন করল। ভেতরে কী আছে তা জানিনা। কিন্তু প্যাকেট দেখেই আমার খুব ভাল লাগলো। থ্যাঙ্কস! আমি আজ তোমাকে খাওয়াবো, আমার জন্মদিন উপলক্ষে।
-কী খাওয়াবে?
-তুমি কী খেতে পছন্দ কর?
-আমার প্রিয় খাবারের তালিকা অনেক বড়। কারণ আমি সব সুস্বাধু খাবার-ই পছন্দ করি। চলো ওপাড়ের রেস্ট্রুরেন্টটায় গিয়ে বসি! সীমান্ত দোকানের ক্যাশে জুয়েল কে বসতে বলে নীলকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
আজ সীমান্ত দারুণ একটা শর্ট পান্জাবী পরে এসেছে। যা তাকে বেশ সুন্দর লাগছে। নীল এটা লক্ষ করলো। দু’জনে একটু হেটে ‘হেলভেসিয়াতে’ গিয়ে বসল। খাবারের আদেশ দিয়ে দু'জনে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে লাগল। কথার ফাঁকে সীমান্ত বলল, আমার মাকে আমি ভীষণ ভালবাসি। যাকে আমি সব কিছু ‘শেয়ার’ করি অনায়াসেই। তোমার কথা বলেছিলাম। মা, তোমার কথা শুনে মুগ্ধ।তাই তোমার সাথে একদিন কথা বলতে চান তিনি। যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে কী তুমি..?
-না না আপত্তি কেন থাকবে? তবে এখন না। নাম্বারটা দাও আমি বাসায় গিয়ে নিরিবিলিতে কথা বলব।
-ঠিক আছে, ওটাই ভাল হবে।
খাবার চলে এলে দু'জনে খেতে খেতে আরো কিছু কথা বলাবলি হল। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় শেষে নীল বিদায় নিতে চাইল। সম্মতি জানিয়ে নীলকে রিক্সা পর্যন্ত উঠিয়ে দিল সীমান্ত।
নীল রিক্সায় উঠেই আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল, 'সীমান্ত তাকে কীভাবে নিচ্ছে! যদি তার নিজের মত না ভেবে অন্য কিছু ভেবে নেয়- তাহলে বিশাল ঝামেলা হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং কিছুদিনের মধ্যেই ওকে বলে দেয়াই উত্তম।' এসব কিছু ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যার কিছু পর বাড়ি ফিরল নীল। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর সীমান্তের মাকে ফোন দিল। ওর মায়ের কথায় আরো বেশি পরিষ্কার হয়ে গেল যে সীমান্তের চাওয়াটা কী হতে পারে! ধীরে ধীরে সম্পর্ক কিছুটা সীমিত করবার প্রত্যয়ে নীল নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কিছুটা ব্যস্ততা দেখিয়ে সীমান্তের কাছ থেকে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করছিল নীল।
এরপরই শুরু হল সীমান্তের বাড়াবাড়ি। সীমান্ত যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলনা। আকস্মিক নীলের এমন পরিবর্তন সীমান্তকে দূরে সরে যাবার চেয়ে নীলের আরো কাছে যেতে আগ্রহী করে তুলছিল।
সীমান্ত নীলের ফেসবুকেও অন্যদের লাইক,কমেন্টস কিংবা নীলের স্ট্যাটাস সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি শুরু করে দিল। নীল তা মোটেও সহ্য করতে পারছিলনা। মেনে নিতে পারছিলনা কোন অধিকারে সীমান্ত এমন করছে তার সঙ্গে!
সীমান্ত ধারাবাহিক ভাবে বাড়াবাড়ি শুরু করে। সহ্য সীমা অতক্রম করলে নীল তার ফেসবুকে বন্ধু তালিকা থেকে ‘রিমুভ’করে দিল সীমান্তকে।
চমকে গিয়ে সীমান্ত নীলকে ফোন দিল। ফোন ধরেই নীল-দেখুন সীমান্ত আমি একজন বিবাহিত মেয়ে। আমার হাজব্যান্ড আছে, সংসার আছে। সব মিলে অনেক ভাল আছি আমি। আপনার সাথে একটা মাধ্যমে পরিচয় হয়েছে, আপনাকে ভাল মানুষ হিসেবে আমি বন্ধুর মত ভেবেছি। তার চেয়ে একবিন্দুও বেশি নয়।
-আমি বিশ্বাস করিনা। তুমি আমাকে 'এভয়েড' করার জন্য এসব বলছ।
-দেখ সীমান্ত, আমি মোটেও তা করছিনা এবং কোনোরকম মিথ্যেও বলছিনা। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার হাজব্যান্ড লন্ডন থেকে ফিরবে। ও এলে প্রয়োজনে আমি তোমার দোকানে ওকে নিয়ে আসব । প্লিজ, তবুও আমার কথা বিশ্বাস করো!
সীমান্ত খুব জোরে হাসল। কেন হাসল অমন করে?- অতি আনন্দে, নাকি অতি দুঃখে, নাকি অন্য কিছু, তা বুঝতে পারলনা নীল। সীমান্ত এই কদিনে বেশ পালটে গেছে। কেমন যেন ‘সাইকো'পেশেন্টের’ মত আচরণ করছে সে। -আচ্ছা সীমান্ত আমি ফোনটা রাখছি এখন। -না, রাখবে না। আমি আরো কথা বলবো।
নীল তবুও ফোন রেখে দিল। সীমান্ত বিদ্রোহী হয়ে গেছে। নীলকে সে মনের মানুষ বানিয়ে নিয়েছে নিজের মত করে। নীল তা বুঝে-না বুঝে সঙ্গ দিয়েছে সীমান্তকে। তার মনে বিন্দুমাত্র ইশারা করেনি সীমান্তের চাওয়ার কথা। ভাললাগার অনুপম ঘূর্ণনে যেন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল নীল।
‘থামলো তুফান হঠাৎ যেন, সময় হল ঘর গুছানো।’
নীল সংসারী হবার সম্বিত ফিরে পেল।
নীলের স্বামী জামিল ফিরে এল লন্ডন থেকে। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে নীল সীমান্তের বিষয়টি জানালো তাকে। জামিল নীলকে অধিক বিশ্বাস করে এবং ভালবাসে। নীলেরও প্রিয় মানুষ জামিল।একজন মৃদুভাষী এবং স্থির বুদ্ধির মানুষ সে। নীলের খুব পছন্দ শান্ত বুদ্ধির ছেলেদের।
জামিল সব কথা শুনে খুব সুন্দরভাবে নীলকে বুঝিয়ে বলল, তুমি ওর থেকে সম্পূর্ণ দূরত্ব বজায় রেখ এবং আমাদের বিয়ের একটি ছবি তাকে ইনবক্স করে দাও- সে যেন বিশ্বাস করে নেয় তুমি বিবাহিত। নীল সম্মতি জানাল। তারপর একদিন ওদের বিয়ের যুগল দু'টি ছবি সীমান্তকে ইনবক্স করে দিল নীল। সীমান্ত কোনো উত্তর দিলনা তার।
এরপর থেকে কোথাও সে আর কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি নীলের সাথে…।
-মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:০১
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×