তিনি এক ব্যতিক্রমী কবি। তার নিজস্ব অভিনব, অভূতপূর্ব ঘরানায় তিনি শুধু একজন মৌলিক কবিই নন, তিনি সৌন্দর্যের কবি, শিশুদের নিষ্পাপত্বের গুনমুগ্ধ কবি, প্রকৃতি ও প্রকৃতির স্রষ্টার কবি এবং সবকিছুকে ছাপিয়ে মানবতার কবি। খুব কম বাঙালী শিশুই আছে, যাদের কবিতার হাতেখড়ি ‘ফররুখ আহমদ’কে দিয়ে হয়নি। মানবতার উৎস অনুসন্ধানে একসময় বামপন্থী আন্দোলনে যোগ দেয়া এই কবি তার গন্তব্য চিনতে পেরেছিলেন। তিনি সম্পূর্ণ ইসলামিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তাকে ইসলামী পুনর্জাগরনের কবি বলা হয়। কিছু দুষ্টলোক তাকে নির্দিষ্ট মতাদর্শের কবি বলে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তিনি হলেন সকল নিপীড়িত জাতির কবি, সব মজলুমদের উত্তোরণকামী কবি। তাকে নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ ভাবাটা চরম মূর্খামি, তার নিয়মিত একনিষ্ঠ পাঠকরা সেটা ভালই জানেন। ইসলামিক ভাব ধারণ করেও কখনো কোন সম্প্রদায় বা তাদের জীবনদর্শনকে কখনো কটাক্ষ করেননি বরং ইসলামকে শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, সম্পূর্ণ মানবতার মুক্তিদাতা হিসেবে দেখেছেন।
‘পাঞ্জেরি’ তার এক বিখ্যাত কবিতা। এটা তার ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’তে সংকলিত হয়।
এইচএসসির পাঠ্যবইয়ে ‘পাঞ্জেরি’ শব্দের প্রতীকী অর্থ করা হয়েছে ‘জাতির পথপ্রদর্শক’। এ অর্থ ধরে পড়লে কবিতা সম্পূর্ণভাবে বোঝা যাবেনা। কিন্তু যদি ‘পাঞ্জেরি’ শব্দের প্রতীকী অর্থ ধরেন ‘মুসলিম জাতির পথপ্রদর্শক’, তাহলে কবিতাটি সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার হবে আপনার কাছে। আসলে কবি তার কবিতায় বৈশিষ্ঠ্যমূলকভাবেই তৎকালীন অনগ্রসর আর হতাশ বাঙালি মুসলিম সমাজকে উজ্জীবিত করতেই এই কালজয়ী কবিতাটি লিখেছিলেন। পাঠ্যবইয়ে কোন এক অজ্ঞাত কারনে ‘মুসলিম’ শব্দটা এড়িয়ে কবিতার আসল উদ্দেশ্য আর ভাবকে বিকৃত করা হয়েছে। এই মহান কবির কবিতার বিকৃতি কিভাবে করা হয়েছে বুঝতে কবিতাটি আপনাকে দুইবার পড়তে হবে। একবার ‘পাঞ্জেরি’ অর্থ ‘জাতির পথপ্রদর্শক’ ধরে, আরেকবার ‘মুসলিম জাতির পথপ্রদর্শক’ ধরে। পাঠ্যবইয়ে ‘জাতি’ বলতে পরিষ্কারভাবে ‘বাঙালি জাতি’কেই বোঝানো হয়েছে।
------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------
পাঞ্জেরি
ফররুখ আহমদ
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
দীঘল রাতের শ্রান্ত সফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
আহা, পেরেশান মুসাফির দল।
দরিয়া কিনারে জাগে তকদিরে
নিরাশার ছবি এঁকে!
পথহারা এই দরিয়া- সোঁতায় ঘুরে
চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরি!
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,
দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি তুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।
মোদের খেলার ধুলায় লুটায়ে পড়ি।
কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ও কি বাতাসের হাহাকার,- ও কি
রোনাজারি, ক্ষুধিতের!
ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!
ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।
পাঞ্জেরি!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রূকুটি হেরি,
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রূকুটি হেরি!
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!