আখড়াই - হারিয়ে যাওয়া লোকগীতি
আঠারো শতকে নদীয়ার শান্তিপুরে আখড়াই-এর উদ্ভব। নামের সূত্র ধরে আখড়াই গানের উৎপত্তিস্থল বৈষ্ণবদের আখড়া বলে মনে করা হয়। প্রথম পর্যায়ে এ গানের দুটি অংশ থাকত খেউড় ও প্রভাতী। তখন গানগুলো ছিল কুরুচিপূর্ণ এবং এর সঙ্গে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোও ছিল নিম্নমানের। ক্রমেই এ গান শান্তিপুর থেকে ছড়িয়ে পড়ে চুঁচুড়া ও কলকাতায়। তখন এর আঙ্গিকগত পরিবর্তন ঘটে। দুটি পর্যায়ের আগে যুক্ত হয় ভবানীবিষয়ক গান অর্থাৎ এ সময়ে দুটির স্থলে তিনটি গান গাওয়া হতো। ভবানী বিষয়ে থাকত দেবীবিষয়ক গান, খেউড়ে মিলন প্রত্যাশী লৌকিক প্রেমের গান এবং প্রভাতীতে থাকত রজনী-প্রভাতের আশাভঙ্গসূচক গান। ভবানীবিষয়ক গানের মহড়া ও চিতেনের থাকত ছাবি্বশ অক্ষরের একটি করে ত্রিপদী এবং অন্তরায় অনুরূপ দুটি ত্রিপদী। খেউড় ও প্রভাতীর মহড়া ও চিতেনের, কখনওবা অন্তরায়ও থাকত চৌদ্দ অক্ষরের একটি করে পয়ার পঙ্ক্তি। এ গান দুই দলে বিভক্ত হয়ে পরিবেশিত হতো। কিন্তু কবি গানের মতো উত্তর-প্রত্যুত্তরের ভঙ্গিতে নয়। এ সময় আখড়াই গানের এ আঙ্গিকগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার গুণগত পরিবর্তনও সাধিত হয়। কুরুচিপূর্ণ শব্দের পরিবর্তে মার্জিত শব্দের ব্যবহারে গানগুলো হয়ে ওঠে সুখশ্রাব্য। চুঁচুড়ায় কতিপয় পেশাদার শিল্পী দলীয়ভাবে এ গান পরিবেশন করতেন। তারা বছরে দুইবার কলকাতায় গিয়েও গান পরিবেশন করতেন। যন্ত্র হিসেবে তারা হাঁড়ি, কলসিসহ বাইশটি উপাদান ব্যবহার করতেন বলে তাদের দলকে বলা হতো বাইসেরা। আঠারো শতকের শেষ দিকে আখড়াই গানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। এ সময় মহারাজ নবকৃষ্ণ দেবের সভাগায়ক কলুই চন্দ্র সেন সংস্কারের মাধ্যমে আখড়াই গানকে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। গানের রাগ-রাগিণী ও বাদ্যযন্ত্রেও বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে তানপুরা, বেহালা, মন্দিরা, ঢোল, মোচং, করতাল, জলতরঙ্গ, বীণা, বাঁশি, সেতার ইত্যাদি একসঙ্গে বাজানো হতো। গানের তাল সংগীতের গতি ছিল পাঁচ ধরনের পিড়েবন্দী, দোলন, দৌড়, সবদৌড় ও মোড়। এ সময় কলুই সেনের ভাগ্নে নিধু গুপ্তের হাতে আখড়াই গানের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়।
তবে আখড়াই গানের প্রায় সব বাদ্যযন্ত্র এতে ব্যবহৃত হতো। হাফ-আখড়াই গানের পদ রচিত হতো চিতেন, পরচিতেন, ফুকা, ডবল ফুকা, মেলতা, মহড়া, খাদ, দ্বিতীয় ফুকা, দ্বিতীয় ডবল ফুকা, দ্বিতীয় মেলতা এই ক্রমে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ১১:৩৯